দেহ ও মনের সম্পর্ক কী?


প্রশ্নঃ দেহ ও মনের সম্পর্ক কী?
অথবা, দেহ ও মনের সম্পর্ক বলতে কী বুঝ?

ভূমিকাঃ দর্শনের বিভিন্ন সমস্যাবলির মধ্যে দেহ ও মন সম্পর্কিত সমস্যাটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। আধুনিক কালের দার্শনিকদের মধ্যে কেউ কেউ দেহ ও মনকে আলাদা দ্রব্য হিসেবে স্বীকার করেছেন, আবার কেউ কেউ দেহ ও মনকে একই দ্রব্যের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তবে যা-ই হােক না কেন, দেহ ও মন পরস্পর নির্ভরশীল। কেননা দেহ সুস্থ থাকলে মন সুস্থ ও সতেজ থাকে। আবার দেহ অসুস্থ হয়ে পড়লে মনও দুশ্চিন্তা ও দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়। নিম্নে এই পূর্বস্থাপিত শৃঙ্খলাবাদ ব্যাখ্যায়িত হলাে-

দেহ ও মনের সম্পর্ক সম্বন্ধে বিভিন্ন মতবাদঃ বিভিন্ন দার্শনিক দেহ ও মনের সম্পর্ক সম্বন্ধে যে বিভিন্ন মতবাদ দিয়েছেন সেগুলাের মধ্যে নিম্নলিখিত মতবাদ অন্যতম প্রধান। যথা- (১) ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াবাদ, (২) প্রয়ােজনবাদ, (৩) সমান্তরালবাদ, (৪) পূর্বস্থাপিত শৃঙ্খলাবাদ, (৫) উপ-বস্তুবাদ, (৬) বিজ্ঞানবাদ, (৭) পরব্রহ্মবাদ, (৮) স্বেচ্ছামূলক ভাববাদ, (৯) সৃজনবাদ, (১০) উন্মেষবাদ। নিম্নে পূর্বপ্রতিষ্ঠিত শৃঙ্খলাবাদ নিয়ে আলােচনা করা হলাে-

(১) ঈশ্বর কর্তৃক দেহ ও মনের মধ্যে সৃষ্টির সময়েই সঙ্গতি স্থাপনঃ লাইবনিজের মতে, ঈশ্বর সৃষ্টির সময়ই দেহ ও মনের মধ্যে এক শৃঙ্খলা স্থাপন করে দিয়েছেন। এ শৃঙ্খলা অনুসারে দেহ ও মন পরস্পরের মধ্যে নিত্যসঙ্গতি রক্ষা করে চলেছে। প্রতিমুহূর্তে এ সঙ্গতির জন্য ঈশ্বরের হস্তক্ষেপের প্রয়ােজন হয় না। সৃষ্টির সময় একবার হস্তক্ষেপ করেই ঈশ্বর দেহ ও মনের নিত্যসঙ্গতির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। লাইবনিজ দেহ ও মনকে দু’টি ঘড়ির সাথে তুলনা করেছেন। তিনি বলেন, দুটি ঘড়ি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, অর্থাৎ ঘড়ি দু'টি তৈরি করার সময় তার মধ্যে এমনভাবে শৃঙখলা স্থাপন করা হয়েছে যার ফলে দু'টি ঘড়ি আলাদাভাবে অবস্থান করেও একই রকম সময় নির্দেশ করে চলেছে।

(২) চিৎপরমাণু নিরপেক্ষ হলেও পূর্বস্থাপিত শৃঙ্খলার কল্যাণে সম্পর্কযুক্তঃ লাইবনিজের মতে, জগৎ চিৎপরমাণুতে পরিপূর্ণ। তবে এ চিৎপরমাণুগুলােতে চৈতন্য প্রকাশের মাত্রাভেদ আছে। কতকগুলাে চিৎপরমাণু অচেতন, কতকগুলাে চেতন আবার কতকগুলাে আত্মসচেতন। প্রত্যেক চিৎপরমাণুই স্বনির্ভর আত্মকেন্দ্রিক এবং গবাক্ষহীন। এরা পরস্পর প্রভাবমুক্ত। ঈশ্বর হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ পরমাণু। তিনিই অন্যান্য পরমাণুকে সৃষ্টি করেছেন এবং আগে থেকে এদের ভেতর নিত্যসঙ্গতি প্রদান করেছেন। ফলে এরা নিরপেক্ষ হলেও পূর্বস্থাপিত শৃঙ্খলার কল্যাণে সম্পর্কযুক্ত।

(৩) সর্বশ্রেষ্ঠ মােনাড কর্তৃক শৃঙ্খলা স্থাপনঃ লাইবনিজের মতে, সর্বশ্রেষ্ঠ মােনাডই অন্য মােনাডগুলােকে সৃষ্টি করেছেন এবং সৃষ্টি করার সময় তাদের মধ্যে একটি শৃঙ্খলা স্থাপন করে দিয়েছেন। এর ফলে জগতে কোথাও কোনাে অরাজকতা বা কোনাে বিশৃঙ্খলা নেই, সবকিছুই নিয়ম-শৃঙখলামতাে চলছে। অর্থাৎ জগতে বিভিন্ন জিনিস আছে, যাদের বৈশিষ্ট্য ভিন্ন ভিন্ন। কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হলেও ঈশ্বর কর্তৃক সবকিছু সৃষ্টি হওয়ার কারণেই এবং সবকিছু সৃষ্টির সময় নিয়ম-শৃঙ্খলা স্থাপন করার কারণেই জগতের সবকিছু শৃঙ্খলা অনুযায়ী, নিয়ম-নীতি অনুযায়ী চলছে। লাইবনিজের এ মতই পূর্বপ্রতিষ্ঠিত সঙ্গতিবাদ বা Preestablished harmony নামে পরিচিত।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, দেহ ও মনের সম্পর্কের স্বরূপ সম্পর্কিত আলােচনায় পূর্বপ্রতিষ্ঠিত শৃঙ্খলাবাদ নামক মতবাদে কিছু ত্রুটি লক্ষ করা গেলেও এটাকে একেবারে মূল্যহীন বলা যায় না। কেননা, জগতের বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে অসঙ্গতি থাকলেও অনেক বিষয়ই নিয়ম-শৃঙখলা অনুযায়ী চলছে। আর এ চলার পেছনে আগে থেকে কোনাে কিছু প্রতিষ্ঠিত বিষয় না থেকে পারে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক