সত্তাবিষয়ক মতবাদ হিসেবে বহুত্ববাদ ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন কর


প্রশ্নঃ সত্তাবিষয়ক মতবাদ হিসেবে বহুত্ববাদ ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন কর।
অথবা, সত্তাবিষয়ক মতবাদ হিসেবে বহুত্ববাদ সমালােচনাসহ ব্যাখ্যা কর।

ভূমিকাঃ জগতের সৃষ্টি সম্পর্কে পরমসত্তার অস্তিত্ব নিয়ে বিভিন্ন দার্শনিক, বিভিন্ন তর্কবিতর্ক ও সমালােচনার সম্মুখীন হয়েছেন। ফলে সৃষ্টি হয়েছে সত্তাসম্পৰ্কীয় বিভিন্ন মতবাদ। কারাে কারাে মতে, পরমসত্তা সংখ্যায় এক, এদেরকে বলা হয় একত্ববাদী; কারাে কারাে মতে, পরমসত্তা সংখ্যায় দুই, এদেরকে বলা হয় দ্বৈতবাদী। আর কারাে কারাে মতে, পরমসত্তা সংখ্যায় বহু, এদেরকে বলা হয় বহুত্ববাদী। নিম্নে বহুত্ববাদ ও দ্বৈতবাদ আলােচনা করা হলাে-

বহুত্ববাদঃ বহুত্ববাদের প্রধান যুক্তি এই যে, এ বিশ্বজগৎবিভিন্ন ধরনের উপাদানে পরিপূর্ণ। এসব উপাদান স্বতন্ত্র এবং এক থেকে অন্যতে বিচ্ছিন্ন। পরিদৃশ্যমান জগৎ বৈচিত্র্যে ভরা। এ বৈচিত্র্যই প্রমাণ করে যে, এই পরিদৃশ্যমান জগতের পিছনে অসংখ্য সত্তা রয়েছে। এই বৈচিত্র্যময় বিশ্বের সন্ধান এক বা দু’য়ের মাঝে পাওয়া যায় না, এর সন্ধান মিলে একমাত্র বহুর মাঝে কেবল জড়বস্তু বা আত্মার মধ্যে এই বৈচিত্র্যময় বিশ্বজগতের প্রকৃত স্বরূপ বা মূল উপাদান খুজে পাওয়া দুষ্কর। বহুত্ববাদের সারকথা এই যে, এই বিশ্বজগৎ বহু মূল উপাদান বা সত্তার সংযােগের ফলে গঠিত। সাধারণত বহুত্ববাদের প্রথম সবিশেষ আলােচনা দেখতে পাওয়া যায় প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক এম্পিডলিসের দর্শনে। তিনিই তার দর্শনে পারমেনাইডিসের একক সত্তাকে আগুন, পানি, মাটি ও বায় নামে চারটি মূল উপাদানে বিভক্ত করেন। তার মতে, এই চারটি মূল উপাদানের সমন্বয়ে যাবতীয় বস্তুর সষ্টি। পরমাণবাদীদের ও অ্যানাক্সাগােরাসের দর্শনও বহুত্ববাদের কথা বলে।

(ক) জড়াত্মক বহুত্ববাদঃ গ্রিক দার্শনিক এম্পিডক্লিস এ মতবাদের সূচনা করে বলেন, আগুন, পানি, মাটি ও বায়ু এ চারটি মূল উপাদানের সমন্বয়ে জগতের সবকিছু সষ্টি। তারপর ডেমােক্রিটাস প্রবর্তন করেন জড় পরমাণুবাদ। কোনাে দ্রব্যকে ক্রমাগত বিভক্ত করা হলে শেষ পর্যন্ত যেসব অবিভাজ্য সূক্ষ্মকণা পাওয়া যায় তাকে পরমাণু বলে। পরমাণুগুলাে বহুলাংশে বিক্ষিপ্ত ও ঘূর্ণায়মান অবস্থায় ছিল এবং তারপর তাদের আকস্মিক সংযােগ ও বিয়ােগের ফলে এই জড় জগতের উৎপত্তি হয়। জড় পরমাণু থেকে কোন জীবদেহ ও প্রাণের অবির্ভাব ঘটেছে এবং জীবদেহের স্নায়কেন্দ্র ও মস্তিষ্ক থেকে মন বা চেতনার উৎপত্তি হয়েছে। এ মতানুযায়ী পরের কল্পনা ছাড়াই পরমাণুর আকস্মিক সংযােগ ও বিয়ােগের সাহায্যে জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়কে ব্যাখ্যা করা হয়।

(খ) আধ্যাত্মিক বহুত্ববাদঃ এই মতবাদের প্রবর্তক লাইবনিজ বলেন, মােনাড বা চিৎপরমাণ হচ্ছে জগতের আদিম উপাদান। মােনাড হলাে মূর্ত, বিস্তৃতিহীন, স্বতন্ত্র ও গবাক্ষহীন আধ্যাত্মিক বিন্দু, যা গাণিতিক বিন্দু ও জড়বিন্দু থেকে ভিন্ন। এটি অবিভাজ্য, স্বনির্ভর, আত্মকেন্দ্রিক, চেতনসক্রিয় এবং সংখ্যায় অগণিত। এরা পরস্পরের ওপর প্রভাব বিস্তার বা ক্রিয়া করে না।

(গ) প্রয়ােগবাদী বহুত্ববাদঃ এ মতবাদের প্রবর্তক উইলিয়াম জেমস বলেন, এ জগৎ স্বাধীনতাহীন ও বিেচত্র্যহানি নয় বরং বহু স্বতন্ত্র বস্তুর সমষ্টি। এই বিচিত্র ও অভিনব জগৎ ঈশ্বরের প্রকাশ নয়। এর স্বাধীন অস্তিত্ব আছে এবং বস্তুসমূহের বহুরূপ স্বাতন্ত্র, স্বনির্ভরতা, বিচ্ছিন্নতা, বিশৃঙ্খলা, অভিনবত্ব, স্বাধীনতা ও বৈচিত্র্য এসবই সত্য। প্রকৃতপক্ষে এ জগৎ এক নয়, বহু।

(ঘ) নব্য বস্তুবাদী বহুত্ববাদঃ নব্য বস্তুবাদীদের মতে, জগতের যেমন বহুবস্তু আছে তেমনি বহুমনও আছে। এ জগৎ এক আঙ্গিক ঐক্য নয় বরং বহু বস্তুর সমষ্টি। এদের সম্পর্ক বাহ্যিক; অভ্যন্তরীণ নয়। সত্তার স্তরভেদ আছে, জড় নিম্নস্তর, প্রাণ উচ্চস্তর এবং মন উচ্চতম স্তর। জড় থেকে প্রাণ এবং প্রাণ থেকে মনের উন্মেষ ঘটে।

বহুত্ববাদের সমালােচনাঃ বহুত্ববাদের বিরুদ্ধে সমালােচকরা বিভিন্ন আপত্তি উত্থাপন করেছেন। নিচে এগুলাে আলােচনা করা হলাে-

(ক) জড়াত্মক বহুত্ববাদ অযৌক্তিকঃ জড়াত্মক বহুত্ববাদীদের মতে পরমাণুগুলাের পারস্পরিক আকর্ষণ ও বিকর্ষণ, সংযােগ ও বিয়ােগ, মিলন ও বিচ্ছেদ সম্পূর্ণ আকস্মিক। কিন্তু প্রশ্ন হলাে অচেতন জড় পরমাণুগুলাে কী করে আকস্মিকভাবে সুশৃঙ্খল পরিদৃশ্যমান জগতের সৃষ্টি করতে পারে, তা বােঝা দুষ্কর।

(খ) প্রয়ােগবাদী বহুত্ববাদঃ আত্মবিরােধপূর্ণ লাইবনিজ তার চিৎপরমাণুবাদে বলেছেন, স্বরূপগতভাবে। চিৎপরমাণুগুলাে এমন যে, এদের একটি কখনও অন্যটির ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। তাহলে চিৎপরমাণগুলাের চিৎপরমাণ হিসেবে ঈশ্বর কীভাবে অন্য চিৎপরমাণুকে প্রভাবিত করতে পারেন তা আমাদের কাছে বােধগম্য নয়। এদিক থেকে লাইবনিজের এ মতকে আত্মবিরােধপূর্ণ মতবাদ বলা যায়।

(গ) প্রয়ােগবাদী বহুত্ববাদ বিশৃঙ্খলাপূর্ণঃ জেমস তার প্রয়ােগবাদী বহুতুবাদে এই পরিদৃশ্যমান জগতকে সম্পূর্ণ স্বাধীন বলে চিত্রিত করেছেন। তার মতে, বিশ্বজগৎ স্বাধীন; ঈশ্বর ও ব্যক্তি মননিরপেক্ষ। আর এর ফলে জগতকে তিনি এক বিশৃঙ্খলার রাজত্বে ঠেলে দিয়েছেন।

(ঘ) নব্য বাস্তববাদীদের বহুত্ববাদ অস্পষ্টঃ নব্য বাস্তববাদীরা এ জগৎকে পরস্পর বিচ্ছিন্ন ও স্বতন্ত্র বস্তুসমূহের সমাহার বলে মনে করেন। কিন্তু তা ঠিক নয়। জগৎ বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন ও স্বতন্ত্র বস্তুর সমস্টি হতে পারে না। জাগতিক বস্তসমূহের মধ্যে একটি ঐক্য ও শৃঙ্খলা বিদ্যমান। তা ছাড়া নব্য বাস্তববাদীরা নিরপেক্ষ সত্তা ও বিদ্যমানতা বলতে কি বুঝাতে চেয়েছেন তা স্পষ্ট নয়। অতএব দেখা যায় যে, বহুত্ববাদ একত্ববাদের বিরুদ্ধে একটি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। কিন্তু এটা চরম মতবাদ সুতরাং আমরা এ মতবাদকে গ্রহণ করতে পারি না।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, দর্শনে আলােচিত কোনাে মতবাদই সমালােচনার উর্ধ্বে নয়। অর্থাৎ কোনাে মতবাদই সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত নয়। সেই হিসেবে বহুত্ববাদেরও যথেষ্ট সমালােচনা রয়েছে। তা ছাড়া সত্তাবিষয়ক মতবাদ হিসেবে বহুত্ববাদ মােটেই সন্তোষজনক মতবাদ নয়। কারণ এই মতবাদ বিভিন্ন যৌক্তিক দোষে দুষ্ট। তবুও দর্শনের ইতিহাসে এ মতবাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক