অথবা, সত্তা বিষয়ক মতবাদ হিসেবে একত্ববাদ, বহুত্ববাদ ও দ্বৈতবাদের একটি বিশ্লেষণমূলক ব্যাখ্যা দাও।
অথবা, সত্তা সম্পর্কিত মতবাদ হিসেবে একত্ববাদ ও বহুত্ববাদ আলােচনা কর।
ভূমিকাঃ বিশ্ব তত্ত্বের নানা প্রশ্ন নিয়ে আবহমান কাল থেকে দার্শনিকদের মধ্যে নানা বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। কেউ কেউ বলেন, এক নয়, দুই সত্তা থেকেই এ জগতের সৃষ্টি। আবার কেউ বা বলেন, বহু সত্তা থেকে বিশ্বজগতের যাবতীয় বস্তু সৃষ্টি হয়েছে। অতএব, আমরা সত্তার সংখ্যাসম্পর্কিত তিনটি মতবাদ পাই- ১. একত্ববাদ, ২. দ্বৈতবাদ ও ৩. বহুত্ববাদ।
(১) একত্ববাদ বা অদ্বৈতবাদঃ একত্ববাদ অনুযায়ী, বিশ্বজগতের আদিসত্তা একটি; দুই বা বহু নয়। বিশ্বের সবকিছুই একটিমাত্র মৌলিক সত্তা থেকে উৎপত্তি হয়েছে। এই বৈচিত্র্যপূর্ণ জগৎ বিচ্ছিন্ন ও স্বতন্ত্র সত্তার বিশৃঙ্খল স্তুপ নয়, কিংবা দুটি ভিন্নধর্মী উপাদানের সমন্বয়ও নয়, বরং তা একই পরমসত্তার বিচিত্র প্রকাশ। সমগ্র বিশ্বজগৎ একটি আঙ্গিক ঐক্য, জড় ও মন একই ঐক্যের বিভিন্ন প্রকাশ। অর্থাৎ এক হচ্ছে সত্তা আর বহুরূপী এই বিচিত্র বিশ্ব হচ্ছে এক পরমসত্তার অবসিক রূপ। এমনি করে, একত্ববাদ একই সঙ্গে বহুত্ববাদ ও দ্বৈতবাদের অসারতা প্রমাণ করে এবং এক পরমসত্তার অস্তিত্ব প্রমাণ করে। একত্ববাদের দুটি রূপ- ১. অমূর্ত একত্ববাদ; ও ২. মূর্ত একত্ববাদ।
(ক) অমূর্ত একত্ববাদঃ এই মতবাদ অনুযায়ী, এক পরমসত্তাই সত্য; জগতের বহুত্ব বা বৈচিত্র্য মিথ্যা। স্পিনােজার মতে, শুধুমাত্র এক পরমসত্তাই সত্য, একমাত্র ঈশ্বরই পরমসত্তা। ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়, অনন্ত ও অসীম। তিনিই একমাত্র দ্রব্য যা স্বনির্ভর, যার অস্তিত্ব অন্য কিছুর ওপর নির্ভরশীল নয় এবং যাকে নির্ণয় করা যায় না। বৈচিত্র্যময় জগৎ মিথ্যা, এটা ঈশ্বর বা পরমসত্তার অবভাস মাত্র। জগৎ আর পরমসত্তা অভিন্ন; জগই পরমসত্তা এবং পরমসত্তাই জগৎ | ঈশ্বরের অসংখ্য গুণের মধ্যে আমরা কেবল দু'টিকে জানি। গুণ দু’টো হচ্ছে বিস্তৃতি ও চেতনা। এরা দু’টি সমান্তরাল গুণ। বৈচিত্র্যময় জগতের সব বস্তুই বিস্তৃতি ও চেতনার প্রকাশ। একমাত্র ঈশ্বরই সব এবং সবই ঈশ্বর, তিনিই সত্য ও স্বনির্ভর। তার বাইরে কিছু নেই, তিনি ব্যতীত কিছুই সত্য নয়। এ মতবাদ সর্বেশ্বরবাদ নামেও পরিচিত। অনুরূপভাবে শংকর বলেন, ব্ৰহ্ম বা পরমাত্মাই একমাত্র পরমসত্তা । জগৎ মায়া ও মিথ্যা। জীব ও ব্রহ্ম অভিন্ন। ব্রহ্ম মায়া থেকেই এই জগৎ সৃষ্টি করেছে এবং মায়াতেই তার পরিণতি।
(খ) মূর্ত একত্ববাদঃ দার্শনিক হেগেলের মতে, জগতের পেছনে এক পরমসত্তা আছে এবং এই বৈচিত্র্যপূর্ণ জগৎ তারই মূর্ত প্রকাশ। পরমসত্তা বহুর মাঝে নিজেকে প্রকাশ করে। পরমাত্মা বা ঈশ্বরই একমাত্র সত্তা এবং জগতের সবকিছু ঈশ্বরেরই অনিবার্য অংশ। জগৎ মিথ্যা বা অলীক নয়, ঈশ্বর ও জগৎ উভয়ই সত্য। জগৎ ছাড়া পরমসত্তা এবং পরমসত্তা ছাড়া জগৎ অর্থহীন। জড় ও জীবজগৎ এক পরমসত্তা থেকেই উদ্ভূত। পরমসত্তা হচ্ছে বিভেদের মধ্যে ঐক্য, বৈচিত্র্যের মধ্যে সংহতি, বহুর মাঝে এক। সৃষ্টি জগতের স্তরভেদ আছে। উচ্চতম স্তরে আছে মানবাত্মা, মধ্যবর্তী স্তরে জীবাত্মা এবং সর্বনিম্ন স্তরে জড় বস্তু। ঈশ্বর বা পরমাত্মা জগতের ভেতরেও আছেন, বাইরেও আছেন। এই মতবাদ সর্বধরেশ্বরবাদ নামে পরিচিত। অনুরূপভাবে দার্শনিক রামানুজ বলেন, ব্রহ্ম এক ও আদি। কেবল ব্রহ্মই সত্য নয়, জীব ও জগৎও সত্য। জীব ও জগৎ একই ব্রহ্মের অধীন।
খ. একত্ববাদের সমালােচনাঃ সত্তার স্বরূপ সম্পর্কিত একত্ববাদ সন্তোষজনক মনে হলেও এ মতবাদ ত্রুটিমুক্ত নয়। নিচে ত্রুটিগুলাে আলােচনা করা হলাে-
(i) এ মতবাদ অবাস্তবঃ এ মতবাদ এককে বহু হতে বিচ্ছিন্ন করে, অথচ বহুর মধ্য দিয়েই একের প্রকাশ ঘটে থাকে। বৈচিত্র্য ছাড়া ঐক্য অনুধাবনযােগ্য নয়। বৈচিত্র্য ও ঐক্য, এক ও বহু পরস্পর সম্বন্ধযুক্ত। এ ছাড়া এ মতবাদের অনিবার্য পরিণতি সর্বখােদাবাদ বাস্তবকে অবাস্তব বলে উড়িয়ে দেয়।
(ii) এ মত জগৎকে ঈশ্বরের হাতের পুতুলে পরিণত করেঃ হেগেল তার একত্ববাদে কখনও কখনও প্রকৃতিতে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বেশি জোর দেন। কখনও তিনি সসীম জীবাত্মার স্বাধীনতাকে সীমিত করে তােলেন এবং তাদের ঈশ্বরের হাতের পুতুল করে তােলেন। তিনি মানুষ এবং ঈশ্বরের বুদ্ধির দিকের ওপর বেশি জোর দেন। অথচ তিনি তাদের ঐচ্ছিক প্রবৃত্তি ও প্রবণতার দিকে তত জোর দেননি।
(২) দ্বৈতবাদঃ দ্বৈতবাদ অনুসারে সত্তার সংখ্যা এক নয়,দুই। যে মতবাদ দুটি স্বতন্ত্র ও পরস্পরনিরপেক্ষ সত্তাকে বিশ্বজগতের আদি বা মূল উপাদান বলে মনে করে তাকে বলে দ্বৈতবাদ। দ্বৈতবাদীদের মতে, জগৎ এক বা বহু সত্তার সমষ্টি নয়, বরং জগৎ হচ্ছে জড় ও মন, দেহ ও চেতনা নামক পরস্পর নিরপেক্ষ দুটি সত্তার সমাহার। এ দুটি সত্তার একটিকে অপরটিতে রূপান্তর করা যায় না। কেননা, এরা পরস্পর স্বতন্ত্র সত্তা। দ্বৈতবাদের ইতিহাস আলােচনা করলে দেখা যায় যে, প্রধানত দুটি কারণে দ্বৈতবাদ দর্শনের ইতিহাসে একটি সম্মানজনক স্থান অধিকার করে আছে।
এক. লৌকিক দৃষ্টিতে দ্বৈতবাদঃ লৌকিক দৃষ্টিতে দ্বৈতবাদ একটি জনপ্রিয় মতবাদ। কেননা দ্বৈতবাদী দার্শনিকদের মতাে সাধারণ মানুষও জড় ও মনের বিপরীতধর্মী অস্তিত্বে বিশ্বাস করতে অভ্যস্ত।
দুই. ডেকার্টের দ্বৈতবাদঃ আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শনের জনক ডেকার্টের প্রভাবও দ্বৈতবাদকে একটি পাকাপােক্ত স্থানে। অধিষ্ঠিত করতে প্রভূত সহায়ক হয়েছে। এদিক থেকে ডেকার্টকে দ্বৈতবাদের একজন সফল সাধক বলে অভিহিত করা যায়।
সমালােচনা ও মূল্যায়নঃ দ্বৈতবাদ সাধারণ মানুষের কাছে খুব আকর্ষণীয় বলে মনে হলেও দার্শনিক বিচারে একে সার্থক মতবাদ বলা যায় না।
(১) ডেকার্টের দ্বৈতবাদ রহস্যময়ঃ সমালােচকদের মতে, ডেকার্টের মতকে স্বীকার করে নিলে মানুষের মধ্যে দেহ ও মনের সম্বন্ধটি একটি রহস্যময় হেঁয়ালিতে পর্যবসিত হয়ে পড়ে। প্রকৃতপক্ষে ডেকার্টের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াবাদ দেহ ও মনের সম্পর্কের কোন সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারে না।
(২) ডেকার্টের দ্বৈতবাদ জড়বাদঃ ডেকার্ট যে পিনিয়াল গ্রন্থির মাধ্যমে দেহ ও মনের সম্পর্ককে ব্যাখ্যা করেছেন, সেই পিনিয়াল গ্রন্থিও এক ধরনের জড় পদার্থ। হােয়াইটহেড তাই দুঃখ-করে বলেন, ডেকার্টের দ্বৈতবাদ পরবর্তী দার্শনিক চিন্তাধারাকে বিষাক্ত করেছে।
যদিও ডেকার্টের দ্বৈতবাদের বিভিন্ন সমালােচনা রয়েছে, তবুও ডেকার্টের উত্থাপিত এ সমস্যাটি পরবর্তী দার্শনিক চিন্তার রসদ যুগিয়েছে। তার উত্থাপিত এ সমস্যাকে কেন্দ্র করেই পরবর্তীকালে অনেক দার্শনিক আলােচনা লক্ষ্য করা যায়। তাই এর গুরুত্বকে আমরা অস্বীকার করতে পরি না।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, একত্ববাদীরা একটি আদিসত্তায় অবং বহুত্ববাদীরা বহুসত্তায় বিশ্বাসী। এরূপ দু’টি বিরােধী মতবাদের মধ্যে সমন্বয় করেছে দ্বৈতবাদ। দ্বৈতবাদের মতে, জগতের আদিসত্তা দুটি- জড় ও মন। জগতের সব কিছুই দুই শ্রেণিভুক্ত- জড়াত্মক ও মানসিক। বৈচিত্র্যময় জগৎ এই দু'টি ভিন্নধর্মী উপাদান দ্বারা গঠিত।
0 মন্তব্যসমূহ