অথবা, ফিরােজ শাহ তুঘলকের শাসন সংস্কার পর্যালােচনা কর।
উপস্থাপনাঃ সুলতান ফিরােজ শাহ তুঘলকের গৌরবােজ্জ্বল শাসনকাল মধ্যযুগীয় ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক স্মরণীয় অধ্যায়। দিল্লী সালতানাতের এক সংকটময় মুহূর্তে সেনানায়ক ও অভিজাতবর্গের অনুরােধে ১৩৫১ খ্রিস্টাব্দের ২৪ মার্চ তিনি রাজ্যের শাসনভার গ্রহণ করেন। তার পূর্বসূরী মুহাম্মদ বিন তুঘলকের রাজত্বের শেষ দিকে, বিভিন্ন কারণে প্রশাসনিক কাঠামাে শিথিল হয়ে যে অরাজকতা ও অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়, তিনি তা রােধ করে এক জনকল্যাণমুখী প্রশাসন ও সংস্কার পদ্ধতি প্রবর্তন করেন।
ফিরােজ শাহ তুঘলকের সংস্কারসমূহঃ
১. রাজস্ব সংস্কারঃ রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থা সুদৃঢ় করতে সুলতান ফিরােজ শাহ তুঘলক রাজস্ব ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস করেন। তিনি পূর্বের তেইশ প্রকারের কর রহিত করে কুরআনে উল্লিখিত চার প্রকার কর- ১. খারাজ, ২. যাকাত, ৩. জিযিয়া ও ৪. খুমুস ধার্য করেন। তিনি রাষ্ট্রীয়ভাবে যাকাত আদায়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। পূর্ববর্তী শাসকদের আমলে যেসব অবৈধ কর ধার্য করা হয়েছিল, তিনি তা উঠিয়ে দেন। ঐতিহাসিক শামসে সিরাজ আফিফের মতে, সুলতানের রাজস্ব ব্যবস্থা সংস্কারের ফলে করদাতারা সন্তুষ্ট হয়।
২. শুল্ক প্রথা রহিতকরণঃ ফিরােজ শাহ তুঘলক অভ্যন্তরীণ ব্যবসায় বাণিজ্য শিল্পক্ষেত্রে উন্নতি সাধনের জন্য আন্তঃপ্রাদেশিক শুল্ক উঠিয়ে দিয়েছিলেন। এ শুল্ক প্রথা রহিত করার ফলে অন্যরা সুলতানী সাম্রাজ্যের সর্বত্র অবাধ বাণিজ্য পরিচালনার সুবিধা পায়। শিল্প ও বাণিজ্যের অভূতপূর্ব প্রসারে ফিরােজের শুল্ক নীতির সুফল পরিলক্ষিত হয়।
৩. কৃষি সংস্কারঃ কৃষিকার্যে উৎসাহ প্রদানের সুবিধার্থ সুলতান ফিরােজ শাহ তুঘলক বিভিন্ন কর্মপন্থা গ্রহণ করেন। তিনি ১৫০টি কূপ এবং ৪টি খাল খনন করে পানি সেচের ব্যবস্থা করেন। শত-ঘাগরা সেচ খাল, যমুনা সেচ খাল এখনাে তার কষি সংস্কারের সাক্ষ্য বহন করে। এছাড়াও তিনি কৃষি ঋণ প্রদান এবং অন্যান্য সহায়তা দ্বারা কৃষির প্রভূত উন্নতি সাধন করেন।
৪. শিক্ষা সংস্কারঃ ফিরােজ শাহ তুঘলক একজন বিদ্যোৎসাহী শাসক ছিলেন। তিনি জ্ঞান -গুণীদের সমাদর করতেন। প্রজাদের শিক্ষার জন্য তিনি বহু স্কুল, কলেজ ও মাদরাসা স্থাপন করেন এবং তার আমলে বহু আইন, ধর্ম ও ইতিহাস গ্রন্থ রচিত হয়।
৫. জায়গির প্রথা পুনঃপ্রবর্তনঃ সুলতান আলাউদ্দিন খিলজী কর্তৃক বিলুপ্ত জায়গির প্রথার পুনঃ প্রবর্তন করে তিনি উমরাহ ও অভিজাতবর্গের রাষ্ট্রবিরােধী কার্যকলাপ বন্ধকরার প্রয়াস পান। তিনি সমগ্র রাজ্যকে কয়েকটি জায়গিরে বিভক্ত করে উমরাহ ও অভিজাতদের মধ্যে বিতরণ করেন।
৬. সামরিক সংস্কারঃ সুলতান ফিরােজ শাহ তুঘলক সামন্ত প্রথার ভিত্তিতে সামরিক সংগঠন গড়ে তােলেন। তিনি অস্থায়ী সৈন্যদের নগদ বেতন আর স্থায়ী সৈন্যদের জায়গির প্রদান করতেন।
৭. বিচার বিভাগ সংস্কারঃ সুলতান ফিরােজ শাহ তুঘলক বিচার বিভাগেরও সংস্কার সাধন করেন। ইসলামী দণ্ডবিধির বহির্ভূত হস্তপদ ছেদন প্রভৃতি নিষ্ঠুর শাস্তিপ্রথা রহিত করেন। বিচার ব্যবস্থাকে বহুল পরিমাণে উদার ও মানবােচিত করেন। নিছক রাজনৈতিক প্রতিশােধ কিংবা প্রতিহিংসা পরায়ণবশত কারাে নাক, কান কর্তনকে নিষেধ করেন। অবশ্য অপরাধী উৎসাহী হয়ে অধিক অপরাধপ্রবণ হতে পারে এমন প্রশ্রয়ও তার শাসননীতিতে ছিল না। অর্থাৎ তার শাসনকালে অত্যন্ত সুদঢ় নীতির ওপর ভিত্তি করে সাম্রাজ্যে বিচারকার্য পরিচালিত হতাে।
৮. ধর্মীয় সংস্কারঃ ফিরােজ শাহ শরীয়ত মােতাবেক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তােলেন এবং ইসলামী আইন চালু করেন। তিনি সর্বপ্রথম বিধর্মীদের প্রতি জিযিয়া এবং মুসলমানদের ওপর যাকাত বাধ্যতামূলক করেন। পাশাপাশি অন্যান্য ধর্মের প্রতিও তিনি। যথেষ্ট উদারতা প্রদর্শন করেন।
৯. রাজধানী স্থানান্তরঃ নগর সংস্কার ও সুলতান ফিরােজ শাহ দিল্লীর উপকণ্ঠে নতুন রাজধানী স্থাপন করে এর নতুন নাম রাখেন ফিরােজাবাদ। এছাড়া তিনি তুঘলক রীতিতে বহু শহর, মসজিদ, প্রাসাদ, সরাইখানা, পুষ্করিণী, সমাধিস্তম্ভ, হাম্মামখানা, স্মৃতিস্তম্ভ, সেতু ইত্যাদি নির্মাণ করেন। দিল্লীর উপকণ্ঠে তিনি বারােশ বাগান নির্মাণ করেছিলেন।
১০. মুদ্রা সংস্কারঃ মুদ্রা সংস্কার সুলতান ফিরােজ শাহ তুঘলকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব। তিনি অল্প মানের ও সহজে বিনিময়যােগ্য মুদ্রা প্রবর্তন এবং রৌপ্য ও তাম মিশ্রিত মুদ্রার প্রচলন করেন। ভারত উপমহাদেশে সিকি ও আধুলি নামক খণ্ড মুদ্রার প্রচলন তারই কীর্তি।
১১. শিল্প সংস্কারঃ সুলতান শিল্প সংস্থাকে সরকারি বেসরকারি এ দু’ভাগে বিভক্ত করে প্রয়ােজনে বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠানকে ঋণদানের ব্যবস্থা করেন।
১২. চিকিৎসা সংস্কারঃ সুলতান দেশের বিভিন্ন অংশে বহু চিকিৎসালয় এবং দিল্লীতে দিওয়ানে শেফা নামে একটি হাসপাতাল স্থাপন করেন। সুদক্ষ চিকিৎসকগণ এখানে রােগীদের চিকিৎসা করতেন। রাষ্ট্রীয় খরচে রােগীদের ওষুধ পথ্যাদি সরবরাহ করা হতাে।
১৩. জনকল্যাণকর ব্যবস্থা প্রবর্তনঃ জনসাধারণের মঙ্গলার্থ ফিরােজ শাহ তুঘলক কয়েকটি আলাদা বিভাগ প্রতিষ্ঠার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন এবং বিভাগগুলাের অধীনে একেকটি দপ্তর স্থাপন করেন। যেমন- বিবাহ দপ্তর, চাকরি দপ্তর। বেকার সমস্যা সমাধানে তিনি চাকরি দপ্তর এবং বিধবা ও দরিদ্র কুমারী মেয়েদের বিবাহের জন্য বিবাহ দপ্তর প্রতিষ্ঠা করেন।
উপসংহারঃ সুশাসক হিসেবে জনপ্রিয়তা ও খ্যাতির শীর্ষে অবস্থানকারী ফিরােজ শাহ তুঘলককে ঐতিহাসিক বারানী ও শামসে সিরাজ ন্যায়ানুগ, দয়ালু, জনকল্যাণকামী এবং ধর্মপ্রাণ শাসক হিসেবে আখ্যায়িত করেন। বস্তুত তিনি ছিলেন মানবতাবাদী, প্রজাহিতৈষী, ধর্মপ্রাণ ও সত্যনিষ্ঠ শাসক। সুশাসন ও আদর্শ শাসন সংস্কার তাকে খ্যাতির শীর্ষে সমাসীন করেছে। ঐতিহাসিক উইলস হেগ বলেন- The reign of Firoz closes the most brilliant epoch of Muslim rule in India before the reign of Akbar.
0 মন্তব্যসমূহ