প্রশ্নঃ প্লেটো ও এরিস্টটলের রাজনৈতিক দর্শনের একটি তুলনামূলক আলােচনা কর। কাকে অধিক বাস্তববাদী বলে মনে কর এবং কেন?
অথবা, প্লেটো এবং এরিস্টটলের রাজনৈতিক দর্শন ছিল ভিন্নতর প্লেটো ছিলেন একজন কল্পনা বিলাসী দার্শনিক এবং এরিস্টটল ছিলেন বাস্তববাদী। তুমি কী এই বক্তব্যের সাথে একমত?
ভূমিকাঃ ভূ-মধ্যসাগরীয় অঞ্চলের নাতিশীতােষ্ণ আবহাওয়াতে প্রায় তিন হাজার বছর পূর্বে বর্তমান কালের রাজনৈতিক দর্শনের সমগ্র অনুভূতিগুলি জন্মগ্রহণ করেছিল। আর যে সমস্ত জ্ঞানকুল শিরােমণিদের স্পশে এই দৃর্শন চিন্তার জগত সমৃদ্ধ ও বিকশিত হয়েছিল, যাদের স্পর্শে তা বিশ্বব্যাপী বিস্তার লাভ করেছিল এবং যারা রাষ্ট্রচিন্তাকে একটা মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছেন, তাদের মধ্যে প্লেটো এবং তারই শিষ্য এরিস্টটল অন্যতম।
প্লেটো ও এরিস্টটলের পার্থক্যঃ প্লেটো ও এরিস্টটলের চিন্তাধারার পার্থক্য আলােচনা করার পূর্বে এই পার্থক্যের কারণ সম্পর্কে কিছু বলা প্রয়ােজন।
(১) প্লেটো কল্পনা বিলাসী এরিস্টটল বাস্তববাদীঃ প্লেটো অবরােহ পদ্ধতির অনুসারী। তাই তার মতবাদ সম্পূর্ণভাবে কল্পনাভিত্তিক। কল্পনার সাহায্যে তিনি আদর্শ রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছেন। বাস্তবে যার কোনাে ভিত্তি ছিল না। অপরপক্ষে এরিস্টটল আরােহ পদ্ধতিতে বিশ্বাসী। সুতরাং তার মতবাদ বাস্তবধর্মী।
(২) ভিন্ন আলােচনা পদ্ধতিঃ প্লেটোর পদ্ধতি ছিল অবরােহ। আর এরিস্টটলের পদ্ধতি ছিল আরােহ। বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রে এই আরােহ পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। কাজেই এরিস্টটলের পদ্ধতিকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিও বলা হয়। প্লেটোর পদ্ধতি অবরােহ বলে একে কাল্পনিক বলে অভিহিত করা হয়।
(৩) ভিন্ন শাসন ব্যবস্থাঃ প্লেটো তার 'The Republic' গ্রন্থে শাসনের চূড়ান্ত ক্ষমতা ন্যস্ত করেছেন দার্শনিক রাজার হাতে। তার মতে, প্রকৃত দার্শনিকের সদগুণ অন্য সকলের সদগুণ অপেক্ষা শ্রেয় এবং অভিজ্ঞতা অপেক্ষা প্রজ্ঞা শ্রেয়। অন্যদিকে এরিস্টটলের বিশ্বাস যে, ব্যক্তি বিশেষের বা ব্যক্তি সংস্থার সদগুণ যত বেশীই হােক না কেন আইনের শাসন ছাড়া তা স্বেচ্ছাচারিতায় পরিণত না হয়ে পারে না। এই কারণে তিনি ব্যক্তির হাতে সার্বভৌম ক্ষমতা ন্যস্ত না করে তা ন্যস্ত করেছেন আইনের হাতে।
(৪) পরিবার তত্ত্বঃ প্লেটোর মতে, সৎ ও ন্যায়পরায়ণ, সুখী ও সুন্দর জীবনযাপন করার জন্য পরিবারের কোনাে প্রয়ােজন নেই। কিন্তু এরিস্টটল এই মতের বিরােধিতা করে বলেন যে, পরিবার মানুষের জৈবিক ও অর্থনৈতিক প্রয়ােজনের স্বাভাবিক ফলশ্রুতি। যৌন ক্ষুধা, আত্মসংরক্ষণ ও আত্মপ্রবৃত্তি, মানুষের স্বাভাবিক ও সহজাত প্রবৃত্তি এবং এই প্রবৃত্তির সন্তোষজনক সমাধানই মানুষকে পরিবার গঠনে পরিচালিত করে।
(৫) সম্পত্তি সম্পর্কে মতের পার্থক্যঃ প্লেটো তার সাম্যবাদ নীতিতে সম্পত্তি উচ্ছেদের যে প্রস্তাব করছেন। এরিস্টটলের মতে তা ভ্রান্ত ও যুক্তিহীন। তিনি বলেন, সম্পত্তি ব্যতিত মানুষের পক্ষে জীবনধারণ করা সম্ভবপর নয়। ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য মানুষের যেমন অন্নের প্রয়ােজন, তেমনি আশ্রয়ের জন্য প্রয়ােজন বাসস্থান এবং প্রকৃতির হাত হতে নিজেকে রক্ষা করার জন্য বস্ত্রের প্রয়ােজন। কিন্তু সম্পত্তি ব্যতীত এই সব প্রয়ােজন মেটানাে সম্ভবপর নয়।
(৬) দাসপ্রথা সম্পর্কঃ এরিস্টটল দার্সপ্রথাকে ন্যায় ও যুক্তি সঙ্গত বলেছেন। তিনি বলেন প্রভুর সুখী ও আরামদায়ক জীবনের জন্য দাসপ্রথা অপরিহার্য। কিন্তু প্লেটো এ সম্পর্কে কিছুই বলেননি।
সাদশ্যঃ উপযুক্ত আলােচনার আলােকে বলা যায় যে, প্লেটো ও এরিস্টটলের বৈসাদৃশ্যের মধ্যেই তাদের তুলনামূলক আলােচনা সীমাবদ্ধ নয়। তাদের তুলনামূলক আলােচনাকে আরও পরিশুদ্ধ করতে হলে তাদের মধ্যকার সাদৃশ্যসমূহ আলােচনা করা প্রয়ােজন।
(১) মানব সমাজ প্লেটোঃ এরিস্টটলের মধ্যে প্রথম ও প্রধান সাদৃশ্য হলাে উভয়ই মানব সমাজ সম্পর্কে একই ধারণা পােষণ করেছেন। উভয় দার্শনিক মনে করতেন মানুষ সামাজিক জীব এবং সমাজেই তাকে বাস করতে হবে। নগর রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে তারা উভয়েই তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করেন।
(২) শিক্ষাঃ শিক্ষা সম্পর্কে তারা উভয়েই একরকম বক্তব্য পেশ করেন। নাগরিকদের চরিত্র গঠনের এবং মানুষের মানবিক গুণাবলী বিকাশের জন্য তারা উভয়েই শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। সাথে সাথে তারা রাষ্ট্রীয় শিক্ষাকে চিহ্নিত করেছেন। তাদের মতে রাষ্ট্রীয় শিক্ষাব্যবস্থা হবে রাষ্ট্রীয় উন্নয়নমুখী।
(৩) নাগরিকতাঃ নাগরিক সম্পর্কে প্লেটো এবং এরিস্টটল উভয়েই উচ্চ মনােভাবের পরিচয় দিয়ে রাষ্ট্রের নিম্ন শ্রেণীর জনসাধারণের প্রতি অবজ্ঞা দেখিয়েছেন। রাষ্ট্রের নিম্নশ্রেণীর লােকদেরকে তারা কেউ নাগরিকত্ব দিতে চাননি। তাদের মতে রাষ্ট্রের নাগরিক হবে উচ্চশ্রেণীর লােকেরা।
(৪) সরকারের শ্রেণীঃ সরকারের শ্রেণীবিভাগ সম্পর্কে উভয়ের মধ্যে সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। রাষ্ট্রের ঐক্যের ওপর উভয় দার্শনিকই সবিশেষ গুরুত্ব আরােপ করেন। প্লেটো এবং এরিস্টটল উভয়ই গণতন্ত্রের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করেন। তারা মিশ্র সরকারকে ‘Best' সরকার বলে অভিহিত করেন।
এরিস্টটল ছিলেন বাস্তববাদীঃ প্লেটো ও এরিস্টটলের রাষ্ট্রদর্শনের তুলনামূলক আলােচনা থেকে আমার মনে হয় এরিস্টটলই বাস্তববাদী। এরিস্টটল যে একজন বাস্তববাদী দার্শনিক ছিলেন তার অনুসৃত পদ্ধতিসমূহের মধ্যে তা বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। এরিস্টটলের রাষ্ট্রচিন্তার বিশ্লেষণে কল্পনার প্রভাব সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত না থাকলেও নিছক কল্পনার ভিত্তিতে তিনি কোনাে সিদ্ধান্ত গ্রহণে পক্ষপাতি ছিলেন না। বস্তুত তার মূলগ্রন্থ ‘পলিটিক্স’ একশত আটান্নটি দেশের শাসনব্যবস্থার পর্যালােচনা লব্ধ অভিজ্ঞতার ফসল। অপরদিকে প্লেটো ছিলেন কল্পনাপ্রবণ ও সংশ্লেষণবাদী। তার যুক্তি বিশ্লেষণের পদ্ধতি ছিল অবরােহ প্রকৃতির। তিনি তার যুক্তিগুলােকে সাধারণত রূপক ও উপমার মাধ্যমে প্রকাশ করার চেষ্টা করেন। উপযুক্ত আলােচনা থেকে বলা যায় যে, প্লেটো অপেক্ষা এরিস্টটল ছিলেন অধিকতর বাস্তববাদী।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, প্লেটো ও এরিস্টটলের মধ্যে উপযুক্ত রাজনৈতিক চিন্তাধারার ক্ষেত্রে পার্থক্য থাকা সত্তেও উভয়ের মধ্যে কোন কোন ক্ষেত্রে সাদৃশ্য আছে। প্লেটোর সাথে একমত হয়ে এরিস্টটল রাষ্ট্রকে একটি স্বাভাবিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে বর্ণনা করেছেন। প্লেটোর মতাে এরিস্টটলও শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারােপ করেছেন। সর্বোপরি গ্রীসের নগর রাষ্ট্রগুলাের দুরবস্থা। তাদেরকে এত শংকিত করেছিল যে ঐ রাষ্ট্রগুলােতে স্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে তারা সচেষ্ট হয়েছিলেন। তারা উভয়েই বিশ্বাস করতেন যে, মানুষের কল্যাণ ও উন্নততর জীবনের লক্ষ্যে রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছে এবং তা অব্যাহত থাকবে।
0 মন্তব্যসমূহ