অথবা, বাংলাদেশে নাগরিক অধিকার অর্জনে বাস্তব বাধাসমূহ বর্ণনা কর।
অথবা, বাংলাদেশে অধিকার অর্জনের বাধাসমূহ দূরীকরণের উপায়সমূহ আলােচনা কর।
ভূমিকাঃ অধিকার কথাটি মানবসমাজের সামাজিক চেতনাবােধ থেকে উদ্বুদ্ধ। অধিকারের শাব্দিক অর্থ দাবি। মানুষ যেহেতু সমাজবদ্ধ জীব, সেহেতু সমাজের কাছে তার অনেক কিছু চাওয়া-পাওয়ার আছে। আর এ চাওয়া-পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতেই অধিকারের জন্ম। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের সংবিধানে নাগরিক অধিকারের উল্লেখ আছে এবং সেগুলাে কার্যকর করার বিধান রয়েছে।
নাগরিক অধিকার অর্জনে বাধাসমূহঃ বাংলাদেশের নাগরিকদের নাগরিক অধিকার অর্জনে বাধাসমূহ নিমে আলােচনা করা হলাে-
(১) আইনের শাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অভাবঃ বাংলাদেশে কাগজে কলমে আইন রয়েছে, সংবিধানে রয়েছে এবং তাতে নাগরিক অধিকারও উল্লেখ আছে। কিন্তু এগুলাের বাস্তব প্রয়ােগ নেই বললেই চলে। অনেকক্ষেত্রেই বিচার বিভাগের স্বাধীনতাও খর্ব করা হয়। ফলে নাগরিক অধিকার খর্ব হয়।
(২) নাগরিক সচেতনতার অভাবঃ বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে নাগরিক সচেতনতার অভাব রয়েছে। তারা তাদের অধিকার ও কর্তব্য ভােগের ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে।
(৩) শিক্ষার অভাব ও অজ্ঞতাঃ বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ এখন নিরক্ষর। ফলে তারা নাগরিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন নয়। তাই অজ্ঞতার কারণে বাংলাদেশের মানুষ নাগরিক অধিকার ভােগ করতে পারে না।
(৪) মানবাধিকার রক্ষা সংগঠনের অভাব ও দুর্বলতাঃ নাগরিক অধিকার রক্ষার জন্য পশ্চিমা দেশগুলাের মতাে আমাদের দেশে পর্যাপ্ত ও সুসংগঠিত মানবাধিকার সংস্থা নেই। ফলে বাংলাদেশের নাগরিকরা অধিকার ভােগে বাধাপ্রাপ্ত হয়।
(৫) প্রচারমাধ্যমে নিরপেক্ষতার অভাবঃ বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল সবসময় প্রচারমাধ্যমের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে। সরকারের হস্তক্ষেপের ফলে নাগরিক অধিকার বিঘ্নিত হলে সে সম্পর্কে আলােচনার বিশেষ সুযােগ থাকে না।
(৬) পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা ও বাড়াবাড়িঃ মানবাধিকার রক্ষায় পুলিশের ভূমিকা অনেকটা নিষ্ক্রিয়। আবার কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে পুলিশ সাধারণ মানুষকে হয়রানি করে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের ফলেও পুলিশ অনেক সময় যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারে না।
(৭) ক্ষমতাসীন দলের হস্তক্ষেপঃ বাংলাদেশে যে দলই ক্ষমতায় যায়, তারাই অনেক সময় বিশেষ আইন-কানুন পাস করে নাগরিক অধিকার ভােগে বাধা সৃষ্টি করে থাকে। তাই ক্ষমতাসীন দলের হস্তক্ষেপের ফলে নাগরিক অধিকার সংকুচিত হয়ে পড়ে।
নাগরিক অধিকার অর্জনে বাধা দূর করার উপায়ঃ বাংলাদেশে নাগরিক অধিকার ভােগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের বাধা বা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। বাংলাদেশে নাগরিক অধিকার অর্জন নিশ্চিত করতে হলে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলাে গ্রহণ করতে হবে।
(১) নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধিঃ বাংলাদেশের মানুষের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে তাদের সচেতন করে তুলতে হবে। এজন্য আলােচনা অনুষ্ঠান ও সভা-সমিতির আয়ােজন করতে হবে।
(২) শিক্ষার প্রসারঃ বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ নিরক্ষর ও অজ্ঞ। তাই গণশিক্ষার মাধ্যমে নাগরিকদের শিক্ষিত করে অধিকার সচেতন করে তুলতে হবে।
(৩) স্বাধীন ও নিরপেক্ষ প্রচারমাধ্যমঃ বাংলাদেশের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য রেডিও-টেলিভিশনকে স্বায়ত্ত শাসন দিতে হবে এবং এগুলাের ওপর সরকারি হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতাও নিশ্চিত করতে হবে।
(৪) মানবাধিকার সংগঠনকে শক্তিশালী করাঃ বাংলাদেশে প্রায়ই মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়। অথচ এগুলাে তুলে ধরার জন্য শক্তিশালী মানবাধিকার সংগঠন নেই। তাই নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য শক্তিশালী মানবাধিকার সংগঠন গড়ে তুলতে হবে।
(৫) রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধকরণঃ সংবিধানে এমন বিধান থাকতে হবে যাতে নাগরিক অধিকারের ওপর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ না হয়। তাহলে রাজনৈতিকভাবে নাগরিক/জনগণের অধিকার ভােগে বাধা সষ্টি হবে না।
(৬) স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থাঃ বাংলাদেশে নাগরিক অধিকার অর্জনের জন্য বিচারবিভাগকে পৃথকীকরণের মাধ্যমে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে এবং সৎ ও দক্ষ বিচারক নিয়ােগ করতে হবে।
(৭) পুলিশের তৎপরতা বৃদ্ধিঃ পুলিশ বাহিনীকে ঢেলে সাজাতে হবে যাতে তারা স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে। যােগাযােগ ও অন্যান্য ব্যাপারে পুলিশ বাহিনীকে আধুনিক সরঞ্জাম ও সুযােগ-সুবিধা প্রদান করতে হবে।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশের সংবিধানে পর্যাপ্ত নাগরিক অধিকার থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন কারণে নাগরিক অধিকার বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। তাই নাগরিক অধিকার ভােগ নিশ্চিত করার জন্য ওপরে উল্লিখিত সুপারিশগুলাে বাস্তবায়ন করতে হবে। তাহলে বাংলাদেশের নাগরিক অধিকার ভােগ করা সম্ভবপর হবে।
0 মন্তব্যসমূহ