'প্রত্যেক রাষ্ট্রই প্রদত্ত অধিকারসমূহের দ্বারা পরিচিতি লাভ করে'- লাস্কির উক্তিটি আলােচনা কর


প্রশ্নঃ 'প্রত্যেক রাষ্ট্রই প্রদত্ত অধিকারসমূহের দ্বারা পরিচিতি লাভ করে'- লাস্কির উক্তিটি আলােচনা কর। 
অথবা, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে একজন নাগরিক কী কী অধিকার ভােগ করে?

ভূমিকাঃ আধুনিক রাষ্ট্রের মূল্যায়ন নির্ধারিত হয়ে থাকে এর নাগরিকদের প্রদত্ত অধিকারের মাধ্যমে। Prof. H. J. Laski তাই যথার্থই বলেছেন, "Every state is known by the rights that it maintains." (অর্থাৎ প্রত্যেক রাষ্ট্রই প্রদত্ত অধিকার দ্বারা পরিচিতি লাভ করে। মানুষ সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীব। সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যেই মানুষের জন্ম, মৃত্যু, বৃদ্ধি ও বিকাশ সাধিত হয়। সমাজ ও রাষ্ট্রের বাইরে মানুষ সুন্দর জীবনযাপন করতে পারে না। সমাজ ও রাষ্ট্রের সদস্য হিসাবে তারা কতগুলাে অধিকার ভােগ করে যার মাধ্যমে তাদের ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ সম্ভবপর।

লাস্কির উক্তির মূলকথাঃ Prof. Harold J. Laski যথার্থই বলেন, "Every state is known by the | rights that it maintains." (প্রতিটি রাষ্ট্রই তার অধিকার সংরক্ষণের দ্বারাই পরিচিতি লাভ করে)। সাধারণত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণ অধিক পরিমাণে অধিকার ভােগ করে থাকে। অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণের অধিকার খর্ব হয়। শাসকশ্রেণী নিজেদের শাসনকে পাকাপােক্ত করার মানসে এবং জনগণের ওপর তাদের সুকঠিন নিয়ন্ত্রণ পরিচালনার জন্য তাদের মৌলিক অধিকারসহ অন্যান্য অধিকার হতে বঞ্চিত করে। সুতরাং লাস্কি তার উপযুক্ত মন্তব্যের দ্বারা বােঝাতে চেয়েছেন যেকোনাে রাষ্ট্র কত বেশি এর জনগণকে অধিকার প্রদান করে তার ওপরই নির্ভর করে তা কী পরিমাণ গণতান্ত্রিক।

অধিকারের সংজ্ঞাঃ অধিকার বলতে কোনাে কিছু করা বা না করার ক্ষমতাকে বুঝায়। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অবাধ অধিকার সমর্থনযােগ্য নয়। রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত সার্বজনীন কল্যাণার্থে প্রদত্ত সুযােগ-সুবিধাই অধিকার বলে বিবেচিত। অর্থাৎ ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য কতকগুলাে সুযােগ-সুবিধাই অধিকার।

প্রামাণ্য সংজ্ঞাঃ বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে অধিকারের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে তা বিস্তারিত বর্ণনা করা হলাে-

অধ্যাপক লাস্কি (Laski)- এর মতে, "Rights, in fact, are those conditions of social life without which noman seek, is general, to be himself at his best" (বস্তুতঃ অধিকার হলাে সমাজ জীবনের সেই সকল অবস্থা যেগুলাে ব্যতিরেকে কোনাে মানুষ সাধারণভাবে তার ব্যক্তিত্বের প্রকৃষ্টতম বিকাশে সচেষ্ট হতে পারে না।

হব হাউস (Hobhouse)-এর মতে, প্রকৃত অধিকার বলতে সামাজিক কল্যাণসাধনের কতকগুলাে শর্তকে বুঝায় এবং বিভিন্ন অধিকারের বৈধতা সমাজের সর্বাঙ্গীন উন্নতি বিধানের ওপর নির্ভরশীল।

অধ্যাপক বােসাঙ্ক (Bosanquet)-এর মতে, ''অধিকার হলাে সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত এবং রাষ্ট্র কর্তৃক প্রযুক্ত দাবি। (A right is a claim recognized by society and enforced by the state.)

ইউনেস্কো (Unesco) কমিটির মতে, অধিকার হলাে জীবনযাত্রার সেসব সুযােগ-সুবিধা, যা না থাকলে সমাজের নির্দিষ্ট স্তরে মানুষ সমাজের সক্রিয় সদস্য হিসেবে সমাজের কল্যাণসাধন করতে পারে না। কারণ ঐসব সুযােগের অভাবে নিজ সত্তার পূর্ণ বিকাশ আদৌ সম্ভবপর নয়।

সার্বিক সংজ্ঞাঃ উপযুক্ত সংজ্ঞাগুলাের আলােকে বলা যায় যে, অধিকার হলাে সমাজ ও রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত এমন কতকগুলাে সুযােগ-সুবিধা যার দ্বারা ব্যক্তি তার অত্যাবশ্যকীয় কার্য করে থাকে। আর এই অধিকারই মানুষকে কর্তব্যের দিকে ধাবিত করে।

অধিকারের বৈশিষ্ট্যঃ অধিকারের উপযুক্ত ধারণা হতে এর নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলি পাওয়া যায়। যেমন-
(১) অধিকার ব্যক্তির অন্তর্নিহিত শক্তির বিকাশ ঘটায়।
(২) অধিকার এক প্রকার সামাজিক ধারণা।
(৩) অধিকার কখনাে অবাধ ও চিরস্থায়ী হতে পারে না।
(৪) অধিকার রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত ও সংরক্ষিত হয়।
(৫) অধিকারের সাথে সমাজের বৃহত্তর স্বার্থ ও কল্যাণ জড়িত থাকে।

পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় অধিকারের প্রকৃতিঃ বর্তমানে পুঁজিবাদী দেশসমূহে রাষ্ট্র সাধারণভাবে যেসব মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি দেয় তা নিম্নরূপ-

(১) জীবনের অধিকারঃ বেঁচে থাকার অধিকার হচ্ছে মানুষের গুরুত্বপূর্ণ অধিকার। তাই প্রত্যেক নাগরিককে তার জীবনরক্ষার অধিকার দিতে হবে।

(২) শিক্ষার অধিকারঃ শিক্ষার অধিকার বলতে সবার লেখাপড়ার সুযােগ-সুবিধাকে বােঝায়। এক্ষেত্রে সবার সমান অধিকার স্বীকৃত হওয়া আবশ্যক।

(৩) সম্পত্তির অধিকারঃ সম্পত্তির অধিকার বলতে প্রত্যেক নাগরিকের সম্পত্তির ভােগদখল দান ও বিক্রয়ের অধিকার থাকতে হবে।

(৪) ধর্মীয় অধিকারঃ প্রত্যেক ধর্মের ব্যক্তি যাতে তার ধর্ম ঠিকভাবে পালন করতে পারে, সেজন্য রাষ্ট্রকে নাগরিকদের পূর্ণ ধর্মীয় অধিকার দিতে হবে।

(৫) সংবাদপত্রের স্বাধীনতাঃ মানুষের চিন্তা ও মতপ্রকাশের ব্যাপারে যদি স্বাধীনতার অধিকার স্বীকৃত হয়, তবে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাও স্বীকৃত হওয়া আবশ্যক।

(৬) চুক্তির অধিকারঃ এই অধিকারবলে নাগরিকগণ দেশের অভ্যন্তরে ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন করে।

(৭) মতপ্রকাশের স্বাধীনতাঃ এর অর্থ প্রত্যেক নাগরিকের স্বাধীনভাবে চিন্তা ও মতপ্রকাশ বক্তব্যের মাধ্যমে বা লিখিতভাবে করার অধিকার আছে।

(৮) পরিবার গঠনের অধিকারঃ পরিবার সমাজের মূল শক্তি। তাই পরিবার গঠনের অধিকার সবাইকে দেয়া উচিত।

(৯) সংঘবদ্ধ হবার অধিকারঃ নাগরিকের ইচ্ছামত যেকোনাে কারণে সংঘবদ্ধ হবার অধিকার থাকতে হবে। এ অধিকার বলে তারা সংঘবদ্ধ হয়ে রাষ্ট্রের নিকট বিভিন্ন দাবী পেশ করে।

(১০) স্বাধীনভাবে চলাফেরার অধিকারঃ দেশের মধ্যে যাতে প্রত্যেক নাগরিক স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারে সে অধিকার রাষ্ট্রকে দিতে হবে।

উপযুক্ত অধিকারসমূহ কোনাে দেশের নাগরিক পরিপূর্ণভাবে ভােগ করলে তাকে একটি পুঁজিবাদী ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলা যায়।

সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায়ঃ সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় উৎপাদনের উপায়ের ওপর ব্যক্তিগত মালিকানার পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্যক্তিগত সম্পত্তির পরিপূর্ণ উচ্ছেদ সাধন করে তার ন্যায়সঙ্গত বণ্টনের মাধ্যমে সমাজের সামগ্রিক কল্যাণসাধন করাই সমাজতান্ত্রিক সমাজের মূল উদ্দেশ্য। সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকারের সাথে সাথে অর্থনৈতিক অধিকার স্বীকৃত হয়। সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় অর্থনৈতিক অধিকারের ওপর বেশি গুরুত্ব আরােপ করা হয়। সমাজতান্ত্রিক দেশের জনগণ সাধারণত যেসব অধিকার ভােগ করে তা নিম্নরূপ-

(১) কর্মের অধিকারঃ কর্মের অধিকার অনুযায়ী উপযুক্ত যােগ্যতা অনুযায়ী কাজ পাওয়ার অধিকারকে বােঝায়। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এ অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের রয়েছে।

(২) অবকাশ যাপনের অধিকারঃ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মানুষের অবকাশ যাপনের পূর্ণ অধিকার রয়েছে।

(৩) প্রাপ্য পারিশ্রমিকের অধিকারঃ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যে যার দক্ষতা ও যােগ্যতা অনুযায়ী কাজ করবে ও প্রাপ্য পারিশ্রমিক পাবে। এ অধিকার সবার রয়েছে।

(৪) অক্ষম অবস্থায় রাষ্ট্র কর্তৃক ভরণ-পােষণের অধিকারঃ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কোনাে ব্যক্তি কোনাে কারণে অক্ষম হয়ে পড়লে তার পূর্ণ ভরণ-পােষণের অধিকার রাষ্ট্র নেয়।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, লাস্কির উক্তির সূত্র ধরে আমরা অধিকার, অধিকারের সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রে অধিকারের প্রকৃতি বা কোনাে রাষ্ট্রে নাগরিকগণ কী কী ধরনের অধিকার ভােগ করে তা আলােচনা করেছি। এ আলােচনা থেকে সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হয়েছে যে, একটি রাষ্ট্র তার নাগরিকদের যা যা অধিকার ভােগ করার সুবিধা দেয় তার মাধ্যমেই ঐ রাষ্ট্রের প্রকৃতি বা ধরন ফুটে ওঠে বা তার মাধ্যমেই ঐ রাষ্ট্র পরিচিতি লাভ করে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক