দিল্লী সালতানাতের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ইলতুৎমিশের কৃতিত্ব মূল্যায়ন কর


প্রশ্নঃ দিল্লী সালতানাতের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ইলতুৎমিশের কৃতিত্ব মূল্যায়ন কর।

অথবা, সুলতান ইলতুৎমিশের কৃতিত্ব ব্যাখ্যা কর। কী কী কারণে তাকে এ উপমহাদেশে মুসলিম শাসনের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা যেতে পারে?

অথবা, ভারত উপমহাদেশে তুর্কি সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ইলতুৎমিশের কৃতিত্ব মূল্যায়ন কর।

উপস্থাপনাঃ সুলতান ইলতুৎমিশ ছিলেন ভারত উপমহাদেশে মুসলিম শাসনের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। ১১৯২ সালে কুতুবুদ্দিন আইবেকের ক্রীতদাস হিসেবে জীবন শুরু করে মাত্র দু’দশকের মধ্যেই তিনি শাসন ক্ষমতার শীর্ষে আরােহণ করেন। দিল্লী সালতানাতের ইতিহাসে ইলতুৎমিশ এক বিশেষ স্থান দখল করে আছেন। তার সম্পর্কে ড. ঈশ্বরী প্রসাদের মন্তব্য হলাে- lfutmish is undoubtedly the real founder of the slave dynasty.

ইলতুৎমিশের পরিচিতিঃ সুলতান ইলতুৎমিশ তুর্কিস্তানের ইলবারী গােত্রের ইয়ালাম খানের পুত্র। শৈশবকালে ভ্রাতারা চক্রান্ত করে তাকে জনৈক ক্রীতদাস ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে দেয়। ব্যবসায়ী তাকে বােখারার প্রধান কাযীর নিকট বিক্রি করেন। কাযীর নিকট থেকে জালালুদ্দিন তাকে ক্রয় করে দিল্লীতে কুতুবুদ্দিনের কাছে বিক্রি করেন। ইলতুৎমিশ স্বীয় মেধা, জ্ঞান, বিচক্ষণতা, সামরিক ও প্রশাসনিক প্রতিভায় আইবেকের মন জয় করেন। ফলে আইবেক তাকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে নিজ কন্যাকে তার সাথে বিয়ে দেন এবং বায়ুনের শাসনকর্তা নিয়ােগ করেন।

দিল্লী সালতানাতের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ইলতুৎমিশের কৃতিত্বঃ

সুলতান হিসেবে ইলতুৎমিশঃ

১. সিংহাসনারোহণঃ কুতুবুদ্দিন আইবেকের মৃত্যুর পর জনৈক আরাম শাহ সিংহাসনে আরােহণ করেন, কিন্তু তার অযােগ্যতা ও অকর্মণ্যতায় সাম্রাজ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। ফলে দিল্লীর আমীর ওমরাগণ বায়ুনের শাসনকর্তা ইলতুৎমিশকে সিংহাসনে আরােহণের আমন্ত্রণ জানালে তিনি আরাম শাহকে পরাজিত করে ১২১১ খ্রিস্টাব্দে ক্ষমতা দখল করেন। ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই তিনি বহুমুখী জটিল সমস্যার মুখােমুখি হন।

বিদ্রোহ দমনঃ

২. আমীর ও অভিজাতদের দমনঃ ইলতুৎমিশ সিংহাসনে আরােহণ করেই স্বীয় রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও সামরিক শক্তি দিয়ে তার বিরােধী আমীর ও অভিজাতদের কঠোর হস্তে দমন করেন।

৩. ইয়ালদুজের বিদ্রোহ দমনঃ ১২১৫ খ্রিস্টাব্দে গজনীর শাসনকর্তা তাজুদ্দিন ইয়ালদুজ বিদ্রোহ ঘােষণা করলে ইলতুৎমিশ তরাইনের যুদ্ধে তাকে পরাজিত ও নিহত করে স্বীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।

৪. কুবাচার বিদ্রোহ দমনঃ ইয়ালদুজের পরাজয়ের পর ইলতুৎমিশ ১২২৭ সালে মুলতানের শাসক নাসিরুদ্দিন কুবাচার ভাবকার দুর্গে আক্রমণ করেন। কুবাচা সন্ধি করে স্বীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন, কিন্তু পরে চুক্তি ভঙ্গ করে স্বাধীনতা ঘােষণা করলে ইলতুৎমিশ পুনরায় ১২২৮ সালে তার রাজধানী উচ অবরােধ করে তাকে বিতাড়িত করেন।

৫. তুর্কি বাহিনীর বিদ্রোহ দমনঃ ইলতুৎমিশ তুর্কি বাহিনীর বিদ্রোহ দমনে কঠোর সামরিক শক্তি প্রয়ােগ করেন। তবে তাদের ওপর পুরােপুরি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে তার যথেষ্ট সময় লাগে।

৬. মােঙ্গল আক্রমণ প্রতিহতকরণঃ ১২২১ সালে সুলতান ইলতুৎমিশ এক নতুন বিপদের সম্মুখীন হন। চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বে মােঙ্গলরা মধ্য এশিয়া জয় করে, ভারতের সীমান্ত রাজ্য খাওয়ারিজম আক্রমণ করলে সেখানকার যুবরাজ শাহ জালালুদ্দিন পাঞ্জাবে আশ্রয় নেন। অতঃপর তিনি দিল্লীতে আশ্রয় প্রার্থনা করলে ইলতুৎমিশ প্রতিকূল পরিস্থিতির অজুহাতে তাকে আশ্রয়দানে অস্বীকতি জানান। জালালুদ্দিন প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে অন্যদিকে মনােনিবেশ করেন। কিন্তু এর পরপরই চেঙ্গিস খান ভারতের দ্বারপান্তে এসে উপনীত হন। ইলতুৎমিশ তাকে অনেক উপঢৌকন দিয়ে বিদায় করেন। ফলে ভারত আপাতত মােঙ্গল আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়।

রাজ্য বিস্তারঃ

৭. বাংলা অধিকারঃ ১২২৫ খ্রিস্টাব্দে ইলতুৎমিশ বাংলার স্বাধীন সুলতান গিয়াসুদ্দিন ইওয়াজ খিলজীর বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। ইওয়াজ খিলজী আত্মসমর্পণপূর্বক সুলতানের বশ্যতা স্বীকার করে, কিন্তু ইওয়াজ খিলজী পুনরায় বিদ্রোহী হলে ১২২৭ খ্রিস্টাব্দে তার বড় পুত্র নাসিরুদ্দিন বাংলা আক্রমণ করে ইওয়াজ খিলজীকে পরাজিত ও হত্যা করেন।

৮. সিন্ধু ও মুলতান অধিকারঃ ১২২৮ খ্রিস্টাব্দে ইলতুৎমিশ মুলতানের শাসক হিসেবে নাসিরুদ্দিন কুবাচাকে বাক্কারের যুদ্ধে চরমভাবে পরাজিত করে। সিন্ধু নদ পার হতে গিয়ে কুবাচা মারা যায়। ফলে সিন্ধু ও মুলতানের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়।

৯. আব্বাসী খলিফার স্বীকৃতিলাভঃ ইলতুৎমিশ ১২২৯ সালে বাগদাদের আব্বাসী খলিফা আবু জাফর আল মনসুর আল মুনতাসির বিল্লাহ কর্তক সুলতান-উল-আযম খেতাব এবং রাজছত্র ও রাজকীয় পােশাক উপঢৌকন হিসেবে লাভ। করেন। তার সালতানাতের পক্ষে এটি ছিল এক পরম সৌভাগ্যের বিষয়।

১০. রণথম্ভোর, গােয়ালিয়র ও মালব বিজয়ঃ ইলতুৎমিশ ১২২৬ খিস্টাব্দে রণথম্ভোর ও ১২৩২ খ্রিস্টাব্দে গােয়ালিয়র জয় করেন এবং ১২৩৪ খ্রিস্টাব্দে মালব আক্রমণ করে ভিলমা ও উজ্জয়িনী দখল করেন।

১১. হিন্দু বেনিয়াদের বিরুদ্ধে অভিযানঃ ১২৩৫ সালে ইলতুৎমিশ তার সর্বশেষ অভিযান হিন্দু বেনিয়াদের বিরুদ্ধে পরিচালনা করেন, কিন্তু পথিমধ্যে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে দিল্লীতে ফিরে আসেন এবং ১২৩৬ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুমুখে পতিত হন।

সাম্রাজ্যের সংহতি বিধানে ইলতুৎমিশঃ

১২. প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতাঃ ভারত উপমহাদেশে কুতুবুদ্দিন মুসলিম সাম্রাজ্যের গােড়াপত্তন করেন মাত্র। সুলতান ইলতুৎমিশ ছিলেন সার্বভৌম মুসলিম ভারতের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। তিনি স্বীয় বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা, সমর কৌশল দ্বারা নানা অনিশ্চয়তা ও বাধা বিপত্তি মােকাবেলা করে সাম্রাজ্যকে একটি শক্তিশালী ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেন।

১৩. সুদক্ষ শাসকঃ সুলতান ইলতুৎমিশ ছিলেন একজন সুদক্ষ শাসক। তিনি বিশাল সাম্রাজ্যকে কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত করে প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিয়ােগ করেন। তাদের বলা হতাে মুকতা। তারা তাদের প্রাদেশিক ব্যয় নির্বাহের পর বাকি অর্থ কেন্দ্রীয় কোষাগারে জমা দিতেন। ড. কোরেশী তাই বলেন, “বিশৃঙখল সাম্রাজ্যে ইলতুৎমিশ একটি সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করেন।”

১৪. দক্ষ সেনাপতিঃ সুলতান ইলতুৎমিশ ছিলেন শ্রেষ্ঠ সামরিক নেতা। নিজ সামরিক প্রতিভাগুণে তিনি ঘুরী ও কুতুবুদ্দিন আইবেকের মন জয় করেন। অন্যদিকে নিজ সাম্রাজ্যকে বহিরাক্রমণ থেকে মুক্ত রেখে বিভিন্ন বিজয় অভিযান পরিচালনা করে নিজের শাসনকার্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছিলেন।

১৫. রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা রক্ষাঃ ইলতুৎমিশ রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য দেশের সকল অভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধান করেন। একই সাথে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অরাজকতা ও প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা নির্মূল করেন।

১৬. নতুন মুদ্রা প্রচলনঃ ভারতের মুসলিম শাসকদের মধ্যে ইলতুৎমিশই সর্বপ্রথম খাঁটি আরবি মুদ্রা প্রচলন করেন। রুপিয়া নামের এ মুদ্রায় তিনি নিজেকে আমীরের আমীর দাবি করেন।

১৭. শিল্পানুরাগীঃ দিল্লীর কুতুব মিনার, আড়াই দিনকা ঝােপড়া মসজিদ, নাসিরিয়া মাদরাসা, বদায়ুনের ঈদগাহ ময়দান প্রভৃতি স্থাপত্যকর্ম তার উদার পৃষ্ঠপোষকতায় পুনঃনির্মিত হয়।

১৮. বিদ্যোৎসাহীঃ তার শাসনামলে দিল্লী শিক্ষা সংস্কৃতির কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়। তার দরবারে অসংখ্য কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, ইসলাম প্রচারক ও জ্ঞানী ব্যক্তির সমাবেশ ঘটেছিল। এ সময় দিল্লীতে বহু স্কুল, কলেজ ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৯. ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাঃ ইলতুৎমিশ একজন ন্যায়বিচারক ছিলেন। তিনি অন্যায় কঠোর হস্তে দমন করেন এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেন।

২০. জনকল্যাণমূলক কর্মসূচিঃ জনসাধারণের কল্যাণে ইলতুৎমিশ অসংখ্য রাস্তাঘাট ও সরাইখানা নির্মাণ, বন জঙ্গল অপসারণ, কর লাঘব প্রভৃতি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেন। প্রজাদের অভিযােগ শ্রবণের জন্য তিনি দরবারে ঘণ্টা ঝুলিয়ে রাখতেন।

২১. হৃদয়বান মানুষঃ উদারতা, মহানুভবতা ও পরােপকার ইলতুৎমিশের। চরিত্রকে মহিমান্বিত করে তুলেছিল। তার ধর্মপরায়ণতা ছিল সর্বজনবিদিত। তিনি সুফী সাধকদের যথেষ্ট শ্রদ্ধা করতেন।

২২. উন্নত চরিত্রের অধিকারীঃ সুলতান ইলতুৎমিশ ব্যক্তি চরিত্রে ছিলেন সৎ নিষ্ঠাবান, দয়ালু, পরােপকারী ও প্রজাহিতৈষী। একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম হিসেবে তিনি সব সময় ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করতেন।

উপসংহারঃ অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন, বহিঃশত্রুর আক্রমণরােধ এবং মুসলিম শাসন সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর স্থাপন করে ইলতুৎমিশ ভারতের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন। ড. ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন- llfufmish is Undoubtedly the real founder of the slove dynasty. উল্লিখিত কৃতিত্বসমূহ পর্যালােচনা করে ইলতুৎমিশকে ভারতের মুসলিম শাসনের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা যায়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক