এরিস্টটল নির্দেশিত বিপ্লবের কারণসমূহ আধুনিককালে কতটুকু প্রযােজ্য? আলােচনা কর


প্রশ্নঃ এরিস্টটল নির্দেশিত বিপ্লবের কারণসমূহ আধুনিককালে কতটুকু প্রযােজ্য? আলােচনা কর।

ভূমিকাঃ গ্রীক নগররাষ্ট্রের রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল এর সরকারের দ্রুত পরিবর্তন। এই পরিবর্তন গ্রীক রাজনৈতিক জীবনে চরম হতাশার সৃষ্টি করেছিলাে। নগর রাষ্ট্রসমূহের এই হতাশাব্যঞ্জক অবস্থা অবলােকন এরিস্টটল ব্যাপক অনুসন্ধান কার্যে নিয়ােজিত হন। আর এই অনুসন্ধানের অব্যবহিত ফলই হচ্ছে তার বিপ্লব সম্পর্কিত মতবাদ। এরিস্টটল তার সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থে বিপ্লব সম্পর্কিত মতবাদের ব্যাখ্যা ও বিপ্লবের প্রতিকারের উপায় সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ করে।

বিপ্লবের কারণসমূহঃ এরিস্টটল বিপ্লবের কারণসমূহকে দু'ভাগে ভাগ করেছেন। (১) সাধারণ কারণ (General Cause) (২) বিশেষ কারণ (Particular cause)।

(ক) সাধারণ কারণঃ এরিস্টটল সর্বপ্রথম বিপ্লবের কতকগুলাে সাধারণ কারণ-এর কথা উল্লেখ করেন। সাধারণ কারণগুলাের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলাে (১) মনস্তাত্তিক উদ্দেশ্য (২) সুনাম বা সম্মান লাভের আকাঙক্ষা (৩) প্রাথমিক অবস্থানসমূহ। নিম্নে এরিস্টটলের বিপ্লবের সাধারণ কারণগুলাে আলােচনা করা হলাে-

(১) অসমতাঃ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় ব্যাপক সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অসমতা বিদ্যমান থাকে। যােগ্যতম ব্যক্তিরা যখন মনে করে যে তারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের চাইতে যােগ্যতার দিক দিয়ে কোনাে অংশে কম নয় অথচ তারা রাজনৈতিক অধিকার ভােগ করতে পারছে না, তখন তারা স্বাধিকারের দাবিতে বিপ্লব করে।

(২) ক্ষমতার অপব্যবহারঃ তিনি মনে করেন যে, বিপ্লব সংঘটিত হয় রাষ্ট্রীয় তথা সরকারী ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে। শাসক যখন জনকল্যাণ বাদ দিয়ে সরকারী তহবিল নিজের ইচ্ছেমতাে ব্যবহার করেন এবং অসৎ মুনাফা অর্জন করেন তখন জনগণ বিপ্লবী হয়ে ওঠে।

(৩) ভিন্ন ভিন্ন ন্যায় বিচারঃ বিচার সম্পর্কে বিভিন্ন ধারণা বিভিন্ন প্রকার বিপ্লবী মনােভাবের সূচনা করে। কোনাে সমাজের উল্লেখযােগ্য অংশ যখন মনে করে যে তাদের প্রতি ন্যায়বিচার করা হচ্ছে না তখন তারা বিপ্লবী হয়ে ওঠে।

(৪) ক্ষমতা ধারণঃ সমাজে চরমপন্থী ঐতিহ্যসমূহের মধ্যে যথার্থ রাজনৈতিক ক্ষমতা ধারণ করার যােগ্যতা এবং যথার্থ রাজনৈতিক ক্ষমতা যারা কার্যকর করে তাদের মধ্যে সে ব্যাপারে গরমিল দেখা দিলে বিপ্লবের সম্ভাবনা দেখা দেয়।

(৫) ঘৃণ্য মনােভাবঃ তিনি মনে করেন, ঘৃণাই বিপ্লবের জন্য অনেকটা দায়ি। যদি বিদ্যমান সরকারের প্রতি জনগণের মধ্যে বা জনসমষ্টির কোনাে অংশের মধ্যে ঘৃণার ভাব জাগ্রত হয় তবে বিপ্লব হতে পারে।

বিশেষ কারণঃ এরিস্টটল বিপ্লব সম্পর্কে সাধারণ কারণ নির্ধারণের পর কতকগুলি নির্দিষ্ট বিশেষ কারণের উল্লেখ করেছেন। নিম্নে বিস্তারিত আলােচনা করা হলাে-

(১) স্বেচ্ছাচারিতাঃ গণতন্ত্রে অত্যধিক জনপ্রিয় নেতাদের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। গণপ্রবক্তরা যখন এককভাবে কিংবা সমষ্টিগতভাবে বিত্তবানদের আক্রমণ করে তখনই গণতান্ত্রিক সংবিধানে বিপ্লব সংঘটিত হয়।

(২) অন্যায় আচরণঃ ধনিকতন্ত্রে বিপ্লব সংঘটিত হয় জনগণের প্রতি অন্যায় ও অত্যাচারমূলক আচরণের ফলে এবং ধনীদের নিজেদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলে। ধনিকতন্ত্রে মুষ্টিমেয় বিত্তবান ব্যক্তি শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। এবং রাষ্ট্রীয় কার্যে একচেটিয়া অধিকার লাভ করে।

(৩) বিপ্লবের অভ্যন্তরীণ বিরােধঃ রাজতন্ত্রে রাজ পরিবারের অভ্যন্তরীণ বিরােধ, দ্বন্দ্ব ও কলহের ফলে বিপ্লবের সূচনা হয়। আবার রাজা যখন স্বৈরাচারী হয়ে ওঠেন তখন জনগণ তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে এবং রাজতন্ত্রের অবসান ঘটায়।

(৪) ক্রটিপূর্ণ ভারসাম্যঃ Polity বা মধ্যতন্ত্রের মধ্যে গণতন্ত্র ও ধনিকতন্ত্রের যে সমন্বয়সাধিত হয় তার ত্রুটিপূর্ণ ভারসাম্যের ফলে Polity বা মধ্যতন্ত্রে বিপ্লবের সূচনা হয়।

(৫) অত্যাচার ও নির্যাতনঃ স্বৈরতন্ত্রে শাসক শ্রেণী জনগণের ওপর চরম অত্যাচার ও নির্যাতন চালায়। ফলে জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে বিপ্লবের মাধ্যমে উক্ত সরকারের পতন ঘটায়।

এরিস্টটল নির্দেশিত বিপ্লবের কারণসমূহ আধুনিককালে কতটুকু প্রযােজ্যঃ এরিস্টটল নির্দেশিত বিপ্লবের কারণসমূহ আধুনিককালে কতটুকু প্রযােজ্য?

(১) প্রেক্ষাপটঃ তৎকালীন গ্রীক নগররাষ্ট্রগুলাের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে দার্শনিক এরিস্টটল নির্দেশিত বিপ্লবের কারণসমূহ আধুনিককালেও প্রাসঙ্গিক বলে গৃহীত হয়েছে। এরিস্টটল যে একজন বাস্তববাদী দার্শনিক ছিলেন তার প্রমাণ এখানেই পাওয়া যায়।

(২) অর্থনৈতিক অসমতাঃ বিপ্লবের সাধারণ কারণ, বিশেষ কারণসমূহ যা এরিস্টটল নির্দেশিত তা আধুনিককালেও সমভাবে প্রযােজ্য। রাষ্ট্রে যখন চরম সামরিক ও অর্থনৈতিক অসমতা বিরাজ করে তখনই সাধারণত বিপ্লব সংঘটিত হয়।

(৩) প্রতিকারঃ কেবলমাত্র বিপ্লবের কারণ নয় এর প্রতিকারের জন্যও এরিস্টটল যে সমস্ত সুপারিশমালা প্রদান করেছেন তার অল্প কিছু বাদ দিলে তা আধুনিককালে সমভাবে প্রযােজ্য। তাই এরিস্টটলের বিপ্লবের কারণ ও প্রতিকারের সুপারিশমালার মধ্যে আমরা তার চিন্তার প্রসারতা ও দূরদর্শিতা দেখতে পাই।

পরিশেষঃ এরিস্টটলের বিপ্লবের কারণ ও প্রতিকারের সুনির্দিষ্ট সুপারিশমালা যুগে যুগে সকল রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সমভাবে গৃহীত হয়েছে। কালের গতি একে ম্লান করতে পারেনি। এরিস্টটল বিপ্লবের কারণ ও তার প্রতিকারের উপায় বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ও বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেন। পরিশেষে বলবাে যে এরিস্টটলের বিপ্লব তত্ত্ব সর্বকালে সকল রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সমানভাবে গ্রহণীয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক