মুসলিম বিজয়ের প্রাক্কালে ভারত উপমহাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা সংক্ষেপে আলােচনা কর


প্রশ্নঃ মুসলিম বিজয়ের প্রাক্কালে ভারত উপমহাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা সংক্ষেপে আলােচনা কর।

উপস্থাপনাঃ মুসলিম বিজয়ের প্রাক্কালে ভারতের সামাজিক এবং রাজনৈতিক অবস্থা ছিল ব্যাপক ত্রুটিপূর্ণ ও চরম বিশৃঙ্খল। ফলে ভারতীয় উপমহাদেশে কোনাে সুপ্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রব্যবস্থা ছিল না। ঐতিহাসিক ওয়াল ব্যাস্ক বলেন, জাতি ধর্ম ও ভাষার দিক থেকে ভারত উপমহাদেশ পৃথিবীর একটি জটিল দেশ। ড. স্মিথ বলেন- The partial unity of India History vanish as with Harsha.ফলে ৭১২ খ্রিষ্টাব্দে মুহাম্মদ বিন কাসিম কর্তৃক সিন্ধু বিজয়ের মাধ্যমে ভারত উপমহাদেশে মুসলিম শাসন সূচিত হয়।

মুসলিম বিজয়ের প্রাক্কালে ভারতের সামাজিক অবস্থাঃ

১. জাতিভেদ প্রথাঃ মুসলিম বিজয়ের প্রাক্কালে ভারতীয় হিন্দুদের মাঝে দাম্ভিকতা, সংকীর্ণতা ও জাতিভেদ প্রথা পরিলক্ষিত হয়। কালক্রমে তাদের মধ্যে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্ৰীয়, বৈশ্য ও শূদ্র- এ চারটি প্রধান জাতির উদ্ভব হয়। অর্থনেতিক কারণেও হিন্দু সমাজে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব গড়ে উঠে। এদের মধ্যে গন্ধবণিক, কম্ভকার, কর্মকার, তাম্বুলিক, মালাকার, শঙ্খবণিক, জেলে, নাপিত, চণ্ডাল, চামার ইত্যাদি।

২. শােষণ নির্যাতনঃ সমাজে বৈশ্য ও শূদ্ররা ছিল অধঃপতিত, অসহায় ও অস্পৃশ্য। এছাড়া নিম্ন বর্ণের লােকেরা ধর্মগ্রন্থ বেদ অধ্যয়ন করলে তাদের জিহ্বা কেটে ফেলা হতাে। বিভিন্ন বর্ণের লােকদের মাঝে বিবাহ অপ্রচলিত ছিল।

৩. ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রীয়দের সুবিধাঃ ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রীয়রা অধিক সুবিধাপ্রাপ্ত অভিজাত শ্রেণি ছিল। তাদের সুবিধার্থে অন্যান্য সম্প্রদায়কে ব্যবহার করা হতাে। হিন্দু ধর্ম গ্রন্থ মনুসংহিতায় বলা হয়েছে, পৃথিবীর যেখানে যা আছে তা ব্রাহ্মণদের সম্পত্তি বলে পরিগণিত হবে।

৪. নারীদের অবস্থানঃ মুসলিম বিজয়ের প্রাক্কালে ভারতে নারীদের ভােগের পণ্য ছাড়া আর কিছুই ভাবা হতাে না। তাদের কোনাে স্বত্ব বা অধিকার ছিল না। বিধবা বিবাহ নিষিদ্ধকরণ নারীদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিল। পুরুষরা বহুবিবাহ করলেও নারীদের একাধিক বিবাহ নিষিদ্ধ ছিল।

৫. বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজা-অর্চনাঃ এ দেশে মুসলমানদের আগমনের প্রাক্কালে হিন্দুরা নিজেদের হাতে নির্মিত বহু দেব দেবীর পূজা করত।

৬. দাসপ্রথাঃ ভারতবর্ষে দাসপ্রথা নামে আরেকটি লজ্জাজনক হীন প্রথা ছিল। এ প্রথার মাধ্যমে অনেক নিরীহ লােক নির্যাতিত হতাে। যারা দাস হিসেবে সমাজে পরিচিত ছিল তাদের সামাজিক মর্যাদাতাে দূরের কথা ন্যূনতম অধিকারও তারা পেত না।

৭. কুপ্রথার সয়লাভঃ ভারতীয় উপমহাদেশে এমন কতিপয় কুপ্রথাকে ধর্মজ্ঞান করা হতাে, যা মানবতা বিরােধী। যেমন নরবলি, শিশু সন্তানকে গঙ্গার জলে বিসর্জন ইত্যাদি লােমহর্ষক কার্যাবলি হিন্দুরা অত্যন্ত উৎসাহের সাথে পালন করত।

৮. অসামাজিক কার্যকলাপঃ হিন্দু সমাজের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান, যেমন দুর্গাপূজা, হােলি প্রভৃতি ইন্দ্রিয়পরায়ণতা এবং অশ্লীলতা লক্ষ্য করা যায়। দেবতার সন্তুষ্টির নিমিত্ত অনুষ্ঠিত কাম মহােৎসব, নৃত্যে বিকৃতির পরিচয় পরিস্ফুট। ধনী ও সম্ভ্রান্ত হিন্দুরা নারীদেহ ভােগ, মদ্যপান ও ব্যভিচারে খুব আসক্ত ছিল।

৯. সতীদাহ প্রথাঃ নারীদের প্রতি আরেকটি অবমাননাকর প্রথা ছিল। শাসকগােষ্ঠী ও ধর্মীয় নেতা কর্তৃক চাপিয়ে দেয়া সতীদাহ প্রথা। স্বামীর মৃত্যু হলে স্ত্রীকেও তার সাথে জ্বলন্ত আগুনে, দাহ করা হতাে। সমাজের অধিকাংশ লােক নিরামিষভােজী ছিল। তবে তারা পিয়াজ ও রসুন খেত না।

১০. বিবাহ রীতিঃ বর্ণ প্রথার ওপর ভিত্তি করে হিন্দু সমাজে বিবাহ রীতি প্রচলিত ছিল। বিত্তবান হিন্দুরা জাঁকজমকের সাথে বৈবাহিক অনুষ্ঠান পালন করত। পঞ্জিকা দেখে এবং রাশি গণনা করে বিবাহের লগ্ন স্থির করা হতাে। স্বামী স্ত্রীর কোনাে একজনের মৃত্যু হলে অপরজন বিবাহ করত না। অভিজাত হিন্দুরা বহু বিবাহ করত।

১১. শিক্ষাব্যবস্থাঃ ভারতীয় উপমহাদেশে সামাজিক বৈষম্য বিরাজ করলেও শিক্ষাপ্রসারের জন্য সর্বত্র স্কুল কলেজ ছিল। সংস্কৃত ভাষা শিক্ষাদানের জন্য মালাবর ধর এবং আজমীরে দুটি কলেজ স্থাপিত হয়েছিল। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শাস্ত্র, বেদান্ত বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসা শাস্ত্র প্রভৃতি শিক্ষা দেয়া হতাে।

মুসলিম বিজয়ের প্রাক্কালে ভারতের রাজনৈতিক অবস্থাঃ

১. রাজনৈতিক ঐক্যের অভাবঃ মুসলিম বিজয়ের প্রাক্কালে ভারত উপমহাদেশে কোনােরূপ রাজনৈতিক ঐক্য ছিল না। সমগ্র উপমহাদেশ অনেকগুলাে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত ছিল। এ রাজ্যগুলাের পরস্পরের মধ্যে প্রবল শত্রুতা বিদ্যমান ছিল। ৬৪৭ সালে রাজা হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর প্রায় ৫০ বছর পর্যন্ত তার বিশাল সাম্রাজ্যে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা অব্যাহত থাকে।

২. রাজতন্ত্রঃ মুসলিম বিজয়ের প্রাক্কালে ভারতবর্ষের শাসনব্যবস্থায় রাজতন্ত্রই ছিল অধিক জনপ্রিয়। বংশানুক্রমিকভাবে রাজা নিযুক্ত হলেও কখনাে কখনাে রাজ্যের প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও রাজা নিযুক্ত হতেন।

৩. শাসকের সর্বময় ক্ষমতাঃ তৎকালীন রাষ্ট্রব্যবস্থায় শাসক ছিলেন সকল ক্ষমতার উৎস। তিনি আইন প্রণেতা, শাসনকার্য পরিচালক, ন্যায়বিচারের উৎস এবং প্রধান সেনাপতি ছিলেন। তিনি রাজধর্মের আলােকে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন।

৪. রাজকার্য পরিচালনাঃ রাজকার্য পরিচালনার ব্যাপারে ‘মন্ত্রি’ এবং ‘সচিব’ নামক দু’শ্রেণির মন্ত্রী রাজাকে সাহায্য করতেন ও পরামর্শ দিতেন। মন্ত্রীরা সন্ধি বিগ্রহিক, সুমন্ত, অমাত্য প্রভৃতি নামে অভিহিত হতেন।

৫. স্বায়ত্তশাসনঃ তৎকালীন ভারত উপমহাদেশে স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। প্রাদেশিক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে উপারিকা বলা হতাে, প্রত্যেক প্রদেশ আবার কতগুলাে জেলায় বিভক্ত ছিল। জেলাকে বলা হতাে ভাষ। জেলার শাসনকর্তাকে বলা হতাে ‘ভাষপতি’।

৬. জনগণের প্রতি অবহেলাঃ জনসাধারণের সার্বিক কল্যাণ ও অন্যান্য সুবিধাসমূহের প্রতি শাসকশ্রেণি সবসময় অবহেলা ও অবজ্ঞাসূচক আচরণ করত। জনগণের সুবিধা অসুবিধার ব্যাপারে তাদের কোনাে চিন্তাই ছিল না; বরং অধিকাংশ রাজন্যবর্গকে নিজের আরাম আয়েশ ও স্বার্থ সংরক্ষণে সদা তৎপর থাকতে দেখা যেত।

৭. রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অভাবঃ শাসকশ্রেণি যেমন জনগণকে পাশ কাটিয়ে চলত, তেমনি প্রজাসাধারণও এর প্রতিকার হিসেবে রাজনৈতিক জ্ঞান অর্জন করত। ফলে দীর্ঘকালব্যাপী ভারতবর্ষের সাধারণ নাগরিকরা চরমভাবে নির্যাতিত হতে থাকে।

৮. উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের রাজ্যসমূহঃ সিন্ধু, কাশ্মীর, দিল্লী, মালব, কনৌজ, বন্দেন খণ্ড ও বঙ্গদেশ ইত্যাদি ছিল উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের রাজ্য। এসব রাজ্য স্বাধীন ও সার্বভৌম ছিল।

৯. পশ্চিমাঞ্চলের তিনটি রাষ্ট্রের ভিত্তিঃ প্রখ্যাত ঐতিহাসিক পর্যটক হিউ এন সাং-এর লিখিত বিবরণ থেকে জানা যায়, ভারত উপমহাদেশের পশ্চিমাঞ্চল তিনটি শক্তিশালী রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল। যথা- (ক) উত্তরাঞ্চলের কপিলি রাজ্য, (খ) দক্ষিণের সিন্ধু রাজ্য, (গ) দু’রাজ্যের মাঝখানে তাজাকুটা রাজ্য। এসব রাজ্য পরস্পর ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত ছিল।

১০. দাক্ষিণাত্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের সৃষ্টিঃ তৎকালীন শাসনব্যবস্থায় উত্তর ভারতের ন্যায় দক্ষিণ ভারত উপমহাদেশে বহু সংখ্যক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের উদ্ভব ঘটে। এদের মধ্যে পল্লব, চালুক্য, রাষ্ট্রকুট, পাণ্ড্য ও চেরা উল্লেখযােগ্য। এসব রাজ্য সর্বদা ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত থাকত।

১১. পূর্ব ভারতে সেন ও পাল বংশঃ পূর্ব ভারতে সেন বংশের জনৈক সামন্ত সেন বাংলার একাংশের ওপর স্বীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। আর পাল বংশ বিহারে স্বাধীনভাবে রাজত্ব স্থাপন করেছিল।

১২. গােত্রীয় বিভেদঃ ভারত উপমহাদেশে বিভিন্ন গােত্রের অবস্থান ছিল। গােত্রীয় বিরােধ তাদের মাঝে ইন্দ্রজালের ন্যায় ছড়িয়ে পড়েছিল। গােত্রীয় বিবাদ অবসানের সামাজিক বা রাজনৈতিক কোনাে ব্যবস্থা ছিল না। কেন্দ্রীয় সরকারের অভাবে স্বাধীন রাজ্যগুলাে আত্মকলহে লিপ্ত থেকে দুর্বল হয়ে পড়েছিল।

১৩. সাম্প্রদায়িকতাঃ বিশ্বে যা কিছু হীন জঘন্য, তন্মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা সবচেয়ে অশুভ ও অমঙ্গলজনক। সাম্প্রদায়িকতা মমত্ব ও ভ্রাতৃত্ববােধ বিনষ্ট করে দেয়। তৎকালীন সমাজের স্বার্থান্বেষী মহল সাম্প্রদায়িকতার মতাে বিষবাষ্পের জন্ম দেয়।

১৪. মুসলিম বিজেতাদের প্রতি আমন্ত্রণঃ প্রভাতের সােনালি সূর্যের ন্যায় ইসলামের স্নিগ্ধ কিরণরাজি যখন পৃথিবীর আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়েছিল, মুসলিম বিজয়ী কাফেলা যখন অর্ধ পৃথিবী অধিকার করে, ঠিক তখনই ভারতবাসী মুসলমানদের আগমনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল। এমনকি অনেক হিন্দু রাজাও তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী কতিপয় প্রধান রাজ্যের বিরুদ্ধে মুসলিম বিজেতাদের আমন্ত্রণ করেছিল।

উপসংহারঃ মুসলিম আগমনের প্রাক্কালে ভারত ছিল এক অন্ধকারাচ্ছন্ন উপমহাদেশ। সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে অসংখ্য অনৈক্য, বিশৃঙ্খলা ও কুসংস্কার ভারত উপমহাদেশে মানবতার প্রগতি স্তিমিত করে রেখেছিল।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক