ফিরােজ শাহ তুঘলকের কৃতিত্ব আলােচনা কর। তুঘলক বংশের পতনে তার ভূমিকা কী ছিল?


প্রশ্নঃ ফিরােজ শাহ তুঘলকের কৃতিত্ব আলােচনা কর।

অথবা, ফিরােজ শাহ তুঘলকের শাসনকার্যের মূল্যায়ন কর। তুঘলক বংশের পতনে তার ভূমিকা কী ছিল?

উপস্থাপনাঃ ত্রয়ােদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ভারতের ইতিহাসে সুলতান ফিরােজ শাহ তুঘলকের রাজত্বকাল একটি যুগান্তকারী অধ্যায়। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে রাজ্যের চরম সংকটময় মুহূর্তে ১৩৫১ খ্রিস্টাব্দে তিনি শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং পতনােন্মুখ অবস্থা থেকে সাম্রাজ্য রক্ষা করেন। তাই তার রাজত্বকাল সম্পর্কে ড. আগা মাহদী হােসাইন বলেন- Firoz Shah's reign was marked by glad reception, welcome relief ambition, reflected glory, peace and prosperity.

ফিরােজ শাহ তুঘলকের কৃতিত্বঃ

১. বাংলায় অভিযানঃ সিংহাসনে আরােহণ করেই ফিরােজ শাহ হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধারের উদ্দেশে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ১৩৫৩-৫৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলার বিদ্রোহী শাসনকর্তা ইলিয়াস শাহের বিরুদ্ধে, পরবর্তীতে ১৩৫৯ সালে ইলিয়াস শাহের পুত্র সিকান্দার শাহের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় বারের মতাে বাংলায় অভিযান পরিচালনা করে সােনারগাঁও দখল করেন। ১৩৭৭ সালে গুজরাটের বিদ্রোহী শাসনকর্তাকে পরাজিত এবং হত্যা করেন।

২. অন্যান্য অভিযানঃ সুলতান ফিরােজ শাহের আমলে কয়েকটি অভিযান প্রেরিত হয়েছিল। যেমন- ১৩৫৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলা, উড়িষ্যা, ১৩৬১ খ্রিস্টাব্দে নগরকোট ও ১৩৬২ খ্রিস্টাব্দে সিন্ধু অভিযান পরিচালিত হয়। অবশ্য বাংলা ছাড়া সবগুলাে অভিযানই সফল হয়।

৩. শাসন সংস্কারঃ ফিরােজ শাহ রাজ্যের সংহতি বিধানের জন্য প্রজাদের পূর্ববর্তী ঋণ মওকুফ করে দেন এবং আলাউদ্দিন খিলজী কর্তৃক বাজেয়াপ্তকৃত জায়গির প্রথার পুনঃ প্রবর্তন করেন। তিনি সমগ্র রাজ্যকে কতগুলাে জায়গির ও জেলায় বিভক্ত করে অমাত্যদের তার তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত করেন।

৪. রাজস্ব সংস্কারঃ ফিরােজ শাহ কুরআনের বিধান অনুযায়ী রাজস্ব সংস্কার সাধন করেন। তিনি ২৩ প্রকার অবৈধ কর রহিত করেন এবং কুরআনে বর্ণিত যাকাত, জিযিয়া, খারাজ ও খুমুস- এ চার প্রকার কর ধার্য করেন।

৫. কৃষি সংস্কারঃ ঐতিহাসিক ফিরিশতা বলেন, কৃষির উন্নতির জন্য ফিরােজ শাহ তুঘলক ১৫০টি কূপ ও ৪টি খাল খনন করে পানি সেচের ব্যবস্থা করেন। এছাড়া তিনি কষি ঋণদান এবং অন্যান্য সহায়তা দ্বারা কৃষির প্রভূত উন্নতি সাধন করেন।

৬. বিচার ব্যবস্থাঃ ফিরােজ শাহ তুঘলক বিচার বিভাগের আমূল পরিবর্তন সাধন করেন। তিনি কাযী ও মুফতিদের ওপর বিচারের ভার ন্যস্ত করেন। ইতঃপূর্বে প্রচলিত অপরাধীদের শাস্তিস্বরূপ হাত, চোখ, নাক ছেদনের কঠোর প্রথা তিনি রহিত করেন। তিনি বিচারব্যবস্থাকে উদার ও মানবােচিত করার পাশাপাশি মনে করতেন, চরিত্র সংশােধন করাই বিচারব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত।

৭. ব্যবসায় বাণিজ্যের উন্নয়নঃ ব্যবসায় বাণিজ্যের উন্নতির জন্য ফিরােজ শাহ আন্তঃপ্রাদেশিক শুল্ক তুলে দেন। ফলে নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যাদি জনগণের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকায় তাদের সার্বিক মঙ্গল সাধিত হয়। তখন এক মণ গম ৮ জিতল, ১ মণ বার্লি ৪ জিতল, ১০ সের ডাল ১ জিতল, ১ সের ঘি ১.৫ জিতলে পাওয়া যেত।

৮. মুদ্রা সংস্কারঃ মুদ্রা সংস্কার ফিরােজ শাহের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব। তিনি সহজ বিনিয়ােগের জন্য অল্প মানের মুদ্রা প্রবর্তন করেন। তিনি সর্বপ্রথম আধা ও বিখ নামে দু'প্রকার মিশ্রিত ধাতব মুদ্রার প্রচলন করেছিলেন। ঐতিহাসিক ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন, তিনি তাম্র ও রৌপ্য মিশ্রিত আধুলি এবং সিকির ন্যায় দু'প্রকার ক্ষুদ্র মুদ্রা প্রবর্তন করেন।

৯. সামরিক সংস্কারঃ ফিরােজ শাহ সামন্ত প্রথার ভিত্তিতে সেনাবাহিনীর সংস্কার সাধন করেন। তিনি নিয়মিত সৈন্যদের জমি ও জায়গির এবং অনিয়মিত সৈন্যদের বেতন দিতেন। অবশ্য তার সময়ে ক্রীতদাস প্রথা বৃদ্ধি পায়।

১০. ক্রীতদাস বিভাগ প্রতিষ্ঠাঃ সুলতান একটি নিয়মিত ক্রীতদাসের বিরাট বাহিনীও গড়ে তােলেন। শামসে সিরাজ আফিফের মতে, ফিরােজ শাহের আমলে ক্রীতদাসের সংখ্যা ছিল ৮০ হাজার এবং তাদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দিওয়ানে বন্দেগান নামক একটি নতুন বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়।

১১. চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতিঃ সুলতান রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে বহু চিকিৎসালয় স্থাপন করেন। দিল্লীতে দিওয়ানে শেফা নামে একটি হাসপাতাল স্থাপিত হয়। সুদক্ষ চিকিৎসক ও হেকিমগণ এখানে রােগীদের চিকিৎসা করতেন।

১২. জনকল্যাণমূলক ব্যবস্থাঃ ঐতিহাসিক শামসে সিরাজ আফিফের মতে, ফিরােজ শাহ জনসাধারণের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবের জন্য দিওয়ানে খয়রাত, দিওয়ানে নকীব ও অন্যান্য কল্যাণকর সংস্থা গঠন করেন।

১৩. ইসলামী শাসন কাঠামােঃ ফিরােজ শাহ তুঘলক ইসলামী আইনে শাসনকার্য পরিচালনার পক্ষপাতী ছিলেন। তাই তিনি ধর্মনিরপেক্ষতার বদলে ইসলামী। শাসনব্যবস্থা কায়েম করেন।

১৪. স্থাপত্যশিল্পঃ তিনি ফিরােজাবাদ নামে দিল্লীর নিকটেই একটি নতুন রাজধানী স্থাপন করেন। এছাড়া ফতেহাবাদ ও জৌনপুর শহর এবং বিখ্যাত বেগমপুর মসজিদসহ অসংখ্য মসজিদ নির্মাণ করেন। ঐতিহাসিক তথ্য থেকে জানা যায়, তিনি ৩০টি রাজপ্রাসাদ, ২০০টি পান্থশালা, ৫টি হাসপাতাল, ২০০টি সেতু নির্মাণ করেন।

১৫. বাগান নির্মাণঃ ঐতিহাসিক লেনপুল বলেন, ফিরােজ শাহ দিল্লীর উপকণ্ঠে ১২০০ নতুন বাগান নির্মাণ এবং ৩০টি পুরাতন বাগান সংস্কার করেন। তার এরূপ পৃষ্ঠপােষকতার ফলে কৃষি খাত থেকে বছরে ১০ কোটি টাকা রাজকোষে জমা হতাে। শুধু বাগানগুলাে থেকেই সুলতান বছরে ১৮০ কোটি টাকা রাজস্ব সগ্রহ করতেন।

১৬. শিক্ষা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপােষকতাঃ সুলতান ফিরােজ শাহ শিক্ষা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপােষকতা করে ইতিহাসে অমর হয় আছেন। তিনি শিক্ষা প্রসারের জন্য অসংখ্য স্কুল, কলেজ ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। তার পৃষ্ঠপােষকতায় ঐতিহাসিক শামসে সিরাজ আফিফ ও জিয়াউদ্দিন বারানী তারিখে ফিরােজ শাহী নামে দুটি ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করেন।

১৭. ধর্মীয় সংস্কারঃ ফিরােজ শাহ শরীয়ত মােতাবেক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তােলেন এবং ইসলামী আইন চালু করেন। তিনিই সর্বপ্রথম বিধর্মীদের জিযিয়া এবং মুসলমানদের যাকাতদান বাধ্যতামূলক করেন। পাশাপাশি অন্যান্য ধর্মের প্রতিও তিনি যথেষ্ট উদারতা প্রদর্শন করেন।

১৮. ঋণ মওকুফঃ পূর্ববর্তী সরকারের আমলে দুর্ভিক্ষের সময় প্রজাদের তৎকালীন সুলতান দু’কোটি তঙ্কা ঋণ সাহায্য করেছিলেন। ফিরােজ শাহ প্রজাদের দুঃখ-দুর্দশা বিবেচনা করে সরকারি ঋণ মওকুফ করে দেন।

১৯. প্রজাদের উন্নতিঃ ঐতিহাসিক শামসে সিরাজ আফিফের ভাষায়, “ধন সম্পত্তি, ঘােড়া এবং আসবাবপত্রে সকলের গৃহ ভরে ওঠে। প্রত্যেকের সম্পদ বৃদ্ধি হতে থাকে এবং সকলেই সুখ স্বাচ্ছন্দ্যে কালাতিপাত করে।”

২০. চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যঃ ফিরােজ শাহ তুঘলক ইতিহাসে এক মহাব্যক্তিত্বের অধিকারী। তার শাসনামলে বিভিন্ন উন্নয়ন, সংস্কার, জনসেবা ও স্থাপত্যশিল্পের বিকাশ ঘটেছিল। এসব সম্ভব হয়েছিল তার উন্নত চরিত্র বৈশিষ্ট্যের কারণে।

তুঘলক বংশের পতনে তার ভূমিকাঃ

ভারত উপমহাদেশে মুসলিম শাসনব্যবস্থার ইতিহাসে তুঘলক বংশের ৯৩ বছরের শাসনকাল একটি স্মরণীয় অধ্যায়। এতদসত্ত্বেও কালপরিক্রমায় তুঘলক বংশেরও পতন ঘটে। আর এ পতনের পেছনে ফিরােজ শাহ তুঘলকের দায়-দায়িত্ব নিম্নে উল্লেখ করা হলাে-

১. কেন্দ্রীয় শাসনের দুর্বলতাঃ সুলতান ফিরােজ শাহ ছিলেন অত্যধিক কোমল ও দুর্বল ব্যক্তিত্বের অধিকারী। ফলে বিদ্রোহীদের প্রতি কঠোর নীতি গ্রহণে তিনি সক্ষম হননি। মুহাম্মদ বিন তুঘলকের মৃত্যুর পর সাম্রাজ্যে যে বিশৃঙ্খলার উদ্ভব হয়েছিল। তিনি তা শক্ত হাতে দমন করে শান্তি সংহতি ফিরিয়ে আনার কোনাে ফলপ্রসূ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেননি। সম্প্রসারণবাদে তার নির্লিপ্ততার কারণে দাক্ষিণাত্য দিল্লীর প্রভুত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে কালক্রমে তুঘলক বংশে পতন ঘটে।

২. দুর্বল শাসননীতিঃ ফিরােজ শাহ তুঘলকের শাসননীতি ইস্পাত কঠোর ছিল না। পরন্তু তিনি দক্ষ সেনাপতি এবং বিজেতা শাসকও ছিলেন না। তবে জনসাধারণের মঙ্গল সাধনই তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল।

৩. চারিত্রিক দুর্বলতাঃ ফিরােজ শাহ তুঘলক ছিলেন দুর্বল ব্যক্তিত্বের লােক। ফলে বিদ্রোহীদের ব্যাপারে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি।

৪. জায়গির প্রথার কুফলঃ ফিরােজ শাহ কর্তৃক জায়গির প্রথা প্রবর্তনের ফলে অভিজাতরা স্ব-স্ব এলাকায় প্রভাবশালী হয়ে পরবর্তীতে তুঘলক বংশের শাসনের প্রতি বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।

. ক্রীতদাস প্রথার কুফলঃ সুলতান ১৮০০০০ ক্রীতদাসদের ভরণপােষণের ফলে একদিকে যেমন রাজকোষের অর্থের শুধু অপচয় করেন তেমনি তাদের নানারূপ অনাচার ও ব্যভিচার কালক্রমে তুঘলক বংশের পতন ত্বরান্বিত করে।

৬. অর্থনৈতিক সংকটঃ সুলতান সিংহাসনে বসার পর বিভিন্ন কর রহিত করেন। অন্য দিকে বিভিন্ন জনহিতকর কার্য সমাধান করতে গিয়ে রাজকোষ শুন্য করে ফেলেন। ফলে তুঘলক বংশ অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়ে।

৭. সমর শক্তির দুর্বলতাঃ সুলতান সামরিক বিদ্যায় ছিলেন দুর্বল। তার শাসনকালে সামরিক বাহিনীতে বংশানুক্রমিকভাবে চাকরির অধিকার প্রদানের ফলে সৈন্যদের দক্ষতা, যােগ্যতা ও উপযুক্ততা শিথিল হয়ে পড়ে। যা তুঘলক সাম্রাজ্যের স্থায়ীত্বের মূলে কুঠারাঘাত হানে।

উপসংহারঃ ফিরােজ শাহ তুঘলকের কতিপয় পদক্ষেপ দিল্লী সালতানাতের ভিত দুর্বল করলেও সামগ্রিকভাবে তিনি ছিলেন একজন সফল জনকল্যাণকামী শাসক। তাই ঐতিহাসিক উইল্স হেগ বলেন- The reign of Firoz closes the most brilliant epoch of Muslim rule in India before the reign of Akbar.

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক