মুহাম্মদ ঘুরীর আক্রমণের প্রাক্কালে ভারতের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার বর্ণনা দাও


প্রশ্নঃ মুহাম্মদ ঘুরীর আক্রমণের প্রাক্কালে ভারতের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার বর্ণনা দাও।

উপস্থাপনাঃ মুহাম্মদ ঘুরীর বিজয় অভিযানের পূর্বে ভারতের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশ ছিল অরাজকতায় পূর্ণ। তখন ভারতে মুসলিম বিজয়ের জন্য ছিল সম্পূর্ণ অনুকূল অবস্থা। সেই সুযােগ গ্রহণ করে তিনি ভারতে স্থায়ী মুসলিম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার নিমিত্ত ভারত আক্রমণ করেছিলেন।

মুহাম্মদ ঘুরীর আক্রমণের প্রাক্কালে ভারতের রাজনৈতিক অবস্থাঃ মুহাম্মদ ঘুরীর ভারত আক্রমণের পূর্বে উত্তর ও পশ্চিম ভারতে তিনটি বিদেশি রাজ্য ও বহুসংখ্যক রাজপুত রাজ্য বিদ্যমান ছিল। এসব রাজ্যের তদানীন্তন রাজনৈতিক অবস্থা ছিল নিম্নরূপ-

১. রাজনৈতিক অনৈক্যঃ উত্তর পশ্চিম ভারতের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের রাজপুতরা সামরিক দিক হতে শক্তিশালী ছিল; কিন্তু তাদের মধ্যে জাতিভেদ প্রথার কঠোরতার জন্য রাজপুত রাজ্যগুলাের মধ্যে রাজনৈতিক একতা ছিল না।

২. সামরিক দুর্বলতাঃ ভারতে বড় ধরনের কোনাে আক্রমণ ঠেকাবার মতাে কেন্দ্রীয় কোনাে শক্তি তখন ছিল না। সুলতান মাহমুদের বার বার আক্রমণের ফলে এ দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে যায়।

৩. যুদ্ধ বিগ্রহে বিধ্বস্ততাঃ এদের পরস্পর যুদ্ধ বিবাদ বিশৃঙ্খলা লেগেই থাকত। সেখানের সামন্ততান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার নানা দুর্বলতা ছিল। রাজাদের মধ্যে পরস্পর বিবাদ লেগে থাকত এবং একে অন্যের রাজ্য দখলের চেষ্টা করত।

৪. গজনী সম্রাটদের অযােগ্যতাঃ গজনী বংশের শেষ সুলতান খসরু মালিক ছিলেন খুবই অযােগ্য। মুহাম্মদ ঘুরী তাকে খুব সহজে পরাজিত করেন।

৫. হিন্দু রাজাদের পারস্পরিক অসহযােগিতাঃ কনৌজের গাঢ়বাল বংশের শেষ রাজা জয়চাদ মুসলমানদের সাথে যুদ্ধে রাজপুতদের পক্ষে পৃথিরাজকে সাহায্য করেননি। পরে মুহাম্মদ ঘুরী তাকেও পরাস্ত করেন। এভাবে রাজপুতগণ দ্বাদশ শতকের দিকে সামন্ততান্ত্রিক দুর্বলতায় বিভক্ত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

৬. রাজনৈতিক অরাজকতাঃ উত্তরপূর্ব ভারতের হিন্দু রাজন্যবর্গের মধ্যে চরম রাজনৈতিক অরাজকতা বিরাজ করছিল। শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসনের অনুপস্থিতিতে ভারতে ক্ষুদ্র রাজ্যের মধ্যে কোনাে এক্য ছিল না। পরস্পরের মধ্যে কলহ কোন্দল, গহয়, বিশ্বাসঘাতকতা, প্রতিহিংসা বিদ্যমান ছিল। মুহাম্মদ ঘুরীর ভারত অভিযানের সময় তারা সংঘবদ্ধ হতে পারেনি।

মুহাম্মদ ঘুরীর আক্রমণের প্রাক্কালে ভারতের সামাজিক অবস্থাঃ এ সময় রাজনৈতিক অনেক্য ও বিশৃঙ্খলার সাথে সামাজিক দূরবস্থাও প্রকট হয়ে ওঠে। যেমন-

১. ঘণ্য জাতিভেদ প্রথাঃ প্রচণ্ড জাতিভেদ প্রথার কারণে জীবনে জাতীয়তাবােধ ও নাগরিক একতা ছিল না। জাতিভেদ প্রথা মানুষের ব্যক্তিত্ববােধ ও সামাজিক মূল্যবােধ বিনষ্ট করে। ফলে দেশাত্মবােধের অভাব পরিলক্ষিত হয়।

২. হিন্দু সমাজ ব্যবস্থাঃ এ সময় হিন্দু সমাজ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এ চারটি শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। নিম্নে এদের সংক্ষিপ্ত বিবরণ প্রদত্ত হলাে-

ক. ব্রাহ্মণঃ ব্রাহ্মণরা সমাজের সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী ছিলেন। তারা নৃপতিদের মন্ত্রী ও পরামর্শক হিসেবে নিযুক্ত হতেন। তাদের অধিকাংশই শিক্ষা ও ধর্মকর্মে নিযুক্ত থাকতেন। দার্শনিক ও পুরােহিত হিসেবে তারা বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন।

খ. ক্ষত্রিয়ঃ ক্ষত্রিয়দের দায়িত্ব ছিল শাসনকার্য পরিচালনা ও দেশ রক্ষা। ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের মধ্যে মােটামুটি সুসম্পর্ক বজায় ছিল।

গ. বৈশ্যঃ বৈশ্যরা ছিল সমাজের তৃতীয় স্তরে। ব্যবসায়-বাণিজ্য ছিল তাদের পেশা। রাজকার্যে তারা কোনােরূপ অংশগ্রহণ করতে পারত না।

ঘ. শূদ্রঃ শুদ্ররা ছিল সমাজের চতুর্থ ও সর্বনিম্ন স্তরে। তারা সাধারণত কৃষি ও শিল্পকার্যে নিযুক্ত থাকত। ‘বিল্লালচরিত’ থেকে জানা যায় যে, রাজা ইচ্ছা করলেই কোনাে শ্রেণিকে সমাজে উন্নত বা অবনত করতে পারতেন।

৩. পেশাজীবী শ্রেণিঃ সমাজের বাইরে আরাে অনেক পেশাজীবী লােক বাস করত। যেমন জেলে, কর্মকার, তাঁতি, মালি প্রভৃতি। আরাে নিম্ন পর্যায়ের ছিল ডােম, চণ্ডাল, হাঁড়ি এদের সাথে বিবাহ, খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ এবং স্পর্শ নিষিদ্ধ থাকায় সামাজিক একতার সুযােগ ছিল না।

৪. অস্পর্শনীতিঃ কোনাে যুদ্ধকালে মুসলমানদের হাতে বন্দি হলে তাকে আর হিন্দু সমাজে গ্রহণ করত না। ফলে বাধ্য হয়ে তাকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হতাে। এ জাতিভেদ প্রথার কারণে বিদেশি আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য যে একতা প্রয়ােজন ছিল তা বিনষ্ট হয়।

উপসংহারঃ মুহাম্মদ ঘুরীর আক্রমণের প্রাক্কালে ভারতের রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে যদিও তমসাচ্ছন্ন পরিবেশ নেমে এসেছিল তবুও তিনি বিজিত রাজ্যগুলাের সমন্বয়ে এক বিরাট মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন। তার এ স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হওয়ায় তিনি বিশ্বের ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক