অথবা, বিবর্তনের সপক্ষে বৈজ্ঞানিক প্রমাণগুলাে উপস্থাপন কর। বিবর্তন ও বিপ্লবের মধ্যে সাদৃশ্য তুলে ধর।
ভূমিকাঃ বিশ্বজগৎ সর্বদাই পরিবর্তনশীল। বিভিন্ন সৃষ্টির মধ্যে এ পরিবর্তন চিরন্তন। গ্রিক দার্শনিক হিরাক্লিটাস জগতের এ পরিবর্তন লক্ষ্য করে একেই সর্বাপেক্ষা গুরুত্ব দিয়ে বলেছিলেন, পরিবর্তনই একমাত্র সত্য। কিন্তু শুধু পরিবর্তন নয়, সুশৃঙ্খলভাবে পরিবর্তনই জগতের ধর্ম। এ পরিবর্তন ধারাবাহিক, এবং ধারাবাহিকতার মধ্যে আমরা বিবর্তনের আভাস পাই। ফলে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন বিবর্তনবাদ।
বৈজ্ঞানিক প্রমাণঃ বিবর্তনবাদ বৈজ্ঞানিক মতবাদ। বিভিন্ন বিজ্ঞান থেকে বিবর্তনবাদ নিজমতের সপক্ষে যুক্তি ও প্রমাণের অবতারণা করেছেন। জগতের গঠন ও প্রমাণের পর বিবর্তনবাদ এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, জগৎ হলাে, ক্রমবিবর্তনের ফল। বিবর্তনের মধ্য দিয়েই সরল অবস্থা থেকে জগৎ জটিল পর্যায়ে এসে উপস্থিত হয়েছে।
বৈজ্ঞানিক মনােবৃত্তির অনুপস্থিতিতে এবং ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের প্রাধান্যের কারণে মধ্যযুগে বিবর্তনের ধারণা বিকশিত হতে না পারলেও আধুনিক যুগে ডেকার্ট, লাইবনিজ, কান্ট, স্পিনােজা, ডারউইন, স্পেন্সারসহ আধুনিক বিবর্তনবাদীরা এবং কয়েকজন মুসলিম দার্শনিক এ সম্পর্কে যে তত্ত্ব উপস্থাপন করেছেন এবং বিজ্ঞানীরা যে বৈজ্ঞানিক যুক্তি-প্রমাণ হাজির করেছেন তার আলােকে বিবর্তনবাদ সাম্প্রতিককালে একটি অধিকতর গ্রহণযােগ্য ও প্রতিষ্ঠিত মতবাদ হিসেবে স্থান লাভ করেছে। বিজ্ঞানীরা বিবর্তনবাদের সমর্থনে কতকগুলাে বিজ্ঞানসম্মত তথ্য উপস্থাপন করেছেন। এই তথ্যগুলাে হল, জ্যোতির্বিদ্যা, ভূবিদ্যা, জীববিদ্যা, সমাজবিদ্যা ইত্যাদি। নিম্নে বিবর্তনবাদের সপক্ষে বৈজ্ঞানিক প্রমাণগুলাে আলােচনা করা হলাে-
(১) জ্যোতির্বিদ্যাঃ জ্যোতির্বিদ্যা অনুসারে এই জগৎ একদিনে সৃষ্টি হয়নি। বহু শতাব্দীব্যাপী বিবর্তনের ফলে জগৎ বর্তমান অবস্থায় উপনীত হয়েছে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বলেন যে, বর্তমানে সৌরজগৎ বলতে আমরা যা বুঝি তা একাদিন তরল অগ্নিকুণ্ড ছিল। দীর্ঘকাল ধরে এই অগ্রিময় পদার্থ ঠাণ্ডা হতে হতে গ্ৰহজগৎ সৃষ্টি হল। গ্ৰহজগৎ আরও শীতল হয়ে উপগ্রহের সষ্টি হল। ক্রমশ পৃথিবীর বুকে পাহাড়, পর্বত, নদ-নদী সৃষ্টি হলাে। বহু বছর পর পৃথিবীতে প্রাণীর আবির্ভাব ঘটেছে।
(২) ভূবিদ্যাঃ পৃথিবীর অভ্যন্তর প্রদেশে মাটির বিভিন্ন স্তর পাওয়া যায়। ইতিহাস পর্যালােচনা করলে দেখা যায় যে, এই স্তরগুলাে একদিনে সৃষ্টি হয়নি। এগুলাে বহুদিনব্যাপী পরিবর্তনের ফল। এ স্তরসমূহ একসময় তরল পদার্থ ছিল। বারে বারে কঠিন অবস্থাপ্রাপ্ত হয়ে বর্তমান অবস্থায় পৌছেছে। মাটির বিভিন্ন স্তর পরীক্ষা করলে দেখা যায়, মাটির মধ্যম স্তরে জৈব শিলা (Fossils) দেখতে পাওয়া যায় এবং এ থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, পৃথিবীর বুকে বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন ধরনের জীবজন্তু ছিল, যেগুলাে এখন আর নেই, পৃথিবীর বুকে বিলীন হয়ে গেছে। মাটির বিভিন্ন স্তর প্রমাণ দেয় যে, আজকের এই পৃথিবী বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বর্তমান অবস্থায় পৌছেছে। ভূবিদ্যার এই সিদ্ধান্ত বিবর্তনবাদেরই প্রমাণ দেয়।
(৩) জীববিদ্যাঃ জীববিদ্যা অনুসারে, জেলরি মত একধরনের অঙ্গপ্রত্যঙ্গহীন প্রাণীই পৃথিবীর আদিমতম জীব। এ ধরনের জীব থেকে ক্রমবিকাশের ফলে মাছ ও জলজ উদ্ভিদের জন্ম হয়েছে। মাছের ক্রমবিবর্তনের ফলে জলজ প্রাণী, উভচর প্রাণী, পাখি ও স্তন্যপায়ী প্রাণী কালক্রমে অন্য জাতিতে পরিণত হয়েছে। দেহতত্ত্ব আলােচনা করলে দেখা যায় যে, বানরের দেহের সাথে মানুষের দেহের অনেক সাদশ্য আছে। এ সাদশ্য থেকেই বিজ্ঞানী ডারউইন অনুমান করেন যে নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বনের জাতি থেকে মানুষের আবির্ভাব হয়েছে। সুতরাং জীববিদ্যা ও দেহতত্ত্ব প্রমাণ করে যে পৃথিবী বিবর্তনের ফলমাত্র।
(৪) সমাজবিদ্যার দৃষ্টিকোণ থেকে প্রমাণঃ সমাজবিজ্ঞানে মানুষের বিশ্বাস, রীতি-নীতি, আচার অনুষ্ঠান, সমাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের বিবর্তনের ইতিহাস পাওয়া যায়। মানুষের সমাজব্যবস্থা বিভিন্ন যুগে এবং বিভিন্ন অবস্থায় বিভিন্ন সমাজের বিবর্তনের মাধ্যমে নতুন রূপ পরিগ্রহ করত। আজকের এ সমাজ রাতারাতি গড়ে উঠেনি। বহু তপস্যা, বহু উত্থান ও বহু বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এর বর্তমান পরিণতি সম্ভব হয়েছে। সুতরাং সমাজবিদ্যার সিদ্ধান্ত হলাে, জগৎ ধীর পরিবর্তনশীল এবং ক্রমবিকাশ ও ক্রমােন্নতির মধ্য দিয়ে বর্তমান রূপ পরিগ্রহ করেছে। সমাজের নিয়ম পরিবর্তিত হয়ে নতুন নিয়ম বলবৎ হচ্ছে। কাজেই দেখা যাচ্ছে, বিবর্তনের মধ্য দিয়ে সৃষ্ট জগৎবর্তমান অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। এগুলাে ধীর ক্রমবিবর্তনের ফল। অনুরূপভাবে মনােবিজ্ঞান, ভূগােল ইত্যাদি বিজ্ঞানও বিভিন্ন তথ্যের সাহায্যে বিবর্তনকে প্রমাণ করেছে। সুতরাং উপরিউক্ত যুক্তি-প্রমাণগুলাে এটাই প্রমাণ করে যে বিবর্তনবাদ একটি বৈজ্ঞানিক মতবাদ।
বিবর্তন ও বিপ্লবের মধ্যে পার্থক্যঃ বিবর্তনের ক্ষেত্রে যেমন পরিবর্তন ও পরিণতি আছে, বিপ্লবের ক্ষেত্রেও তেমনি পরিবর্তন এবং পরিণতি আছে। তা সত্ত্বেও বিবর্তন ও বিপ্লবের মধ্যে বেশ পার্থক্য রয়েছে। নিম্নে এ পার্থক্যগুলাে আলােচনা করা হলাে-
প্রথমত, যা আকস্মিক ও অস্বাভাবিকভাবে ঘটে সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে বিরাট পরিবর্তন সাধন করে, তাকে বৈপ্লবিক পরিবর্তন বলে। পক্ষান্তরে বিবর্তন আকস্মিক ও অস্বাভাবিকভাবে নয় বরং ক্রমিক ও ধীরে ধীরে বিভিন্ন স্তরের মধ্য দিয়ে এ পরিবর্তন কাজ করে যায়। তাই বিবর্তনের পরিবর্তন অত্যন্ত সহজ, স্বাভাবিক ও সময়সাপেক্ষ।
দ্বিতীয়তঃ বৈপ্লবিক পরিণতির পেছনে ক্রমবিকাশের কোনাে ইতিহাস নেই। কিন্তু বিবর্তন যে পরিণতি নিয়ে আসে তার পেছনে ক্রমবিকাশের ইতিহাস রয়েছে।
তৃতীয়ত, বিবর্তন সম্পূর্ণ নৈসর্গিক বা প্রাকৃতিক ব্যাপার। এ ব্যাপারে মানুষের কোনাে হাত নেই। এটা মানুষের দ্বারা সৃষ্ট বা নিয়ন্ত্রিত বা পরিচালিত নয়। পক্ষান্তরে বিপ্লব মানুষের দ্বারা পরিচালিত, নিয়ন্ত্রিত ও সৃষ্ট; যেমন- ফরাসি বিপ্লব, রুশ বিপ্লব ইত্যাদি।
চতুর্থত, বিবর্তন সর্বব্যাপক। এমন কোনাে বস্তু নেই যার উৎপত্তির ইতিহাস বিবর্তনের ইতিহাস নয়। পক্ষান্তরে বিপ্লব প্রধানত সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ।
ষষ্ঠত, বিপ্লবের মধ্যে আছে আকস্মিকতা, আর বিবর্তনের মধ্যে আছে ধারাবাহিকতা। বিপ্লবের ফলে ব্যক্তি, সমাজ ও জাতির জীবনে আসে প্রত্যাশিত পরিবর্তন। কিন্তু বিবর্তনের প্রক্রিয়া স্বাভাবিক ও ধারাবাহিক।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, বিবর্তন ও বিপ্লব মূলত বিপরীতধর্মী মতবাদ। তবে বিপরীতধর্মী হলেও এদের আলাদা করে দেখা হয় না। বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন হচ্ছে, সেটাই কালক্রমে বিবর্তনবাদে পরিণত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বিপ্লবের চেয়ে বিবর্তনবাদই দর্শনে সর্বাধিক গ্রহণযােগ্য এবং সন্তোষজনক মতবাদ।
0 মন্তব্যসমূহ