সুলতান কুতুবুদ্দিন আইবেকের জীবনী ও কৃতিত্ব আলােচনা কর


প্রশ্নঃ সুলতান কুতুবুদ্দিন আইবেকের জীবনী ও কৃতিত্ব আলােচনা কর।
অথবা, কুতুবুদ্দিন আইবেকের চরিত্র ও কৃতিত্ব আলােচনা কর।

উপস্থাপনাঃ ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসে কুতুবুদ্দিন আইবেক এক অবিস্মরণীয় নাম। মুহাম্মদ ঘুরী সামরিক অভিযান পরিচালনা করে ভারত উপমহাদেশে যে বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন, পরবর্তীকালে আইবেক তার স্থায়িত্ব বিধান করেন। দাস হিসেবে জীবন শুরু করলেও নিজ চরিত্র ও প্রতিভা গুণে তিনি খ্যাতির উচ্চ শিখরে স্থান করে নিয়েছিলেন। তার প্রশংসায় ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন- Aibak wgs g powerful and capable ruler always maintained high character.

কুতুবুদ্দিন আইবেকের জীবনীঃ

১. পরিচিতিঃ ভারত উপমহাদেশে তুর্কি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা কুতুবুদ্দিন আইবেক ছিলেন জাতিতে তুর্কি ও তুর্কিস্তানের অধিবাসী। আইবেক ছিল তার ডাক নাম। এর অর্থ-চন্দ্র দেবতা। খুব ছােট বেলায় একদল অপহরণকারী তাকে তার পরিবার থেকে অপহরণ করে দাস হিসেবে বিক্রি করে। নিশাপুরের কাযী ফখরুদ্দীন আবদুল আযীয কুকী তাকে ক্রয় করে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তােলেন।

২. মুহাম্মদ ঘুরীর তত্ত্বাবধানেঃ কাযীর মৃত্যুর পর তার ছেলেরা তাকে আবার এক বণিকের কাছে বিক্রি করে দেয়। ঐ বণিক তাকে পুনরায় মুহাম্মদ ঘুরীর নিকট বিক্রি করে দেন। কুতুবুদ্দিন ছিলেন অত্যন্ত প্রতিভাশীল। স্বীয় সাহসিকতা ও দক্ষতা গুণে অল্পকালের মধ্যেই তিনি মুহাম্মদ ঘুরীর প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন।

৩. সেনাবাহিনীতে যােগদানঃ কুতুবুদ্দিন আইবেক ছােট বেলা থেকে সামরিক শিক্ষায় বিশেষ পারদর্শিতা লাভ করেন। ফলে মুহাম্মদ ঘুরী তাকে প্রথমে সৈনিক পদে নিযুক্ত করেন। শীঘ্রই তিনি নিজ যােগ্যতায় আমীর-ই আঘুর বা অশ্বারােহী বাহিনীর নায়ক হন। ঘুরীর ভারত অভিযানে তিনি তার সাথে ছিলেন।

৪. মুহাম্মদ ঘুরীর প্রতিনিধিত্বঃ দাস হিসেবে জীবন শুরু করলেও সময়ের বিবর্তনে তিনি রাজ্য ও রাজক্ষমতার অধিকারী হন। ১১৯২ খ্রিস্টাব্দে তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে বিজয় লাভের পর ঘুরী স্বদেশে প্রত্যাবর্তনকালে তার সুযােগ্য সেনাপতি কুতুবুদ্দিন আইবেককে উত্তর ভারতের বিজিত অঞ্চলসমূহের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন।

৫. রাজ্য বিজয়ঃ আইবেক ক্ষমতা গ্রহণ করার পর ১১৯২ খ্রিস্টাব্দে হানসি, মিরাট, দিল্লী, গােয়ালিয়র, কোহল, বারানসী, কালিঞ্জর ও কনৌজ জয় করে সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটান। অতঃপর তিনি রাজধানী লাহাের থেকে দিল্লীতে স্থানান্তর করেন।

৬. ক্রীতদাস থেকে দিল্লীর সুলতানঃ ঘুরীর মৃত্যুর পর দাসত্বের জীবন অতিক্রম করে শাসকের জীবন শুরুর প্রথম পর্যায়ে ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি দিল্লী সালতানাতের ক্ষমতা গ্রহণ করে নিজেকে দিল্লীর প্রথম স্বাধীন সুলতান ঘােষণা করেন।

৭. বৈবাহিক জীবনঃ দাস বংশের স্থায়িত্ব সুনিশ্চিত করার জন্য তিনি অপরাপর দাসদের সাথে বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপন করেন। তিনি মুহাম্মদ ঘুরীর শক্তিশালী ক্রীতদাস তাজুদ্দিন ইয়ালদুজের ভগ্নিকে বিয়ে করেন এবং নিজের ভগ্নি ও কন্যাকে অপর দুই ক্রীতদাস কুবাচা ও ইলতুৎমিশের সাথে বিয়ে দিয়ে ক্ষমতা বৃদ্ধি করেন।

৮. কুতুবুদ্দিনের মৃত্যুঃ দিল্লী সালতানাতের প্রতিষ্ঠাতা কুতুবুদ্দিন আইবেক ১২০৬ থেকে ১২১০ সাল পর্যন্ত মাত্র ৪ বছর রাজত্ব করেন। ১২১০ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে শরীরচর্চা করার সময় অকস্মাৎ মৃত্যুবরণ করেন। তাকে লাহােরে সমাধিস্থ করা হয়।

কুতুবুদ্দিন আইবেকের চরিত্রঃ

১. স্বাধীনচেতাঃ কুতুবুদ্দিন আইবেক ব্যক্তিগতভাবে একজনের ক্রীতদাস থাকা সত্ত্বেও অত্যন্ত স্বাধীনচেতা ছিলেন। পরবর্তীতে সুলতান হিসেবে সিংহাসনে আরােহণ করার পর বীরত্বের সাথে স্বাধীনতার মনােভাব প্রকাশ করেন।

২. উচ্চাকাঙ্ক্ষীঃ কুতুবুদ্দিন আইবেক উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। তাই আমরা দেখতে পাই সামান্য একজন ক্রীতদাস থেকে তিনি দিল্লীর প্রথম স্বাধীন সুলতান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তার জীবনে এটাই বড় সাফল্য।

৩. উদ্যমী ও সাহসীঃ আইবেক ছিলেন উদ্যমী ও সাহসী পুরুষ। তিনি অনেক অসম্ভব কাজকে সাহসিকতার সাথে সম্ভব করতেন নির্ভয়ে। সাহসিকতা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, আত্মবিশ্বাস ও বিপদে ধৈর্যধারণ তার জীবনে সাফল্যের পথকে অনেক সুগম করেছিল।

৪ ন্যায়বিচারকঃ ঐতিহাসিক আর. সি. মজুমদার বলেন, সুলতান কুতুবুদ্দিন যেমনি ছিলেন যােগ্য শাসক, তেমনি ছিলেন একজন ন্যায়বিচারক। তার থেকে উঁচু-নীচু সকল শ্রেণির জনগণ ন্যায়বিচার পেত।

৫. উদারতা ও দানশীলতাঃ দানশীলতায় কুতুবদ্দিন আইবেক চিলের দ্বিতীয় হাতেম তাঈ। মুক্ত হস্তে দান করতেন বলে তিনি ‘লাখবখশ’ নামে খতি তার করেন। এছাড়া উদারতা ও দানশীলতার জন্য সমসাময়িক লেখকগণ তাকে বিভিন্ন উপাধিতে ভূষিত করেন। তিনি গরিব-দুঃখীদের লক্ষ লক্ষ টাকা দান করেন।

৬. ধর্মপরায়ণঃ কুতুবুদ্দিন একজন ধর্মপরায়ণ সুন্নী মুসলমান ছিলেন। তিনি দ্বীন ইসলাম প্রচারে উৎসাহবােধ করতেন। তবে অমুসলমানদের প্রতিও তিনি সদয় ছিলেন।

৭. ইসলামের সেবকঃ ড. এ. বি. এম. হাবিবুল্লাহ বলেন, কুতুবুদ্দিন আইবেক ইসলামের একনিষ্ঠ সেবক এবং চারিত্রিক গুণাবলির জন্য সমসাময়িকদের নিকট শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন।

৮. চরিত্রবান শাসকঃ কুতুবুদ্দিন একজন দক্ষ, শক্তিশালী ও চরিত্রবান শাসক ছিলেন। সাম্রাজ্যে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে তিনি তার চরিত্র, যােগ্যতা ও প্রতিভার পরিচয়। রেখেছিলেন।

৯. শ্রেষ্ঠ শাসকঃ কুতুবুদ্দিন ছিলেন অতিশয় ন্যায়পরায়ণ শাসক ও সুবিচারক। তিনি তার সাম্রাজ্যে জনগণের শান্তি সমৃদ্ধির জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালান।

১০. যােগ্য ও প্রতিভাবানঃ কুতুবুদ্দিন আইবেক যােগ্যতাসম্পন্ন শাসক ছিলেন। মুহাম্মদ ঘুরীর ভারত অভিযানের সময় তার যােগ্যতা ও প্রতিভা ঘুরীকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করেছিল। ফলে ঘুরী তাকে ভারতে বিজিত অঞ্চলসমূহের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন।

কুতুবুদ্দিন আইবেকের কৃতিত্বঃ

১. সুলতান উপাধিঃ ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদ ঘুরী নিহত হলে,তার ভ্রাতুপুত্র গিয়াসুদ্দিন মুহাম্মদ কুতুবুদ্দিনকে সুলতান উপাধি প্রদান করে এক ফরমান জারি করেন। ফলে তিনি দিল্লীর প্রথম স্বাধীন সুলতান হিসেবে দিল্লীর সিংহাসনে আরােহণ করেন।

২. বিচক্ষণ সেনাপতিঃ মুহাম্মদ ঘুরীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে কুতুবুদ্দিন বিভিন্ন যুদ্ধাভিযানে সাফল্য অর্জন করেন। এর ফলে তিনি একজন বিচক্ষণ সমরনায়ক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

৩. ভারত অভিযানঃ মুহাম্মদ ঘুরীর ভারত অভিযানের সময় কুতুবুদ্দিন সর্বদা তার সাথে ছিলেন এবং মুলতান, সিন্ধু, পাঞ্জাব ও পৃথ্বিরাজের বিরুদ্ধে ঘুরীর বিজয়ে তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন।

৪. রাজ্য বিস্তারঃ মুহাম্মদ ঘুরীর প্রতিনিধি হিসেবে কুতুবুদ্দিন ভারতে রাজ্য বিস্তারে সুদৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি হিন্দু রাজ্য হানসি, সামানা, আজমীর, মীরাট, দিল্লী, কনৌজ, গুজরাট, বদায়ুন, কালিঞ্জর প্রভৃতি অধিকার করেন।

৫. প্রশাসনিক ব্যবস্থাঃ সময় স্বল্পতার কারণে কুতুবুদ্দিন প্রশাসনিক ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারেননি। ফলে তিনি স্থানীয় এলাকার শাসনভার সরকারি কর্মচারীদের ওপর ছেড়ে দেন এবং প্রাদেশিক রাজধানী শহরগুলােতে কাযী ও সেনাধ্যক্ষের মাধ্যমে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন।

৬. সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব বিধানঃ কুতুবুদ্দিন নিজ বিচক্ষণতা, সমরকৌশল ও ন্যায়পরায়ণতা দ্বারা বহিঃশত্রুর মােকাবেলা, বিদ্রোহ দমন, বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন প্রভৃতির সাহায্যে সাম্রাজ্যকে নিরাপদ, শক্তিশালী ও উন্নত করে গড়ে তােলেন।

৭. উন্নত সামরিক সংগঠনঃ ঐতিহাসিক ফেরেশতার মতে, সামরিক ক্ষেত্রে তার কৃতিত্ব ছিল অবিস্মরণীয়, প্রশিক্ষণ, উন্নত অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ ইত্যাদির মাধ্যমে তিনি একটি দক্ষ সামরিক বাহিনী গড়ে তােলেন।

৮. জ্ঞান বিজ্ঞানঃ সাহিত্যের পৃষ্ঠপােষক ও কুতুবুদ্দিন ছিলেন জ্ঞান বিজ্ঞান ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপােষক। তার রাজসভায় শিক্ষিত সংস্কৃতিবান ব্যক্তিরা সমাদর পেতেন। তৎকালীন কবি সাহিত্যিকরা তাদের রচনায় কুতুবুদ্দিনকে মহানুভব হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। যুগশ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক হাসান নিয়ামী ‘তাজুল মাসীর’ নামক ইতিহাস গ্রন্থটি তার নামে উৎসর্গ করেছিলেন।

৯. স্থাপত্যশিল্পের পৃষ্ঠপােষকঃ ড. হাবিবুল্লাহ বলেন, তিনি দিল্লীতে কুওয়াতুল ইসলাম মসজিদ ও আজমীরে আড়াই দিনকা ঝােপড়া মসজিদ নির্মাণ করেন। তিনিই দিল্লীর বিখ্যাত কুতুব মিনার নির্মাণ কার্য শুরু করেছিলেন, কিন্তু এ কাজ শেষ করতে পারেননি।

১০. দক্ষ রণকুশলীঃ কুতুবুদ্দিন ছিলেন অসাধারণ দক্ষ রণকুশলী ও সমরনায়ক। তার সামরিক প্রতিভার প্রশংসায় ড. হাবিবুল্লাহ বলেন- A military leader of great energy and high merit.

উপসংহারঃ সুলতান কুতুবুদ্দিন আইবেক নিঃসন্দেহে ভারতবর্ষে মূর্তিমান পুরুষ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। শাসক, বিজেতা, ন্যায়পরায়ণ ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপােষক হিসেবে সমকালীন শাসকবর্গের মধ্যে তিনি ছিলেন অতুলনীয়। তাই ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ বলেছেন, তার তেজস্বিতা এবং সহকর্মীদের প্রতি তার অফুরন্ত দান বৈরী মনােভাবাপন্ন ঐতিহাসিকদের এরূপ আকর্ষণ করে যে, তারা তাকে মহানুভব ও বিজয়ী নৃপতি হিসেবে প্রশংসা না করে পারেনি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. অনেক সুন্দর করে সাজিয়ে লিখা হয়েছে। এবং ভালো কিছু গুরুত্বপূর্ণ নতুন কথা ও লিখা রয়েছে

    উত্তরমুছুন

টপিক