এরিস্টটলের মতে সর্বাপেক্ষা বাস্তবসম্মত রাষ্ট্র কী? তিনি এ রাষ্ট্রের সমর্থনে কী কী যুক্তি উপস্থাপন করেছেন?


প্রশ্নঃ এরিস্টটলের মতে সর্বাপেক্ষা বাস্তবসম্মত রাষ্ট্র কী? তিনি এ রাষ্ট্রের সমর্থনে কী কী যুক্তি উপস্থাপন করেছেন?

অথবা, এরিস্টটলের সর্বোত্তম বাস্তবধর্মী রাষ্ট্র বলতে তুমি কী বােঝ? তিনি তার সর্বোত্তম বাস্তবধর্মী রাষ্ট্রের সমর্থনে যেসকল যুক্তি উপস্থাপন করেছেন, সেগুলাে আলােচনা কর।

ভূমিকাঃ বহু প্রতিভার অধিকারী এরিস্টটল হলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পুরােধা। পৃথিবীর কোন শাস্ত্রই কারও একার মেধা বা শ্রমের ফসল নয়। সময়ের আবর্তে কালের বিবর্তনে বিভিন্ন শাস্ত্র বিভিন্ন মহান ব্যক্তিত্বের বলিষ্ঠ ছোঁয়ায় তিলে তিলে সমৃদ্ধ হয়েছে। আজকের রাষ্ট্র বিজ্ঞান যে মহান ব্যক্তির নিকট ঋণী তিনি হলেন মহামতি এরিস্টটল। রাষ্ট্রদর্শনে তিনি কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। এর মধ্যে 'The Politics' হলাে সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। এ গ্রন্থে তিনি রাষ্ট্র সম্পর্কে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা প্রদান করেন।

সর্বোত্তম বাস্তবধর্মী রাষ্ট্রঃ এরিস্টটল প্রথম শ্রেণীর রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হিসেবে রাষ্ট্রসত্তার ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। তিনি রাষ্ট্রকে একটি নৈতিক সত্তা এবং মানষের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রকাশের অন্যতম প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সর্বোত্তম রাষ্ট্র সম্পর্কে তিনি সুন্দর সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। তিনি বলেন, যে রাষ্ট্র মিশ্র সংবিধান নীতির ভিত্তিতে গঠিত ও পরিচালিত হয়, তাই সর্বোত্তম বাস্তবধর্মী রাষ্ট্র।

সর্বোত্তম রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যসমূহঃ এরিস্টটল তার 'The Politics' গ্রন্থে সর্বোত্তম বাস্তবধর্মী রাষ্ট্র সম্পর্কে সুশৃঙ্খল মতামত প্রদান করেছেন। তার ধারণাকে বিশ্লেষণ করলে নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

(১) মধ্যবিত্তের শাসনঃ এরিস্টটল তার সর্বোত্তম বাস্তবধর্মী রাষ্ট্রের ধারণায় মধ্যবিত্তের শাসনের কথা বলেছেন। তিনি মনে করেন, যে কোন ব্যাপারে মধ্যপন্থা অবলম্বন করা উত্তম। তাই সরকার ব্যবস্থা কিংবা শাসনতন্ত্রের ক্ষেত্রে এই পন্থা অবলম্বন করা উচিত। তাই তিনি মধ্যবিত্তের শাসনকে উত্তম শাসনব্যবস্থা রূপে আখ্যায়িত করেছেন।

(২) সংমিশ্রণঃ সংমিশ্রণ মহামতি এরিস্টটলের উত্তম রাষ্ট্রের একটি বিশেষ দিক। তিনি মনে করেন ধনীরা স্বভাবত ঔদ্বত্যপূর্ণ আর গরীবরা সাধারণত হীনমনা। এ কারণে তিনি সর্বোত্তম বাস্তবধর্মী রাষ্ট্রে উভয়ের সংমিশ্রণ কামনা করেছেন। কারণ তারা শাসন করতে আবার মান্য করতেও জানে।

(৩) স্থায়িত্বঃ স্থায়িত্ব সর্বোত্তম বাস্তবধর্মী রাষ্ট্রের আরেকটি বৈশিষ্ট্য। ধনিকতন্ত্রে সাধারণত শাসকগণ স্বৈরাচারিতার পথ অবলম্বন করতে পারে। পক্ষান্তরে গরীবতন্ত্রে শাসকগণ আবার অযােগ্যতার প্রমাণ দিতে পারেন। ফলে উভয় ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব কম। কিন্তু মধ্যতন্ত্র রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব দীর্ঘস্থায়ী হয়।

(৪) নিয়মতান্ত্রিক সরকারঃ এরিস্টটলের সর্বোত্তম বাস্তবধর্মী রাষ্ট্রে নিয়মতান্ত্রিক সরকারের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। তিনি এই রাষ্ট্রে যে মধ্যবিত্তশাসনের কথা বলেছেন তা প্রকৃতপক্ষে নিয়মতান্ত্রিক সরকার। এই রাষ্ট্রেশাসকের হাতে ক্ষমতা ন্যস্ত না করে আইনের ওপর ক্ষমতা ন্যস্ত করেছেন।

(৫) পরিমিত জনসংখ্যাঃ পরিমিত জনসংখ্যা তার সমর্থিত রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। তিনি বলেন, এই রাষ্ট্রের জনসংখ্যা এরূপ হবে যাতে তা আইন শৃঙ্খলাজনিত সমস্যার সৃষ্টি না করে। তিনি বলেন, রাষ্ট্রের জনসংখ্যা এমন হবে যাতে জনগণ একে অপরকে চিনতে ও জানতে পারেন।

(৬) মধ্যম আয়তনঃ এরিস্টটল এই রাষ্ট্রের সীমানা নির্ধারণ প্রসঙ্গে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করেছেন। তিনি বলেন, এই রাষ্ট্রের ভূ-খন্ডের আয়তন খুব বড় হবে না আবার খুব ছােটও হবে না। এর আয়তন হবে মাঝারি প্রকৃতির। তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্রের আয়তন এরূপ হবে যাতে প্রতিরক্ষার ব্যাপারে সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা সম্ভবপর হয়।

(৭) সমুদ্র সংলগ্ন অবস্থানঃ গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটল রাষ্ট্রের অবস্থান সম্পর্কে সুস্পষ্ট বিধান রেখেছেন। তিনি বলেন, ভৌগােলিক দিক থেকে রাষ্ট্র হবে সমুদ্রকূল সংলগ্ন। সমুদ্র সংলগ্ন হলে প্রয়ােজনে বিদেশের সাথে যথাযথভাবে যােগাযােগ সম্ভব। আবার বিদেশীদেরও অনুপ্রেবেশের দিকে নজর রাখতে হবে।

(৮) সমাজের প্রকৃতিঃ সমাজের প্রকৃতি এরিস্টটলের প্রবর্তিত রাষ্ট্রের একটি উল্লেখযােগ্য দিক। তার মতে সমাজ গঠিত হবে দু'শ্রেণীর লােকের সমন্বয়ে। এক দিকে থাকবে সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশের লােক। আর অপরদিকে থাকবে সহায়ক শ্রেণীর লােক। তারা উভয়ে রাষ্ট্রের কল্যাণে কাজ করবে।

(৯) মিশ্র নাগরিক চরিত্রঃ মিশ্র নাগরিক চরিত্র সর্বোত্তম বাস্তবধর্মী রাষ্ট্রের একটি বিশেষ দিক। এরিস্টটলের মতে রাষ্ট্রের নাগরিক চরিত্র হবে মিশ্র প্রকৃতির। তিনি বলেন, শীতপ্রধান দেশের নাগরিকগণ তেজী প্রকৃতির। আর গ্রীষ্মপ্রধান দেশের নাগরিকগণ ধীশক্তি ও নৈপুণ্যে প্রবল। কিন্তু নীতিশীতােঞ্চ অঞ্চলের নাগরিকদের মধ্যে বলবিক্রম ও নৈপুণ্যের সমাবেশ ঘটে।

(১০) নিয়ন্ত্রিত বিবাহ ব্যবস্থাঃ এরিস্টটল তার রাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্য নিয়ন্ত্রিত বিবাহ ব্যবস্থার কথা বলেছেন। তিনি বলেন, সর্বোত্তম রাষ্ট্রে বিবাহ ব্যবস্থা সরকারী আইনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হবে। রাষ্ট্র নির্ধারিত বয়সের আগে বিবাহ করা যাবে না। এরূপ ব্যবস্থা রাষ্ট্রের সুফল আনয়ন করে।

(১১) চরম অবস্থা পরিহারঃ মহামতি এরিস্টটল তার উত্তম রাষ্ট্র কল্পনায় সব রকম চরম অবস্থাকে পরিহারের কথা বলেছেন। তার মতে চরম অবস্থা পরিহার না করলে কোনাে রাষ্ট্র সঠিকভাবে পরিচালিত হতে পারে না। ফলে রাষ্ট্র অস্থায়ী হয়ে পড়ে। তাই তিনি চরম অবস্থাকে পরিহার করতে বলেছেন।

(১২) সৎ জীবন নিশ্চিতঃ এরিস্টটল সর্বোত্তম রাষ্ট্রের ব্যাখ্যায় সৎ জীবনযাপনের ওপর গুরুত্ব প্রদান করেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন যে, সৎ জীবন নিশ্চিত করাই আদর্শ রাষ্ট্রের পবিত্র দায়িত্ব। এই লক্ষ্য অর্জনে কতিপয় শর্ত থাকা আবশ্যক। সৎ জীবন ছাড়া রাষ্ট্রের নাগরিকের নিকট থেকে উত্তম কিছু আশা করা যায় না।

(১৩) উপযুক্ত আবহাওয়া স্বাস্থ্যের জন্যঃ উপযুক্ত আবহাওয়া এরিস্টটলের সর্বোত্তম বাস্তবধর্মী রাষ্ট্রের একটি বিশেষ দিক। জনস্বাস্থ্য রক্ষার জন্য তিনি উপযুক্ত জলবায়ু ও আবহাওয়ার ওপর বেশী গুরুত্ব প্রদান করেছেন। জনস্বাস্থ্য উত্তম না হলে রাষ্ট্রীয় উৎপাদন ব্যাহত হয়।

(১৪) শিক্ষাব্যবস্থাঃ জনকল্যাণের স্বার্থে আদর্শ রাষ্ট্রে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। নাগরিকগণ যাতে শিক্ষা গ্রহণের পূর্ণ সুযােগ পেতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। ন্যায়ধর্ম হবে সকলের আদর্শ। এ আদর্শে সকলকে উদ্বুদ্ধ করতে হলে শিক্ষার মাধ্যমে তাদের অভ্যাস ও যুক্তি শক্তি উন্নত করতে হবে।

(১৫) সর্বোত্তম সংবিধানঃ এরিস্টটল সংবিধানের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে মধ্যতন্ত্র বা পলিটিকে সর্বোত্তম বলে আখ্যায়িত করেছেন। তার মতে, "Polity is the best practicable state."

সমালােচনাঃ এরিস্টটল তার সর্বোত্তম রাষ্ট্রের পক্ষে যেসকল যুক্তি উপস্থাপন করেছেন তা বিভিন্নভাবে সমালােচিত হয়েছে।

(১) ভৌগলিক সীমারেখাঃ এরিস্টটল সর্বোত্তম বাস্তবধর্মী রাষ্ট্রের জন্য যে ভৌগােলিক সীমার কথা উল্লেখ করেছেন বর্তমান বৈজ্ঞানিক যুগে তা প্রযােজ্য নয়।

(২) জনসংখ্যাঃ তিনি আদর্শ রাষ্ট্রের জন্য যে জনসংখ্যার কথা বলেছেন বর্তমানে তা ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়েছে।

(৩) নাগরিক চরিত্রঃ এরিস্টটলের আদর্শ রাষ্ট্রের নাগরিকদের চরিত্র বর্তমানে কোথাও দেখা যায় না।

(৪) মধ্যতন্ত্র অস্তিত্বহীনঃ তার আদর্শ রাষ্ট্রের মধ্যতন্ত্র পৃথিবীর কোথাও দেখা যায় না।

(৫) সমাজ কাঠামাে তত্ত্বঃ তার আদর্শ রাষ্ট্রের সমাজকাঠামাে ব্যবস্থা স্পষ্ট নয়।

(৬) শিক্ষা ব্যবস্থাঃ তার আদর্শ রাষ্ট্রের পরিকল্পনা অত্যন্ত নিম্নমানের- এ ধরনের পরিকল্পনা কখনাে কারাে জন্য কল্যাণকর হতে পারে না।

(৭) বিবাহ ও সন্তান জন্মদান পদ্ধতিঃ এরিস্টটল বিবাহ ও সন্তানদান সম্বন্ধে যে বিধানের কথা বলেছেন তা অনেকাংশে অমানবিক ও দুঃখজনক।

(৮) নাগরিক চরিত্রঃ তার আদর্শ রাষ্ট্রের নাগরিকদের চরিত্র বর্তমানে কোথাও দেখা যায় না।

পরিশেষঃ এতক্ষণের আলােচনার পরিশেষে বলা যায় যে, এরিস্টটলের সর্বোত্তম বাস্তবধর্মী রাষ্ট্রে উল্লেখিত বৈশিষ্ট্যসমূহ বিদ্যমান। তার প্রবর্তিত এই রাষ্ট্রের গ্রহণযােগ্যতা যদিও দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে, তবুও উক্ত রাষ্ট্রের আলােকে এমন শাসনব্যবস্থা গড়ে তােলা যায় যা গণতন্ত্র, ধনিকতন্ত্র উভয় শাসনের জন্য বিশেষ উপযােগী।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক