মুহাম্মদ বিন তুঘলকের যে কোনাে দুটি পরিকল্পনা সম্বন্ধে লেখ। পরিকল্পনাগুলাে ব্যর্থতার কারণ কী ছিল?


প্রশ্নঃ 
মুহাম্মদ বিন তুঘলকের যে কোনাে দুটি পরিকল্পনা সম্বন্ধে লেখ। পরিকল্পনাগুলাে ব্যর্থতার কারণ কী ছিল?

অথবা, মুহাম্মদ বিন তুঘলকের যে কোনাে দুটি পরিকল্পনা আলােচনা কর।

উপস্থাপনাঃ ভারতবর্ষের ইতিহাসে মুহাম্মদ বিন তুঘলক এক বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব। গিয়াসুদ্দিন তুঘলকের মৃত্যুর পর ১৩২৫ সালে পুত্র জুনা খান ‘মুহাম্মদ বিন তুঘলক’ উপাধি ধারণ করে দিল্লীর সিংহাসনে আরােহণ করেন। সিংহাসনে আরােহণ করে বিদ্রোহীদের কঠোর হস্তে দমন করার পর তিনি কতগুলাে উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা গ্রহণ করেন, যা তাকে ভারতের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ নৃপতির মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে।

উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনাসমূহঃ ১. দেবগিরিতে রাজধানী স্থানান্তর, ২. খােরাসান অভিযান, ৩. প্রতীকী তাম্র মুদ্রার প্রচলন, ৪. কারাচিল অভিযান, ৫. দোয়াবে কর বৃদ্ধি। উপরিউক্ত প্রশ্নের আলােকে নিম্নে দুটি পরিকল্পনার বিস্তারিত আলােচনা করা হলাে-

দেবগিরিতে রাজধানী স্থানান্তরের পরিকল্পনাঃ বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী, অসাধারণ উচ্চাভিলাষী ব্যক্তিত্ব মুহাম্মদ বিন তুঘলক রাষ্ট্রের সার্বিক কল্যাণার্থে যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন, তন্মধ্যে দেবগিরিতে রাজধানী স্থানান্তর অন্যতম। তিনি ১৩২৬ সালে রাজধানী দিল্লী থেকে দাক্ষিণাত্যের দেবগিরিতে স্থানান্তরের নির্দেশ দেন এবং দেবগিরির নতুন নামকরণ করেন দৌলতবাদ। নিম্নে এ স্থানান্তরের কারণ ও ফলাফল বর্ণনা করা হলাে

রাজধানী স্থানান্তরের কারণঃ

১. মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠাঃ দাক্ষিণাত্যের বিদ্রোহ ভাবাপন্ন হিন্দুদের নিয়ন্ত্রণ এবং সেখানে কার্যকর মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য মুহাম্মদ বিন তুঘলক দিল্লী থেকে সালতানাতের কেন্দ্রীয় রাজধানী দেবগিরিতে স্থানান্তরের পরিকল্পনা করেন।

২. সাম্রাজ্যের কেন্দ্রস্থলেঃ সাম্রাজ্যের বিস্ততির দিক থেকে দেবগিরিই ছিল সবাধিক কেন্দ্রীয় স্থান। তাই শাসনকার্যের সুবিধার জন্য সুলতান রাজ্যের কেন্দ্রস্থলে রাজধানী স্থানান্তরের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।

৩. সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা বিধানঃ দুর্ধর্ষ মােঙ্গল আক্রমণ থেকে নিরাপত্তার বিবেচনায় দিল্লী অপেক্ষা দেবগিরি ছিল অধিকতর উপযােগী। তাই সুলতান রাজধানী দিল্লী হতে ৭০০ মাইল দূরে দেবগিরিতে রাজধানী স্থানান্তরের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।

৪. প্রশাসনিক সুবিধাঃ দেবগিরিতে রাজধানী স্থাপনে প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনায় সুবিধা হবে, এ চিন্তায় সুলতান রাজধানী স্থানান্তর পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।

৫. অপমানজনক পত্রঃ ইবনে বতুতার মতে, দিল্লীর অধিবাসীরা সুলতানকে একটি অপমানজনক পত্র লেখার ফলে তিনি এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

৬. ধনরত্নের সদ্ব্যবহারঃ দাক্ষিণাত্য ছিল উর্বর ও অত্যধিক ধনরত্নে পরিপূর্ণ। এ সম্পদ সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে সাম্রাজ্যের জন্য কল্যাণকর হবে এ চিন্তা করে তিনি সেখানে রাজধানী স্থানান্তর করেন।

৭. বিদ্রোহ দমনঃ রাজধানী দিল্লী থেকে দাক্ষিণাত্যের বিরাট দূরত্ব থাকায় সেখানকার হিন্দু রাজারা বিদ্রোহ করার সুযােগ পায়। ওইসব হিন্দু বিদ্রোহীকে দমনের লক্ষ্যে সুলতান রাজধানী স্থানান্তরের প্রয়াস পান।

৮. ইসলামী সংস্কৃতি প্রবর্তনঃ দাক্ষিণাত্যের অধিকাংশ অধিবাসীই ছিল হিন্দ সম্প্রদায়ভুক্ত। তাই মুহাম্মদ বিন তুঘলক হিন্দু সম্প্রদায়ের মাঝে ইসলামী সংস্কৃতির প্রচলন করে ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি এবং ঐক্য সংহতি জোরদার করতে চেয়েছিলেন।

রাজধানী স্থানান্তরে ব্যর্থতার কারণঃ সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলকের বাজধানী স্থানান্তর পরিকল্পনা রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা প্রসূত নয় বিধায় তা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় রূপ নেয়। কারণ নিম্নরূপ-

১. প্রতিকূল আবহাওয়াঃ দিল্লীর আয়েশী জীবন যাপনে অভ্যস্ত সুলতান ও আমীর-অভিজাতদের জন্য দেবগিরির আবহাওয়া অনুকূল ছিল না। ঐতিহাসিক লেনপুল বলেন, দেবগিরিতে রাজধানী স্থানান্তর পরিকল্পনা ছিল মুহাম্মদ বিন তুঘলকের বিভ্রান্তিকর উদ্যমের প্রতীক।

২. দিল্লীই সাম্রাজ্যের প্রকৃত রাজধানীঃ দেবগিরিতে রাজধানী স্থাপন করে সেখানে প্রশাসনিক দফতর ও নতুন নতুন প্রাসাদ নির্মাণ করে যথেষ্ট নাগরিক সুবিধাদানের ব্যবস্থা করলেও দিল্লীর জনগণের অনীহা আর আন্তরিকতার অভাবে দিল্লীই রাজ্যের প্রধান কেন্দ্রের রাজধানী ছিল। দিল্লীর জনগণ মনেপ্রাণে দেবগিরিকে রাজধানী হিসেবে মেনে নেয়নি।

৩. উত্তর ভারতে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাঃ দেবগিরিতে রাজধানী স্থানান্তরের ফলে উত্তর ভারতে সুলতানের কর্তৃত্ব কিছুটা হ্রাস পায়। সুতরাং সেখানে পুনরায় স্বীয় কর্তত্ব। প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি দিল্লীতে ফিরে আসেন।

৪. মােঙ্গল আক্রমণঃ রাজধানী স্থানান্তরের ফলে দিল্লীর প্রশাসনে কাঠামােগত সমস্যা দেখা দেয়; যার জন্য মােঙ্গলরা বারবার দিল্লীর দিকে দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনা করে, তখন তাদের অগ্রগতি প্রতিরােধ করার জন্য সুলতান দিল্লীতে ফিরে আসেন।

৫. জনসমর্থনের অভাবঃ দিল্লীর অধিবাসীরা হিন্দু অধ্যুষিত দাক্ষিণাত্যে বসবাসে রাজি ছিল না। ফলে জনসমর্থনের অভাবে সুলতানের এ পরিকল্পনা সফল হয়নি।

৬. দিল্লীতে প্রত্যাবর্তনের আদেশঃ সুলতান মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে দেবগিরিতে রাজধানী স্থানান্তর করলেও বিভিন্ন প্রতিকূলতার কারণে এবং দিল্লী-রক্ষার স্বার্থে জনসাধারণ, রাজকর্মচারী এবং অভিজাত সম্প্রদায়কে পুনরায় দিল্লীতে প্রত্যাবর্তনের জরুরি আদেশ জারি করেন।

খােরাসান অভিযান পরিকল্পনাঃ খােরাসানের রাজনৈতিক গােলযােগের সুযােগে এবং কয়েকজন খােরাসানী অভিজাতের উৎসাহে মুহাম্মদ বিন তুঘলক ১৩২৭ খ্রিস্টাব্দে খােরাসান অভিযানের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এ অভিযানের কারণ ও ফলাফলের বিবরণ নিম্নে দেয়া হলাে-

অভিযান পরিকল্পনার কারণঃ

১. উচ্চাভিলাষঃ সুবিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার উচ্চাভিলাষেই মুহাম্মদ বিন তুঘলক খােরাসান অভিযানের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।

২. খােরাসানী অভিজাতদের প্ররােচনাঃ স্বীয় রাজ্যে আশ্রয়প্রাপ্ত কতিপয় বিদ্রোহী খােরাসানী অভিজাতের প্ররােচনায় সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলক এ পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।

৩. খােরাসানী শাসকের দুর্বলতাঃ খােরাসানের ইলখানি শাসক আবু সাঈদের দুর্বলতা এবং বিলাসিতার কারণে রাজ্যে বিশৃঙ্খলা ও অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়। এ সুযােগে মুহাম্মদ বিন তুঘলক খােরাসান অভিযানের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।

৪. আমীর নওয়ােজ ও আন নাসেরের প্রতিশ্রুতিঃ রাজা তারমাসিরীনের জামাতা আমীর নওরােজ ও মিসরের খলিফা আন নাসের সুলতানকে খােরাসান অভিযানে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

৫. অভিযান পরিকল্পনা প্রত্যাহারঃ সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে সুলতান বিভিন্ন কারণে এ অভিযান পরিকল্পনা পরিত্যাগ করেন। ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দীন বারানী বলেন, “খােরাসান বিজিত হয়নি এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস অর্থের প্রচুর অপচয় সাধিত হয়।”

পরিকল্পনা প্রত্যাহারের কারণঃ

১. স্বদেশে সুদৃঢ় শাসন প্রতিষ্ঠাঃ সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে তখন সুলতানের কর্তৃত্ব বিঘ্নিত হচ্ছিল। এমনকি দাক্ষিণাত্যে তখনাে তার আধিপত্য সুদৃঢ় হয়নি। এ অবস্থায় ভিন্ন দেশ আক্রমণ নিছক অবাস্তব পরিকল্পনা। তাই স্বদেশে স্বীয় শাসন সুদৃঢ় করার জন্য এ অভিযান পরিকল্পনা প্রত্যাহার করা হয়।

২. উপযুক্ত সামরিক শক্তির অভাবঃ বিপুল পরিমাণ সৈন্য খােরাসান অভিযানে পাঠালে স্বদেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। অপরদিকে খােরাসান, অভিযানের জন্য বিভিন্ন জাতিগােষ্ঠীর সমন্বয়ে গড়ে ওঠা বাহিনী ছিল দুর্বল।

৩. ভৌগােলিক কারণঃ ৩,৭০,০০০ সৈন্যের বিরাট বাহিনী নিয়ে পর্বতসংকুল অঞ্চল ও হিন্দুকুশ পর্বতের গিরিপথ অতিক্রম করা প্রায় অসম্ভব ছিল।

৪. অর্থনৈতিক অভাবঃ খােরাসান অভিযান উপলক্ষে ৩ লাখ ৭০ হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী প্রস্তুত করা হয়, আবার এদের প্রত্যেককে এক বছরের অগ্রিম বেতন পরিশােধ করা হয়। পরবর্তী সময়ে সুলতান দেখলেন, সব সময় এ বিশাল বাহিনীর ব্যয়ভার বহন করা সম্ভব হবে না। ফলে হঠাৎ করে অভিযান প্রত্যাহার করেন।

৫. মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে পালাবদলঃ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে পালাবদলের ফলেও এ অভিযান প্রত্যাহার করা হয়। ড. আগা মাহদী হােসাইন বলেন, “খােরাসানের শাসক আবু সাঈদ এবং মিসরের খলিফা আন নাসেরের সঙ্গে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্কে ভাটা পড়ায় এবং তারমাসিরীনের পতন ঘটায় খােরাসান অভিযান প্রত্যাহার করা হয়।”

উপসংহারঃ প্রতিকূল পরিস্থিতি ও ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের জন্য সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলক তার মহাপরিকল্পনাসমূহ বাস্তবায়নে ব্যর্থ হন। অথচ তিনি ছিলেন যুগের তুলনায় অধিক অগ্রসর শাসক। তাই ড. আগা মাহদী হােসাইন বলেন- The Sultan was advanced for his age.

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক