অথবা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের পরস্পরিক সম্পর্ক বর্ণনা কর।
ভূমিকাঃ সমাজ বলতে বুঝায় মানুষ, আর সংস্কৃতি বলতে বুঝায় মানুষের আচরণ। মানবসমাজের সকল পর্যায়ে সংস্কৃতির অস্তিত্ব রক্ষা করা যায়। কারণ সংস্কৃতি সমাজ কাঠামাের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। মানবসমাজ স্থির নয়, বরং পরিবর্তনশীল। তাই আদিম বর্বর অবস্থা অতিক্রম করে সমাজ আজ আধুনিক ও সভ্য রূপ নিয়েছে। তাই পরিবর্তনের ধারার সাথে সাংস্কৃতিক রূপ একটা নিজস্ব বলয় তৈরি করে নিয়েছে।
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের পারস্পরিক সম্পর্কঃ সামাজিক পরিবর্তন একটি জটিল প্রক্রিয়া। একক বা নির্দিষ্ট কোনাে কারণে সমাজের কোনাে পরিবর্তন ঘটে না। সামাজিক পরিবর্তনের গতি ও লক্ষ্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন উপাদানের ক্রিয়াশীল ভূমিকা রয়েছে। যেমনঃ জৈব উপাদান, প্রযুক্তিগত উপাদান, সাংস্কৃতিক উপাদান, মনস্তাত্ত্বিক উপাদান এবং অর্থনৈতিক উপাদান। সামাজিক পরিবর্তনের অন্তর্নিহিত বা পরােক্ষ উপাদান হলাে সংস্কৃতি। তাই স্বাভাবিকভাবে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের মধ্যে পরস্পর সম্পর্ক বর্তমান ।নিম্নে সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের সম্পর্ক আলােচনা করা হলাে-
(১) সমাজ পরিবর্তনে সাংস্কৃতিক উপাদানঃ একটি সমাজের অবিচ্ছিন্ন অংশ হিসেবে সংস্কৃতি পরিচিত সমাজ ব্যবস্থা সাংস্কৃতিক পরিবর্তন দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়। সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের ফলশ্রুতি হিসেবে সমাজ কাঠামােয় পরিবর্তন ঘটে। এ প্রসঙ্গে সমাজবিজ্ঞানী গাউসন ও গেটিস তাদের 'Introduction to sociology' গ্রন্থে বলেছেন, সংস্কৃতি সমাজ পরিবর্তনকে, নির্দেশ করে এবং গতিশীল করে তােলে। সমাজের সীমাও নির্ধারণ করে দেয় সংস্কৃতি, যার বাইরে সামাজিক পরিবর্তন ঘটে না।
(২) বৈপ্লবিক পরিবর্তন ধারাঃ একটি সমাজ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার সাথে সাথে সংস্কৃতি তার কাঠামাের মধ্যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম। মানব সভ্যতার ইতিহাস পর্যালােচনায় দেখা যায় যে, বহু সামাজিক ও রাজনৈতিক বিপ্লবের পেছনে সংস্কৃতি একটা সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে। তাই সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ঘটলে সমাজের পরিবর্তনও অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে।
(৩) গতিশীলতাঃ সংস্কৃতির কারণে একটি সমাজ গতিশীল হয়। কারণ সংস্কৃতির কারণে ব্যক্তি মনের পরিবর্তনের সাথে সাথে সমাজের বিভিন্ন ধারায় পরিবর্তন আনে। অর্থাৎ কালের বিবর্তনে সংস্কৃতির পরিবর্তন হয় এবং তার, প্রভাব হিসেবে সমাজে পরিবর্তন আসে।
(৪) প্রযুক্তি ও পরিবর্তনঃ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞান সবচেয়ে শক্তিশালী শক্তি। যা সমাজ পরিবর্তনে ভমিকা রাখে। সমাজ পরিবর্তনের ফলস্বরূপ সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও পরিবর্তন ঘটে। মূলত পরিবর্তনের এক মাত্র ক্রিয়াশীল বাহন হিসেবে সংস্কৃতি সমাজের সার্বিক পরিবর্তন আনে।
(৫) সামাজিক প্রথাঃ সংস্কৃতির অন্যতম বাহক হিসেবে সামাজিক প্রথার ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। সামাজিক প্রথার মধ্যে নিহিত থাকে সাংস্কৃতিক মূল্যবােধ। প্রকৃত প্রস্তাবে সংস্কৃতির বাহন হিসেবে কতকগুলাে আচরণ মানবসমাজে প্রথা হিসেবে প্রচলিত থাকে। সমাজ পরিবর্তনের কারণে এসব প্রথার কথিত অথবা অরক্ষিত পরিবর্তন ঘটে।
(৬) সামাজিক ঐতিহ্যের বিকাশঃ সংস্কৃতি হলাে এক ধরনের সামাজিক ফসল অর্থাৎ যা সমাজের ঐতিহ্যের একমাত্র পরিচায়ক। কাজেই সমাজ পরিবর্তনের সাথে সাথে ঐতিহ্যেরেও পরিবর্তন ঘটে। সুতরাং সমাজ পরিবর্তন এবং সংস্কৃতির পরিবর্তন এক থেকে অন্যকে পৃথক করা যায় না।
(৭) পারস্পরিক নির্ভরশীলতাঃ সমাজকে বাদ দিয়ে সংস্কৃতির অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। সঙ্গত কারণে কোনাে সমাজের সাংস্কৃতিক পরিবর্তন আসলেও সে সমাজের পরিবর্তন সাধিত হয়। অর্থাৎ সমাজ এবং সংস্কৃতি পরস্পর . দু'টি নির্ভরশীল প্রত্যয়। কাজেই এ দু’টির নির্ভরশীলতা বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
(৮) ভাষাঃ সংস্কৃতির বাহন হিসেবে ভাষা কোনাে সংস্কৃতির পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরতে সক্ষম। যেকোনাে সমাজের আদর্শ, মূল্যবােধ, রীতিনীতি, প্রথা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, আনন্দ-বেদনা সবই প্রকাশ পায় ভাষার মাধ্যমে। সমাজের সকল ব্যক্তিই তাদের দৈনন্দিন জীবনকে অর্থবহ করে তুলতে ভাষার সাহায্য নেয়। ভাষাই সমাজের প্রাণশক্তি হিসেবে কাজ করে।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে সমাজ এগিয়ে চলে। যেখানে পরিবর্তনের ব্যক্তির রূপ প্রকাশ পায় সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের মধ্যে। তাই সামাজিক এবং সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে গুণগত পরিবর্তনের নিয়ামক হিসেবে সংস্কৃতি তার নির্ভরশীলতাকে পূর্ণ রূপ দেয়।
0 মন্তব্যসমূহ