সাংস্কৃতিক ঐক্য ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন সম্পর্কে যা জান লেখ


প্রশ্নঃ সংস্কৃতির পরিবর্তনশীলতা প্রক্রিয়া আলােচনা কর।

অথবা, সাংস্কৃতিক ঐক্য ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন সম্পর্কে যা জান লেখ।

ভূমিকাঃ সংস্কৃতি সভ্যতার বাহন। সমাজজীবনকে সার্থক ও সুন্দর করে গড়ে তুলে সংস্কৃতি মানবজীবনের ভিত্তি রচনা করে। আদিম সমাজ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সভ্যতার উৎপত্তি, বিকাশ ও উৎকর্ষসাধনে সংস্কৃতির অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে। মানুষের দীর্ঘদিনের লালিত জীবনপ্রণালী সংস্কৃতির গতিকে সচল রেখেছে। সংস্কৃতির পথপরিক্রমার মধ্যদিয়ে সভ্যতা বিকাশ লাভ করে।

সংস্কৃতির পরিবর্তনশীল প্রক্রিয়াঃ মানুষের অর্জিত যে বিষয়গুলাে রয়েছে তার মধ্যে সংস্কৃতি অন্যতম। তাই একে মানুষের সহজাত বিষয় হিসেবে বিশ্লেষণ করলে ভুল হবে। বিভিন্ন কারণে অর্থাৎ সমাজ, দেশ, জাতি বা গােষ্ঠীভেদে সংস্কৃতির পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। কেননা পৃথিবীর সকল মানুষের আচরণ ও বৈশিষ্ট্য এক রকম নয়। তাই স্থান-কালভেদে সংস্কৃতিরও বিভিন্ন রূপ পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। মানুষের সংস্কৃতিতে কালভেদেও পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। কেননা একটি সমাজ বিবর্তনের বিভিন্ন স্তরে ভিন্ন ভিন্ন পারস্পরিক অবস্থা দ্বারা প্রভাবিত হয় বলে পৃথিবীর বিভিন্ন সমাজের মঞ্চে সংস্কৃতিগত পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের সংস্কৃতির মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। আমাদের দেশের পােশাক সংস্কৃতির সাথে আমিেরকার পােশাক সংস্কৃতির বিস্তর পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। এবং এদের মূল্যায়ণের ক্ষেত্রেও ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। শুধু দেশভেদে নয় একই দেশের মধ্যেও বিভিন্ন ধরনের সংস্কৃতির অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকতে পারে। উদাহরণ হিসেবে ভারতের কথা বলা যেতে পারে। এই বিশাল আয়তনের দেশের একটি অঞ্চলের সংস্কৃতির সাথে অন্যান্য অঞ্চলের সংস্কৃতির ব্যাপক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। সংস্কৃতির যে ভিন্ন ভিন্ন রূপ দেখা যায়, তার পেছনে রয়েছে বিভিন্ন কারণ ও সামাজিক উপাদানের প্রভাব। সংস্কৃতির এই পরিবর্তনশীলতাকে বিভিন্ন তাত্ত্বিক বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। নিম্নে নৃ-বৈজ্ঞানিকদের দৃষ্টিকোণ থেকে সাংস্কৃতিক পরিবর্তনশীলতা ব্যাখ্যা করা হলাে।

নৃবিজ্ঞানী দৃষ্টিকোণ ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনশীলতাঃ সমাজ ও সংস্কৃতি নানা প্রক্রিয়ায় পরিবর্তিত হয়। নৃ-বিজ্ঞানীরা সংস্কৃতি পরিবর্তনের তিনটি প্রধান প্রক্রিয়ার কথা উল্লেখ করেন। এগুলাে হলাে-

(১) ইনডিপেনডেন্ট ইনভেনশনঃ কোনাে সমাজ যখন বাইরের কোনাে সমাজের প্রভাব ছাড়াই বা অন্য সমাজ থেকে কিছু ধার করা ছাড়াই স্বাবলম্বি পন্থায়, স্বীয় সৃজনশীলতা ও স্বীয় আবিষ্কারের দ্বারা সমাজে পরিবর্তন সূচনা করে তখন ঐ পরিবর্তন প্রক্রিয়াকে ইনডিপেনডেন্ট ইনভেনশন বলা হয়।

(২) ব্যাপ্তি বা প্রসারণঃ নৃ-বিজ্ঞানে ব্যাপ্তি বা প্রসারণ বলতে সংস্কৃতি ধার করার প্রক্রিয়াকে বুঝায়। সংস্কৃতির কোনাে একটি উপাদান যে সমাজে উৎপত্তি লাভ করে তা ক্রমে সেখান থেকে অন্যত্র প্রসার লাভ করে এবং অন্য সমাজে গৃহীত হয়। এটাই হলাে সাংস্কৃতিক ব্যাপ্তি বা প্রসারণ প্রক্রিয়ার মূল কথা। বস্তুত, সংস্কৃতি এক স্থান হতে অন্য স্থানে গৃহীত হয়।

(৩) সংস্কৃতায়ন বা সাংস্কৃতিক যােগাযােগঃ ইনডিপেনডেন্ট ইনভেনশন এবং সাংস্কৃতিক ব্যাপ্তি এমন দু'টি পরিবর্তন প্রক্রিয়া, যা মূলত প্রত্যক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায় না। তবে ঐ প্রক্রিয়ার ফলে যে পরিবর্তন ঘটে তা আমরা স্পষ্ট উপলব্ধি করতে পারি। পক্ষান্তরে, সংস্কৃতায়ন এমন এক পরিবর্তন প্রক্রিয়ার নাম যার কার্যকারিতা প্রত্যক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায় এবং নৃ-বিজ্ঞানী সংস্কৃতায়ণের প্রভাব পর্যবেক্ষণের সাথে সাথে লিপিবদ্ধ করতে পারেন।

সাংস্কৃতিক পরিবর্তনশীলতায় সমাজের বিভিন্ন উপাদানের প্রভাবঃ সাংস্কৃতিক পরিবর্তনশীলতায় সমাজের যে সকল উপাদানের প্রভাব পরিলক্ষিত হয় তা নিম্নে উল্লেখ করা হলাে-

(১) জৈব পরিবর্তনঃ মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে এই জৈব পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। মানুষের পরিবর্তনের সাথে সাথে তার পারস্পরিক অবস্থারও পরিবর্তন হয়ে থাকে। সমাজের মানুষ গােষ্ঠী, প্রতিবেশী এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে খাপখাইয়ে তথা সম্পর্ক ও সামঞ্জস্য বজায় রেখে চলে। যার ফলে জনগােষ্ঠীর ধারাবাহিকতায় অঞ্চলভেদে এর পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়ে থাকে।

(২) ঐতিহাসিক উপাদানঃ মানুষের সংস্কৃতির ওপর ঐতিহাসিক উপাদানের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। কোনাে কোনাে অঞ্চলের সংস্কৃতির উৎস খুঁজতে গিয়ে ঐতিহাসিক উপাদানের প্রভাব খুঁজে পাওয়া যায়। সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে বিভিন্ন প্রথা পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। এগুলাে সংস্কৃতির অঙ্গবিশেষ এবং সংস্কৃতির প্রলক্ষণ হিসেবে প্রতীয়মান হয়। এই সকল প্রথা মানুষ ও গােষ্ঠীর সতর্ক বা অসতর্কতার ফলে সৃষ্টি হয়ে থাকে যা পরবর্তীতে কিছুসংখ্যক মানুষ সংস্কৃতিগত পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।

(৩) ভৌগােলিক অবস্থানঃ পৃথিবীর যেকোনাে ভূখণ্ডে বসবাসকারী জনগােষ্ঠীর সাংস্কৃতিক কার্যক্রম ভৌগােলিক অবস্থান দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যজনিত পার্থক্যের কারণে এক একটি অঞ্চলে সৃষ্টি হয় বিবিধ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত সংস্কৃতির। প্রত্যেকটি সংস্কৃতির রূপরেখা রচিত হয় জলবায়ু, আবহাওয়া, প্রাকৃতিক সম্পদ ইত্যাদির ভিত্তিতে। পথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীরা স্ব-স্ব অঞ্চলের প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে গড়ে তােলে তাদের সংস্কৃতির রূপরেখা।

(৪) প্রাধান্য সৃষ্টিকারি সাংস্কৃতিক বিষয়াদিঃ যেকোনাে দেশের সংস্কৃতির একটি কেন্দ্রীয় ও মুখ্য বিষয় থাকে। এ বিষয়টি সংস্কৃতির প্রাধান্য সৃষ্টিকারি বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংস্কৃতির কেন্দ্রীয় বিষয় হলাে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ। অন্যদিকে ভারতীয় সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান বিষয় হলাে সমাজব্যবস্থায় পুরুষের প্রাধান্য।

(৫) উৎপাদন পদ্ধতির পরিবর্তনঃ উৎপাদন পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটলে সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও পরিবর্তন সূচিত হয়। এ মন্তব্য করেছেন মার্কস। তাদের মতে, উৎপাদন পদ্ধতিই হচ্ছে যেকোনাে জনগােষ্ঠীর সংস্কৃতির মুখ্য নির্ণায়ক। উদাহরণস্বরূপ সমাজতান্ত্রিক গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল পুঁজিবাদী মার্কিন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল থেকে স্বতন্ত্র প্রকৃতির।

(৬) আবিষ্কার ও উদ্ভাবনগত প্রভাবঃ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানুষের বিশ্বাস, প্রত্যয়, জ্ঞান, ঐতিহ্য, প্রথা-পদ্ধতি ইত্যাদির ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক বা মৌলিক পরিবর্তন আনয়ন করে। আমরা যদি উন্নত বিশ্ব এবং অনুন্নত বিশ্বের সামাজিক জীবন পর্যালােচনা করি তাহলে তাদের মাঝে সংস্কৃতিগত পার্থক্য পরিলক্ষিত হবে। আর এটা হয়েছে আবিষ্কার ও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করার মাধ্যমে।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, সাংস্কৃতিক পরিবর্তনশীলতা স্বতন্ত্র, বাস্তব ও সত্য প্রক্রিয়া। উপযুক্ত আলােচনার মাধ্যমে বােঝা যায় যে, সংস্কৃতির পরিবর্তনগত প্রক্রিয়ার জন্য কোন উপাদানগুলাে দায়ি। আর এই সংস্কৃতির পরিবর্তন প্রক্রিয়ার জন্যই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতির মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়ে থাকে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক