জাতীয়তাবাদ কী আন্তর্জাতিক সভ্যতার প্রতি হুমকিস্বরূপ? বর্ণনা কর


প্রশ্নঃ জাতীয়তাবাদ কী আন্তর্জাতিক সভ্যতার প্রতি হুমকিস্বরূপ? বর্ণনা কর।

অথবা, উগ্র জাতীয়তাবাদ রাজনৈতিক উন্নয়নের প্রধান অন্তরায়- আলােচনা কর।

অথবা, জাতীয়তাবাদ কি? তুমি কি মনে কর যে, জাতীয়তাবাদ বিশ্বসভ্যতার প্রতি হুমকিস্বরূপ? তােমার উত্তরের সপক্ষে যুক্তি প্রদর্শন কর।

ভূমিকাঃ জাতীয়তাবাদ আধুনিককালের রাজনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতেই জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছে এবং জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভব বর্তমান বিশ্বকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। জাতীয় স্বার্থে মানুষ সংগ্রাম করে এবং অকাতরে প্রাণ পর্যন্ত বিসর্জন দেয়। বিংশ শতাব্দীর দু’টি বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল জাতীয় রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে। একদিন জাতীয়তাবাদ হাজার হাজার মানুষের মুক্তির মন্ত্র হিসাবে কাজ করেছিলাে। আজো জাতীয়তাবাদ অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জীবন্ত এক সত্যরূপে পরিস্ফুট।

শব্দগত অর্থে জাতীয়তাঃ ইংরেজী 'Nationality' শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হলাে জাতীয়তা বা জাতীয়তাবাদ। 'Nationality' শব্দটি 'Natus' বা Natio' থেকে উদ্ভূত হয়েছে। Natus বা 'Natio' শব্দের অর্থ হচ্ছে জন্ম বা বংশ। শব্দগত অর্থে জাতীয়তা শব্দের অর্থ হলাে একই বংশােদ্ভূত জনসমষ্টি।

জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞাঃ একই ভৌগােলিক সীমানায় বসবাসরত সমগ্র জনগণের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবােধের ওপর অন্যকোনাে ভৌগােলিক সীমারেখায় অবস্থিত মানুষের আধিপত্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জনমতকে ঐক্যবদ্ধ করে সংগ্রাম পরিচালনা করার মানসিকতা হলাে জাতীয়তাবাদ। অর্থাৎ যখন কোনাে জনসমষ্টির মধ্যে ভাষাগত ঐক্য, সাংস্কৃতিক ঐক্য, জীবনধারণগত ঐক্য দেখা দেয় তখন তাদের মধ্যে জাতীয়তাবােধের সৃষ্টি হয়।

সভ্যতার সহায়ক হিসেবে জাতীয়তাবাদঃ (১) মহান আদর্শ সমুন্নত রাখে। (২) মানব সভ্যতা তথা বিশ্ব সভ্যতাকে সমৃদ্ধ করে। (৩) গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথপ্রদর্শক। (৪) স্বাধীনতা সংগ্রামের উদ্দীপক। (৫) অভ্যন্তরীণ স্থায়ীত্ব।

জাতীয়তাবাদ বিশ্বসভ্যতার জন্য হুমকিস্বরূপঃ জাতীয়তাবাদ যখন আদর্শচ্যুত হয়ে সংকীর্ণতায় পরিণত হয় তখন তা সভ্যতার জন্য হুমকিস্বরূপ। নিম্নে এর কারণগুলো বর্ণনা করা হলো-

(১) সভ্যতার সংকটঃ উগ্র জাতীয়তাবাদ বিভিন্ন জাতির মধ্যে হিংসা, বিদ্বেষ, ঘৃণা সৃষ্টি করে। ফলে মানব সভ্যতা সংকটের সম্মুখীন হয়। উদাহরণ হিসেবে আমরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে উগ্র জাতীয়তাবাদের ফসল হিসেবে চিহ্নিত করবাে। কেননা এ যুদ্ধ মানবসভ্যতাকে তছনছ করে দিয়ে সভ্যতার বেদীমূলে ফাটল ধরিয়েছে।

(২) অগণতান্ত্রিকঃ উগ্র জাতীয়তাবাদ গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা ও চেতনার পরিপন্থী। উগ্র জাতীয়তাবাদ নীতির মাধ্যমে অগণতান্ত্রিকভাবে মানবিক নীতি বিসর্জন দিতে হয়। উগ্র জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র অনেক সময় অগণতান্ত্রিকভাবে অন্যের ওপর প্রভুত্ব বজায় রাখতে সচেষ্ট হয়। উদাহরণ হিসেবে আমরা কসােভাে সংকটকে উল্লেখ করতে পারি।

(৩) বিশ্ব শাস্তির বিরোধীঃ উগ্র জাতীয়তাবাদ বিশ্ব শান্তির বিরুদ্ধ হিসাবে কাজ করে। এরূপ জাতীয়তাবাদ সর্বক্ষেত্রে স্বদেশ ও স্বজনের দাবিকে অগ্রাধিকার দেয়। ন্যায়-অন্যায়, যুক্তি ও আলাপ-আলােচনাকে অস্বীকার করা হয় এবং সর্বপ্রকার বিরােধ মীমাংসার জন্য যুদ্ধের পথ গ্রহণ করা হয়। উদাহরণ হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা বলা যায়।

(৪) সংকীর্ণতা সৃষ্টির ক্ষেত্রেঃ উগ্র জাতীয়তাবাদ উম্মাদনার সৃষ্টি করে। যার ফলে দেশ ও জাতির সবকিছুকে একটি বাধাধরা নিয়মে পরিচালিত করা হয়। বাইরের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতা সংস্কৃতির আলোেক প্রবেশের পথ অবরুদ্ধ করা হয়। জাতির স্বকীয়তা সংরক্ষণের উগ্র বাসনা বিচ্ছিন্ন বর্বরতায় পরিণত হয়। রাজনৈতিক চিন্তা চেতনার দিগন্তকেও উগ্র জাতীয়তাবাদ সংকীর্ণ করতে উদ্যোগী হয়। যার ফলে জাতির সর্বাঙ্গীন উন্নতি ব্যাহত হয়।

(৫) অর্থনৈতিক শােষণের ক্ষেত্রেঃ জাতীয়তাবাদী আদর্শে অনুপ্রাণিত বর্তমান বিত্তশালী রাষ্ট্রের শাসকশ্রেণী বিভিন্ন দুর্বল ও অনগ্রসর জাতিকে অর্থ সাহায্যের নামে অর্থনৈতিক দিক থেকে শােষণ করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্র যখন পুঁজিবাদী রাষ্ট্রসমূহের ওপর অর্থনৈতিক দিক থেকে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, তখন তাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা বিপন্ন হয়। এরূপ অর্থনৈতিক শােষণ অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ বা নয়া সাম্রাজ্যবাদ নামে পরিচিত।

(৬) আবেগ সৃষ্টির ক্ষেত্রেঃ জাতীয়তাবাদের অন্যতম ত্রুটি হলাে আবেগের সৃষ্টি। জাতীয়তাবাদ অনেক সময় বিশ্ব জনগণের মধ্যে অন্ধ আবেগের সৃষ্টি করে। জাতীয়তাবাদের চেতনায় স্বাধীনতা অর্জনকারী রাষ্ট্র নিজেদের থেকে আলাদা ও স্বতন্ত্র মনে করে। পৃথক মানসিকতা তাদের মধ্যে অহংকারের জন্ম দেয়। পরিপ্রেক্ষিতে জাতির মধ্যে অন্ধ আবেগের জন্ম নেয়। অন্ধ আবেগের বিশ্বসভ্যতার জন্য হুমকিস্বরূপ।

(৭) মারণাস্ত্রের প্রতিযােগিতার ক্ষেত্রেঃ জাতীয়তাবাদের মহান আদর্শ থেকে বিচ্যুত হলে বিশ্ব সম্প্রদায়ের মধ্যে অসম প্রতিযােগিতা দেখা দেয়। উগ্র জাতীয়তাবাদের ফলে মারণাস্ত্রের প্রতিযােগিতা বৃদ্ধি পায়। বিশ্বসভ্যতা ধ্বংসের মুখােমুখি হয়। বিভিন্ন রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির সম্মুখীন হয়।

(৮) অর্থনৈতিক স্বার্থের পরিপন্থীঃ উগ্র জাতীয়তাবাদ অনুন্নত জাতির অর্থনৈতিক স্বার্থের পরিপন্থী। উগ্র জাতীয়তাবাদ কোনাে জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র তৈরি করতে পারে। কিন্তু সেই রাষ্ট্রের যথেষ্ট অর্থনৈতিক সম্পদ না থাকলে এই উগ্রতা কোনাে জাতিকে টিকিয়ে রাখতে সমর্থ হয় না।

(৯) সুস্থ মানব সংস্কৃতি বিকাশের পরিপন্থীঃ এটি সুস্থ মানব সংস্কৃতি বিকাশের পরিপন্থী। উগ্র জাতীয়তাবাদ মানবসমাজের মুক্তচিন্তা বিকাশের পথে হয়ে দাঁড়ায় অন্তরায়। যার ফলে মানব সংস্কৃতি তথা মুক্তচিন্তার বিকাশ কোনােক্রমেই সম্ভবপর হয় না।

(১০) অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপঃ উগ্র জাতীয়তাবাদের ফলে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলাে প্রথমে দুর্বল রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে। আন্তর্জাতিক নিয়ম-নীতির তােয়াক্কা না করে এসব সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কর্তৃত্ব কায়েম করতে সদা লিপ্ত থাকে।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, জাতীয়তাবাদ প্রত্যেক সভ্য ও সুশীল রাষ্ট্রের জন্য প্রয়ােজন। কিন্তু পাশাপাশি একথা সত্য যে, উগ্র জাতীয়তাবাদসভ্য ও সুশীল সমাজের জন্য সম্পূর্ণ পরিপন্থী। বর্তমান বিশ্ব বিজ্ঞানের যুগ। এই যুগের মানুষ সভ্য ও সুশিক্ষিত জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র কামনা করে। আর সেই রাষ্ট্র হবে সুখ ও শান্তির অবারিত নীড়। তাই আমাদেরকে একবিংশ শতাব্দীর প্রান্তে দাঁড়িয়ে এই শপথ নিতে হবে- আমরা উগ্র জাতীয়তাবাদকে পরিহার করে সভ্যতাকে তার চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌছে নিয়ে যাব।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক