সুলতান মাহমুদ কে ছিলেন? বিজেতা ও শাসক হিসেবে সুলতান মাহমুদের কৃতিত্ব বিচার কর


প্রশ্নঃ সুলতান মাহমুদ কে ছিলেন? বিজেতা ও শাসক হিসেবে সুলতান মাহমুদের কৃতিত্ব বিচার কর।

উপস্থাপনাঃ অপরাজিত সমরনায়ক ও কিংবদন্তীর মহানায়ক সুলতান মাহমুদ ছিলেন তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সেনাপতি। অসীম সাহস, অসাধারণ যােগ্যতা, মেধা আর ন্যায়বিচারের মাপকাঠিতে তিনি ভারতবর্ষের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। তাই ঐতিহাসিক উইলস হেগের মতে- Sultan Mahmud is one of the most prominent figures in the history of Islam.নিম্নে সংক্ষিপ্তভাবে তার কৃতিত্ব আলােচনা করা হলাে।

সুলতান মাহমুদের পরিচয়ঃ সেনাপতি সুলতান মাহমুদ ছিলেন গজনীর সুলতান। ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে পিতা সবুক্তগীনের মৃত্যুর পর তিনি গজনীর সিংহাসনে আরােহণ করেন। তার পিতা আলপ্তগীনের একজন বিশ্বস্ত ক্রীতদাস ও জামাতা ছিলেন। আলপ্তগীন সাম্মানীয় সুলতান আবদুল মালেকের ক্রীতদাস ছিলেন। সামানী বংশের পতনের পর তুর্কীস্তান, পারস্য ও ইরাকে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তুর্কী বংশের উদ্ভব হয়। এসব তুর্কী বংশের মধ্যে গজনী বংশই সুলতান মাহমুদের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম নতুন উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে সমরাভিযান করে।

সুলতান মাহমুদের কৃতিত্বঃ
১. ভারতের নেপােলিয়নঃ কোনাে অভিযানেই তিনি পরাজিত হননি। নেপােলিয়নের মতে, তিনি ধীরস্থিরচিত্তে যুদ্ধ পরিচালনা করতেন এবং দৃঢ়তা ও দুঃসাহসিকতার সঙ্গে তা কার্যকর করতেন। এজন্য তাকে ভারতের নেপােলিয়ন বলা হয়।

২. উঁচুদরের সৈনিকঃ ঐতিহাসিক লেনপুল বলেন, “সুলতান মাহমুদ ছিলেন একজন উঁচুদরের সৈনিক। তার দেহে ছিল যেমন শক্তি, তেমনি মনেও ছিল অফুরন্ত সাহস।” অপূর্ব সামরিক নেতৃত্ব, যুদ্ধ কৌশল এবং সাংগঠনিক ক্ষমতা দ্বারা তিনি সমগ্র আফগানিস্তান, পারস্যের অধিকাংশ স্থান এবং ভারতের বিভিন্ন স্থান দখল করেন।

৩. সাংগঠনিক ক্ষমতাঃ সুলতান মাহমুদ ছিলেন একজন যােগ্য ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সামরিক সংগঠক। তার সাংগঠনিক প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায় সেনাবাহিনী গঠনে। তিনি আরব, আফগান, তুর্কি, হিন্দু ও ইরানীদের সমন্বয়ে এক বিশাল সুশৃঙ্খল ও শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠন করেছিলেন। ড. আর. সি. মজুমদার বলেন, সুলতান মাহমুদ সন্দেহাতীতভাবে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সমরনায়ক ছিলেন।

৪. সামরিক কৃতিত্বঃ ঐতিহাসিক ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন, তার সামরিক কৃতিত্বের পরিচয় পাওয়া যায় ১৭ বার ভারত আক্রমণে একক অথবা সম্মিলিত হিন্দু রাজাদের প্রতিরােধ ধূলিসাৎ করে তিনি শত্রু পক্ষকে পর্যুদস্ত করেন। জীবনে কোনাে যুদ্ধেই তিনি পরাজিত হননি।

৫. দক্ষ সেনাধ্যক্ষঃ তিনি ধীরস্থির চিত্তে যুদ্ধ পরিকল্পনা গ্রহণ করতেন এবং দৃঢ়তা ও সাহসিকতার সাথে তা কার্যকর করতেন। এ প্রসঙ্গে এস. এম. ভাস্কর বলেন, “সেনাধ্যক্ষ হিসেবে তার কার্যপদ্ধতি ছিল বিজ্ঞানভিত্তিক।” রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য তিনি হিন্দু ও মুসলমান শত্রুর মধ্যে কোনাে পার্থক্য করেননি।

৬. সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাতাঃ সুলতান মাহমুদ তার অসাধারণ সামরিক ও রাজনৈতিক প্রতিভাবলে ক্ষুদ্র অবস্থা থেকে এক বিশাল ও শক্তিশালী গজনী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

৭. দূরদর্শী রাজনীতিবিদঃ ঐতিহাসিক ফিরিশতা বলেন, তার পক্ষে যা সম্ভব নয় এমন কিছু অর্জনে তিনি কখনাে চেষ্টা করতেন না। বিশাল গজনী সাম্রাজ্য ও ভারত তার একক নেতৃত্বে সুষ্ঠুভাবে শাসন করা সম্ভব হবে না চিন্তা করেই তিনি ভারতকে তাঁর সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেননি। এটা তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতার স্বাক্ষর বহন করে।

৮. বিদ্যোৎসাহী শাসকঃ ঐতিহাসিক ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন, সুলতান মাহমুদ বিদ্যোৎসাহী শাসক ছিলেন। তার পৃষ্ঠপােষকতায় রাজদরবারে বিভিন্ন দেশের কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, ঐতিহাসিক ও স্থপতির সমাবেশ ঘটে। তাদের মধ্যে কবি ফেরদৌসী, আলবেরুনী, ঐতিহাসিক বায়হাকী, উতবী এবং দার্শনিক আল ফারাবী উল্লেখযােগ্য।

৯. বিজেতাঃ বিজেতা হিসেবে সুলতান মাহমুদকে কোনােক্রমেই হেয় করে দেখা যায় না। কারণ তিনি যতবারই অভিযান পরিচালনা করেছিলেন ততবারই বিজয়ীবেশে স্বদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করেন।

১০. স্থাপত্যশিল্পের পৃষ্ঠপােষকঃ মাহমুদ স্থাপত্যশিল্পেরও পৃষ্ঠপােষক ছিলেন। গজনীর ইমারতসমূহ জাহসুজ আলাউদ্দীন কর্তৃক অগ্নিদগ্ধ হলেও গজনী মিনার। তার স্থাপত্যশিল্পের প্রতি গভীর অনুরাগের স্বাক্ষর বহন করে। এছাড়া তিনি গজনীতে ‘স্বর্গীয় বধূ' নামে একটি অনিন্দ্যসুন্দর মসজিদ নির্মাণ করেন।

১১. চিত্রশিল্পের পৃষ্ঠপােষকঃ ঐতিহাসিক লেনপুল বলেন, তার পৃষ্ঠপােষকতায় চিত্রশিল্পের উৎকর্ষ সাধিত হয়। ঐতিহাসিক আরনল্ড-এর মতে, তিনি তার রাজপ্রাসাদ স্বীয় প্রতিকৃতি, তার সৈন্যবাহিনী এবং হস্তী বাহিনীর চিত্র দ্বারা অলঙ্কৃত করেন।

১২. যােগ্য প্রশাসকঃ সুলতান মাহমুদ একজন সুনিপুণ যােগ্য প্রশাসক ও প্রজারঞ্জক শাসক ছিলেন। তিনি সাম্রাজ্যকে কয়েকভাগে বিভক্ত করে প্রত্যেক প্রদেশে একজন করে দক্ষ শাসক নিয়ােগ করেন। তিনি যােগ্যতা বিবেচনা করে প্রশাসনিক বিভাগে কর্মচারী নিয়ােগ করতেন, এক্ষেত্রে হিন্দু মুসলিম কোনাে পার্থক্য করা হতাে না।

১৩. ন্যায়পরায়ণ শাসকঃ সুলতান মাহমুদ একজন ন্যায়পরায়ণ শাসক ছিলেন। তার কাছে আইনের দৃষ্টিতে জাতি, ধর্ম, সম্প্রদায় এবং আত্মীয় অনাত্মীয় সকলেই সমান ছিল। তার কঠোর শাসনের কারণে সরকারি কর্মচারীরা প্রজাদের ওপর জুলুম করতে সাহস পেত না। ঐতিহাসিক উতবী বলেন, “তিনি ছিলেন জনগণের বিধাতা। অসহায় বিধবাই হােক আর সম্পদশালী ধনীই হােক, তিনি সকলকে সমান দৃষ্টিতে দেখতেন।”

১৪. পরধর্ম সহিষ্ণুঃ কোনাে কোনাে ঐতিহাসিকের নিকট তিনি ধর্মান্ধ, রক্ত পিপাসু এবং লুণ্ঠনকারী হলেও সমসাময়িক নিরপেক্ষ ঐতিহাসিকদের মতে, তিনি পরধর্ম সহিষ্ণু ছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্র ব্যতীত তিনি কোনাে রক্তপাত করেননি।

১৫. আদর্শ চরিত্রবানঃ সুলতান মাহমুদ একজন খাঁটি সুন্নী মুসলমান শাসনকর্তা ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি প্রগাঢ় ধর্মনিষ্ঠ, আত্মপ্রত্যয়ী, কর্তব্যপরায়ণ ও অধ্যবসায়ী ছিলেন। সহিষ্ণুতার মূর্ত প্রতীক সুলতান হিন্দুদের অনুষ্ঠানাদি পালনে পূর্ণ সুযােগ দিতেন। অধ্যাপক শর্মার মতে, “চরিত্র ও ব্যক্তিত্বের জন্য তিনি জনগণের নিকট স্বর্গীয় দূত হিসেবে সমাদৃত হতেন।”

উপসংহারঃ সমসাময়িক মুসলিম শাসকদের মধ্যে সুলতান মাহমুদ অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাসক ছিলেন। তাই ঐতিহাসিক গীবন সুলতান মাহমুদকে Undoubtedly one of the greatest kings of the world বলে অভিহিত করেছেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক