যান্ত্রিক বিবর্তনবাদ ও উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনবাদের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় কর


প্রশ্নঃ যান্ত্রিক বিবর্তনবাদ ও উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনবাদের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় কর।

অথবা, বিবর্তনবাদের প্রকারভেদ হিসেবে যান্ত্রিক বিবর্তনবাদ ও উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনবাদের মধ্যে প্রধানত কি কি পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়? তা আলােচনা কর।

অথবা, যান্ত্রিক বিবর্তনবাদ ও উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনবাদের মধ্যে কোন পার্থক্য খুজে পাওয়া যায় কী? আলােচনা কর।

ভূমিকাঃ দর্শনের বিভিন্ন সমস্যাবলির মধ্যে জগতের উৎপত্তিসম্পর্কিত তত্ত্ব প্রধান সমস্যা। জগতের উৎপত্তি সম্পর্কিত সমস্যা নিয়ে আলােচনা করতে গিয়েই বিবর্তনের ধারণাটি এসেছে। বিবর্তনবাদ এমন মতবাদ যার মাধ্যমে জগৎ ও অন্যান্য যাবতীয় প্রাণী ও বস্তু অভ্যন্তরীণ শক্তির সাহায্যে সহজ-সরল অবস্থা থেকে ক্রমপরিবর্তনের ধারায় বর্তমান জটিল অবস্থায় উপনীত হয়েছে। এই বিবর্তনবাদের বিভিন্ন রূপ লক্ষ্য করা যায়; যথা- (ক) যান্ত্রিক বিবর্তনবাদ, (খ) উদ্দেশ্য বা পরিণতিমূলক বিবর্তনবাদ, (গ) সৃজনমূলক বিবর্তনবাদ, (ঘ) উন্মেষমূলক বিবর্তনবাদ, (ঙ) পুনরাবৃত্তিমূলক বিবর্তনবাদ।

যান্ত্রিক বিবর্তনবাদঃ যান্ত্রিক বিবর্তনবাদের ভিত্তি হলাে কার্যকারণ সম্পর্ক। এমতবাদ বিবর্তনপ্রক্রিয়ায় কোনাে উদ্দেশ্য বা আদর্শের স্থান দেওয়া না। আকস্মিকভাবে জড় থেকে অভিব্যক্তি প্রক্রিয়ায় আরম্ভ হয়। ধীরে ধীরে এই অভিব্যক্তি প্রাণ, মন প্রভৃতি বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করে বর্তমান অবস্থায় উপনীত হয়।

যান্ত্রিক বিবর্তনবাদ আবার জড়বাদ ও নিসর্গবাদভিত্তিক। জড়বাদী ও নিসর্গবাদী দার্শনিকরা জড় ও গতিকেই জগতের সমস্ত কিছুর উৎপত্তির জন্য দায়ী বলে মনে করেন। যান্ত্রিক বিবর্তনবাদীদের মতে, ক্রমবিকাশের মাঝে কোনাে মন, চেতনা বা বুদ্ধির স্থান নেই। বুদ্ধি জগতের ক্রমবিকাশকে নিয়ন্ত্রণ করছে না। বিবর্তনপ্রক্রিয়া এ অভিন্ন ধারায় অগ্রসর হচ্ছে। জড়, মন ও প্রাণের মধ্যে কোনাে ফাক নেই। সুতরাং কোনাে উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যের প্রতি জগৎ ধাবিত। হচ্ছে এরূপ চিন্তা করা যুক্তিসঙ্গত নয়।

যান্ত্রিক বিবর্তনবাদ অনুসারে অসীম বিস্তত দেশে অসংখ্য পরমাণু আছে। শক্তি যখন এ পরমাণুগুলাের ওপর কাজ করে তখন সেগুলাে কখনও পরস্পরের সাথে সংযুক্ত হয়, কখনও বিচ্ছিন্ন হয়। এ আকস্মিক সংযােজন ও বিয়ােজন থেকেই আকস্মিকভাবে জগতের সৃষ্টি হয়। জড় থেকে প্রাণ ও মনের মূলত কোনাে তফাৎ নেই। প্রাণ জড়ের জটিল রূপ, মন জড় ও প্রাণের জটিলতম রূপ। জড়, অজড় সবকিছুই যান্ত্রিক নিয়মের অধীন। কোথাও কোনাে আদর্শের স্থান নেই।

উদ্দেশ্যমূলক বা পরিণতিমূলক বিবর্তনবাদঃ উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনবাদীদের মতে, দুনিয়াটা অন্ধ ও অচেতন। জড়ের যান্ত্রিক খেলা নয়। এখানে উদ্দেশ্য, আদর্শ ও বিচার-বিবেচনার স্থান আছে। কেবল ভৌতিক এবং রাসায়নিক ক্রিয়া প্রক্রিয়ার সাহায্যে এ বিশাল জগতের উৎপত্তি এবং তার ক্রমবিকাশের ফলেই জীবজগতের উৎপত্তি হয়েছে। সমস্ত জীবজগৎ কোনাে উদ্দেশ্য সাধনের জন্য উদ্ভূত হয়েছে। কাজেই উদ্দেশ্যমূলক বা পরিণতিমূলক বিবর্তনবাদ অনুসারে ক্রমবিকাশের ধারা কোনাে উদ্দেশ্য দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, কোনাে পরিণতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। একটু ভালভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনের লক্ষণগুলাে জগৎ ও জীবের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাদের পরিবেশের অনুকূলে এমনভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে, যাতে তারা প্রতিটি ক্ষেত্রে খাপ খাইয়ে চলতে পারে। যদিও প্রাণ প্রাণহীন বস্তুর ওপর এবং চেতনা প্রাণের ওপর অস্তিত্বের জন্য নির্ভর করে, তথাপি বিবর্তনপ্রক্রিয়ায় এদের গুণগত তারতম্য পরিলক্ষিত হয় বলে বিবর্তনপ্রক্রিয়া যান্ত্রিক নয় বরং উদ্দেশ্যমূলক।

যান্ত্রিক ও উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনবাদের মধ্যে পার্থক্যঃ উপরের আলােচনায় দেখা যায় যে, যান্ত্রিক বিবর্তনবাদ ও উদ্দেশ্যমূলক বা পরিণতিমূলক বিবর্তনবাদের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য আছে। নিম্নে পার্থক্যগুলাে উল্লেখ করা হলাে-

(১) সমর্থনের ভিন্নতাঃ বিবর্তনবাদের ইতিহাস আলােচনা করলে দেখা যায় যে, জড়বাদী ও স্বভাববাদীরা যান্ত্রিক বিবর্তনবাদের সমর্থক। আর ভাববাদীরা পরিণতিমূলক বা উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনবাদের সমর্থক।

(২) জগৎ ব্যাখ্যায় মতের ভিন্নতাঃ যান্ত্রিক বিবর্তনবাদ অনুসারে পৃথিবী তার নির্জীব এবং চেতনাবস্তুসহ ধীরপরিবর্তনের মাঝে বিভিন্ন স্তর পেরিয়ে বর্তমান অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। কিন্তু উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনবাদ অনুসারে যে বিবর্তনপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে পৃথিবী এ বর্তমান অবস্থায় এসেছে তা এক উদ্দেশ্যমূলক ধারা ব্যতীত আর কিছুই নয়।

(৩) মন সম্পর্কিত ধারণার ভিন্নতাঃ জীববাদ ও রসায়নবিদদের মতে, পৃথিবীর সবকিছুই ভৌতিক ও রাসায়নিক ক্রিয়ার ফল। মন বলে কিছুই নেই। কিন্তু উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনবাদের সমর্থনকারীরা বলেন, সমগ্র জগতে এক আধ্যাত্মিক সত্তা বিরাজমান। তিনি জগতের ভিতরে ও বাইরে রয়েছেন। বস্তুজগৎ হচ্ছে এক চরম সত্তার বহিঃপ্রকাশ।

(৪) জগতের স্বরূপঃ যান্ত্রিক বিবর্তনবাদ অনুযায়ী জগতের বর্তমান রূপ হচ্ছে জড় ও গতির স্বাভাবিক বিবর্তনের ফল। কিন্তু উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনবাদ অনুযায়ী কোনাে এক বুদ্ধিময় চেতনশক্তি উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্তে বিবর্তন প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করছে।

(৫) প্রকারভেদঃ যান্ত্রিক বিবর্তনবাদ দুই প্রকার, যথা- জড়জগৎ সম্পৰ্কীয় যান্ত্রিক বিবর্তনবাদ ও জীবক্ষণ সম্পন্ন যান্ত্রিক বির্বতনবাদ। অন্যদিকে উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনবাদও দুই প্রকার; যথা- বাহ্যউদ্দেশ্যবাদ এবং অন্তঃস্থিত উদ্দেশ্যবাদ।

এ ছাড়াও যান্ত্রিক বিবর্তনবাদ বলে যে নিয়মের মধ্য দিয়ে জগৎবর্তমান অবস্থায় এসে পৌঁছেছে সেটা হলাে প্রাকৃতিক যান্ত্রিক বা অন্ধশক্তি। জড়শক্তি, কাল, দেশ, মাধ্যাকর্ষণ, আকর্ষণ, বিকর্ষণ, ইত্যাদি দ্বারাই যান্ত্রিকবাদ জগৎকে ব্যাখ্যা করে থাকে। কিন্তু উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনবাদ বলে, বিশ্বজগৎ এক পরমসত্তার প্রকাশ। সে পরমসত্তা আবার চৈতন্যময় সত্তা।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, যান্ত্রিক বিবর্তনবাদ ও উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনবাদ মূলত দু'টি বিরােধী মতবাদ। তবে একথা সত্য যে, উদ্দেশ্যবাদ যান্ত্রিক এবং বৈজ্ঞানিক বিবর্তনবাদের সাথে মূলত কোনাে বিরােধিতা করে না। কিন্তু যান্ত্রিক বিবর্তনবাদ উদ্দেশ্যবাদকে অস্বীকার করে। কাজেই দু'টি মতের কোনােটিকেই এককভাবে গ্রহণ করা যায় না; বরং দু'টি মতবাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করেই যদি কোনাে মতবাদ তৈরি করা সম্ভব হত তাহলেই সেটি গ্রহণযােগ্য মতবাদ হিসেবে যুক্তিসঙ্গত হত বলে আমি মনে করি। তবে উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনবাদ যেহেতু যান্ত্রিক বিবর্তনবাদের তেমন বিরােধিতা করে না সেহেতু যান্ত্রিক বিবর্তনবাদের চেয়ে উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনবাদকেই অধিকতর যুক্তিযুক্ত মতবাদ বলে মনে করতে পারি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক