সুলতান আলাউদ্দিন খিলজীর চরিত্র ও কৃতিত্ব আলােচনা কর


প্রশ্নঃ শাসন সংস্কারক হিসেবে আলাউদ্দিন খিলজীর কৃতিত্ব আলােচনা কর।
অথবা, সুলতান আলাউদ্দিন খিলজীর চরিত্র ও কৃতিত্ব আলােচনা কর।

উপস্থাপনাঃ আলাউদ্দিন খিলজী মধ্যযুগীয় ভারতবর্ষের অন্যতম। শ্রেষ্ঠ নরপতি সুলতান। পিতৃব্য ও শ্বশুর জালালুদ্দিন খিলজীকে হত্যা করে আলাউদ্দিন ১২৯৬ সালে সিংহাসনে আরােহণ করেন। তিনি ছিলেন একজন উচ্চাভিলাষী ও সাম্রাজ্যবাদী শাসক। তার চারিত্রিক অবস্থান নির্ণয়ে D.S. Roy বলেন- As a king he was a ruthless tyrant, and as a man, treacherous and ungrateful.

আলাউদ্দিন খিলজীর কৃতিত্বঃ

১. দিল্লী সালতানাতের শ্রেষ্ঠ সুলতানঃ আলাউদ্দিন খিলজী ভারতবর্ষে মুসলিম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অন্যান্য সুলতানদের অপেক্ষা বিরাট অবদান রেখেছেন। তিনি তার পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী অনেক সুলতানদের কৃতিত্ব অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এটা তার রাজনৈতিক সাফল্য। মুহাম্মদ বিন তুঘলক, শের শাহ ও আকবরের মতাে অনেকেই তার প্রবর্তিত বিভিন্ন শাসননীতি ও সংস্কার গ্রহণ করেছিলেন। সর্বদিক দিয়ে বিচার করলে বলা যায়, আলাউদ্দিন খিলজী ছিলেন দিল্লী সালতানাতের শ্রেষ্ঠ সুলতান।

২. শ্রেষ্ঠ শাসকঃ আলাউদ্দিন খিলজী প্রশ্নাতীতভাবে দিল্লী সালতানাতের শ্রেষ্ঠ শাসনকর্তা ছিলেন। শাসক হিসেবে তার মূল্যায়নে ইবনে বতুতা তাকে one of the best Sultan বলে আখ্যায়িত করেছেন। ব্যাপক সাম্রাজ্যবাদ, নিরঙ্কুশ একনায়কত্ব, মােঙ্গলভীতি দূরীকরণ, প্রশাসনযন্ত্রকে ধর্ম থেকে মুক্তকরণ, অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ বিশৃঙ্খলার মূলােৎপাটন, সুষ্ঠু পরিকল্পনার ভিত্তিতে সামরিক বাহিনী সংগঠন, শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। উচ্চশ্রেণি কর্তৃক নিচু শ্রেণির শােষণ বন্ধের জন্য তিনি আমীর উমরাদের দুর্নীতির পথ বন্ধ ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি দ্বারা তিনি ভারতবর্ষে মুসলিম সাম্রাজ্য সুদৃঢ় করেছেন।

৩. শ্রেষ্ঠ বিজেতাঃ আলাউদ্দিন খিলজী একজন অপরাজেয় যােদ্ধা ও অসাধারণ রণকুশলী সেনাপতি ছিলেন। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে তিনি বিচক্ষণতার সাথে উত্তর ভারত ও দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলাে মুসলিম সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন।

ক. উত্তর ভারতের বিজিত এলাকাসমূহঃ আলাউদ্দিন খিলজী ১২৯৭ খ্রিস্টাব্দে গুজরাট, ১২৯৯ খ্রিস্টাব্দে ক্যাম্বে, রণথম্ভোর, ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে চিতাের, ১৩০৫ খ্রিস্টাব্দে মালব এবং ১৩০৮ খ্রিস্টাব্দে মাওয়ার জয় করেন।

খ. দক্ষিণ ভারতের বিজিত এলাকাসমূহঃ ১৩০৬ খ্রিস্টাব্দে দেবগিরি, ১৩০৯ খ্রিস্টাব্দে বরঙ্গল; ১৩১০ খ্রিস্টাব্দে দ্বারসমুদ্রে, ১৩১১ খ্রিস্টাব্দে মাদুরা জয় করেন। শুধুমাত্র অভ্যন্তরীণ যুদ্ধাভিযানেই নয়; বরং বাইরের মােঙ্গলদের বিরুদ্ধেও তার সফলতা যে কোনাে সুলতানের সফলতাকে ম্লান করে দিয়েছে।

৪. রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠাঃ দীর্ঘকাল যাবৎ বিচ্ছিন্নতার পর উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে সর্বদা বিশৃঙ্খলা এবং অরাজকতা বিরাজ করত। অথচ সাম্রাজ্যের ভিত শক্তিশালী হওয়ার জন্য ঐক্যের বিকল্প নেই। সুলতান আলাউদ্দিন এ লক্ষ্যে সমগ্র ভারতে রাজনৈতিক ঐক্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

৫. রাজস্ব সংস্কারঃ আলাউদ্দিন খিলজীর শাসনব্যবস্থায় রাজস্ব সংস্কার ছিল অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংস্কার। তিনি সর্বপ্রথম ভূমি জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করেন এবং রাজস্ব কোষাগারে অর্থ জমা ও অর্থ মজুদ প্রথা নিষিদ্ধ ঘােষণা করেন।

৬. সামরিক সংস্কারঃ অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন, ক্রমাগত মােঙ্গল আক্রমণ ভীতি দূরীকরণ এবং রাজ্য বিস্তারের প্রয়ােজনে সুলতান যুগােপযােগী বিরাট সামরিক বাহিনী গঠন করেন।

৭. সামাজিক সংস্কারঃ আলাউদ্দিন খিলজী প্রশাসনিক উন্নয়নের পাশাপাশি সামাজিক উন্নয়নের জন্য কল্যাণমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করে সামাজিক কুসংস্কার, মদ্যপান, ব্যভিচার, গণিকাবৃত্তি ও যাদুবিদ্যার বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।

৮ অর্থনৈতিক সংস্কারঃ আলাউদ্দিন খিলজীর শাসনব্যবস্থার শ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব হচ্ছে অর্থনৈতিক সংস্কার। সুচারুরূপে অর্থনীতি পরিচালনার লক্ষ্যে তিনি প্রয়ােজনীয় দ্রব্য সামগ্রীর মূল্য নির্ধারণ করে দেন। খাদ্য মজুদ, ব্যবসায়ে প্রতারণা ও শঠতা বন্ধ করার জন্য তদারককারী নিয়ােগ করেন। ঐতিহাসিক লেনপুল এজন্য তাকে A great Political Economist বলে আখ্যায়িত করেছেন।

৯. শিল্প-সাহিত্যের পৃষ্ঠপােষকঃ আলাউদ্দিন খিলজী ছিলেন সংস্কৃতিমনা। তিনি নিজে বিদ্বান না হলেও জ্ঞানী ও বিদ্বান ব্যক্তিদের সমাদর করতেন। প্রখ্যাত কবি আমীর খসরু তার রাজত্বকাল ও রাজ্য বিস্তারের ইতিহাস রচনা করেন। সুফী সাধক নিয়ামদ্দিন আউলিয়া ও শেখ রুকনুদ্দিন তার পৃষ্ঠপােষকতা লাভ করেন।

১০. স্থাপত্যশিল্পের পৃষ্ঠপােষকঃ সুলতান আলাউদ্দিন খিলজী স্থাপত্যশিল্পের প্রতিও বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। তিনি দিল্লীর উপকণ্ঠে অপরূপ সৌন্দর্য মণ্ডিত অনেক মসজিদ, মাদরাসা, সরাইখানা, দুর্গ প্রভৃতি স্থাপন করেছিলেন। ঐতিহাসিক postal এর মতে- Alauddin was the author unexampled grace and mobility.

আলাউদ্দিন খিলজীর চরিত্রঃ

১. নির্ভিক সেনাপতিঃ আলাউদ্দিন খিলজী একজন নির্ভীক সেনাপতি হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তার সুনিপুণ দক্ষতা, বিচক্ষণতা ও নির্ভীকতা রাজ্য বিস্তারে সহায়তা করেছিল।

২. ন্যায়পরায়ণতাঃ তিনি রাষ্ট্রের স্বার্থে বলিষ্ঠতা ও নির্ভীকতার সাথে প্রশাসনিক যন্ত্র পরিচালনা করতেন। দেশে সুষম অর্থনৈতিক কাঠামাে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করেন, যা তার ন্যায়পরায়ণতার স্বাক্ষর বহন করে।

৩. ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীঃ আলাউদ্দিন খিলজী যদিও মুসলিম ছিলেন, কিন্তু তিনি ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ও স্বৈরাচারী শাসক। তিনি আইন প্রণয়নের সময় ইসলামী শরীয়ত বাদ দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার আশ্রয় নিতেন। তিনি সম্ভবত প্রথম মুসলিম শাসক, যিনি ভারত বর্ষে ধর্মনিরপেক্ষ শাসনব্যবস্থা কায়েম করেন।

৪. নিষ্ঠুর ও অসহনশীলঃ আলাউদ্দিন খিলজী চরিত্রগত দিক থেকে ছিলেন অত্যাচারী ও নিষ্ঠুর রক্তপিপাসু। নিজ পিতৃব্য ও শ্বশুর জালালুদ্দিনকে হত্যা ও তার পরিবারের প্রতি নির্মম ব্যবহার এবং তার আদেশে একদিনে ত্রিশ হাজার নও-মুসলিমের প্রাণনাশ প্রভৃতি নিষ্ঠুরতারই পরিচায়ক।

৫. উচ্চাকাঙ্ক্ষীঃ আলাউদ্দিন খিলজী স্বীয় উচ্চাকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করতে গিয়ে ন্যায় অন্যায়ের চিন্তা করতেন না। তিনি সর্বদা উচ্চাশা পােষণ করে অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলতেন।

৬. অকৃতজ্ঞঃ তিনি স্বভাবগতভাবে ছিলেন অকৃতজ্ঞ। অভিজাত শ্রেণির অনেকের সহযােগিতায় সিংহাসন লাভ করলেও পরে তিনি সে সকল ব্যক্তির ধন সম্পত্তি অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করেন। তাদের অনেককেই কারাগারে বন্দি, অন্ধ এবং কাউকে হত্যাও করেন।

৭. উত্তম আচরণকারীঃ আলাউদ্দিন খিলজীর চারিত্রিক গুণাবলির মধ্যে অন্যতম দিক ছিল তিনি প্রজা সাধারণের সাথে উত্তম আচরণ করতেন। তার আচরণে সাধারণত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটত না। তবে তার মতের বিরুদ্ধে গেলে তিনি অসম্ভব রেগে যেতেন।

৮. আদর্শ ও নৈতিকতার মাপকাঠিতে খিলজীঃ আলাউদ্দিন খিলজী ছিলেন দিল্লী সালতানতের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক, কিন্তু তিনি ছিলেন অনেকটা নীতি জ্ঞানশূন্য ব্যক্তি। তার চরিত্রে কতিপয় নৈতিকতা ও আদর্শ বিবর্জিত কার্যকলাপ বিদ্যমান থাকায় ইসলামী দুনিয়ায় তিনি গ্রহণযােগ্যতা পাননি।

উপসংহারঃ মৌলিকত্ব ও গঠনমূলক প্রতিভাসম্পন্ন নানা গুণের অধিকারী আলাউদ্দিন খিলজী দিল্লীর সর্বশ্রেষ্ঠ নরপতি ছিলেন। তার চরিত্র ও কৃতিত্বপূর্ণ কার্যাবলির জন্য ভারতবর্ষের ইতিহাসে তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক