অথবা, র কৃতিত্বসমূহ সংক্ষেপে বর্ণনা কর।
উপস্থাপনাঃ ১৪৫১ খ্রিস্টাব্দে সৈয়দ বংশের পতনের পর দিল্লী সালতানাতে লােদী বংশের অবির্ভাব ঘটে। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেন, লােদী বংশ দিল্লী সালতানাতে পঞ্চম রাজবংশ। এ বংশের প্রতিষ্ঠাতা বাহলুল লােদী এবং সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক ছিলেন সিকান্দার লােদী। তার প্রশংসায় স্যার উইলস হেগ বলেন- He was the greatest of the three kings of his house.
শ্রেষ্ঠ শাসক হিসেবে সিকান্দার লােদীঃ বাহলুল লােদীর মৃত্যুর পর তার দ্বিতীয় পুত্র নিজাম খান অভিজাতবর্গের সহায়তায় সিকান্দার লােদী নাম ধারণ করে ১৪৮৯ সালে দিল্লীর সিংহাসনে আরােহণ করেন। লােদী বংশের ৭৫ বছরের শাসনকালের ইতিহাস পর্যালােচনা করলে দেখা যায়, সিকান্দার লােদীই ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক। নিম্নে শ্রেষ্ঠ শাসক হিসেবে সিকান্দার লােদীর কৃতিত্বের বিবরণ দেয়া হলাে-
১.সিংহাসনারােহণঃ বাহলুল লােদীর মৃত্যুর পর তার পুত্রদের মধ্যে সিংহাসন নিয়ে অন্তর্দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হলে বাহলুল লােদীর দ্বিতীয় পুত্র নিজাম খানকে অভিজাতবর্গ সুলতান ঘােষণা করেন। অতঃপর নিজাম খান সিকান্দার শাহ উপাধি ধারণ করে ১৪৮৯ খ্রিস্টাব্দে দিল্লীর মসনদে অধিষ্ঠিত হয়ে ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ২৮ বছর রাজত্ব করেন। তিনি ছিলেন লােদী বংশের দ্বিতীয় সুলতান।
২. প্রাথমিক বাধা দূরীকরণঃ সিকান্দার লােদীর ক্ষমতারােহণের সময় দিল্লীর সিংহাসন ছিল অত্যন্ত কণ্টকাকীর্ণ। এ সময় তার চাচা আলম খাঁ বিদ্রোহ ঘােষণা করলে তিনি তার বিরুদ্ধে অগ্রসর হন এবং তাকে পরাজিত করেন। অতঃপর তিনি পাতিয়ালার দমা খানকে পরাজিত ও হত্যা করেন এবং আজম হুমায়ুনকে দমন করে কাল্পী দখল করেন।
৩. শাসনব্যবস্থাঃ সুলতান সিকান্দার সাম্রাজ্যে সুন্দর এক শাসনব্যবস্থা কায়েম করেন। উৎপন্ন শস্যের ওপর থেকে কর বিলােপ করে এবং শুল্ক হ্রাস করে তিনি ব্যবসায়। বাণিজ্যে পৃষ্ঠপােষকতা প্রদান করেন। ফলে দেশে সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি ফিরে আসে।
৪. ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাঃ একজন ন্যায়বিচারক হিসেবে সুলতান দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে আপামর জনগণের জন্য সুবিচার নিশ্চিত করেন। সকল প্রকার জুলুম অত্যাচার দূর করেন। তিনি সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক ও অন্যান্য খােজখবর রীতিমতাে রাখতেন।
৫. দুর্নীতি দমন ও রাজস্ব বৃদ্ধিঃ তিনি অভিজাতবর্গের প্রতারণা শক্ত হাতে দমন করেন এবং সরকারের রাজস্ব আয়-ব্যয়ের বার্ষিক একটি হিসাব রক্ষণ ও তা পরীক্ষার বন্দোবস্ত করেন। কেউ হিসাব প্রদানে অসমর্থ হলে কঠোর শাস্তিদানের বিধান প্রচলন করেন। এতে করে রাজস্ব আয় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেতে থাকে।
৬. শাসক হিসেবে তার স্থানঃ শাসক হিসেবে তিনি স্বীয় দক্ষতা প্রমাণে সক্ষম হয়েছিলেন। ড. পান্ডে বলেন- He was on the whole a better and greater administrator then either his father or his son. অর্থাৎ, মােটের ওপর পিতা অথবা পুত্র অপেক্ষা তিনি ছিলেন উৎকৃষ্টতর শ্রেষ্ঠ শাসক।
৭. জৌনপুরের বিদ্রোহ দমনঃ জৌনপুরের শাসক তার বড় ভাই বারবাক শাহ স্বাধীনতা ঘােষণা করলে সুলতান সিকান্দার লােদী তার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। যুদ্ধে বারবাক শাহ পরাজিত হয়ে বায়ুনে পলায়ন করেন। অতঃপর সুলতান জৌনপুর দখল করে সেখানে নিজের অনুগত শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন।
৮. আফগানদের ক্ষমতা খর্বকরণঃ জৌনপুরের বিদ্রোহ দমনের পর সিকান্দার লোদী আফগান দলপতিদের প্রতি মনােনিবেশ করেন। এসব আফগান দলপতি বড় বড় জায়গির ভােগ করতেন এবং সালতানাতে অত্যন্ত প্রভাবশালী হয়ে সুলতানের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ান। ফলে সুলতান তাদের ক্ষমতা খর্ব করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হন।
৯. আগ্রা শহর নির্মাণঃ ১৫০৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি আগ্রায় একটি মনােরম শহর নির্মাণ করে দিল্লীর রাজধানী তথায় স্থানান্তর করেন। রাজধানী স্থানান্তরের ফলে ওটোয়া, কোল, গােয়ালিয়া প্রভৃতি অঞ্চলের ওপর তার আধিপত্য বিস্তারের সুযােগ লাভ হয়।
১০. রাজপুতদের দমনঃ রাজপুতদের দমন সুলতান সিকান্দার লােদীর শাসনকালের উল্লেখযােগ্য ঘটনা। তিনি ১৫০২ খ্রিস্টাব্দে বােলপুর ও নায়ােয়াবের বিদ্রোহ দমন করেন। চান্দেরীর রাজাও তার নিকট আত্মসমর্পণ করেন।
১১. গােয়ালিয়র অভিযানঃ গােয়ালিয়র অধিপতি মানসিংহ বিদ্রোহ ঘােষণা করলে সুলতান তার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করার উদ্দেশে সেনাবাহিনী প্রস্তুত করেন, কিন্তু গােয়ালিয়র আক্রমণের প্রস্তুতিকালেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মৃত্যুবরণ করেন।
১২. মৃত্যুঃ সুলতান সিকান্দার লােদী ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে গােয়ালিয়র আক্রমণের প্রাক্কালে অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিছুদিন পর এ মহান শাসক মৃত্যুবরণ করেন।
সিকান্দার লােদীর কৃতিত্বঃ
১. শ্রেষ্ঠ সুলতানঃ সিকান্দার লােদী দীর্ঘ ২৮ বছর রাজত্ব করেন। তিনিই ছিলেন লােদী বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক। উদ্ধত আমীর ওমরাদের বিদ্রোহ দমন, সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি, শান্তি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ইত্যাদির মাধ্যমে তিনি সুষ্ঠু শাসন পরিচালনা করেন।
২. দক্ষ শাসকঃ সিকান্দার লােদী একজন দক্ষ শাসক ও সমর নেতা ছিলেন। প্রশাসনকে দুর্নীতিমুক্তকরণ, গুপ্তচর নিয়ােগ এবং জমিদারীর ক্ষেত্রে নতুন নতুন ব্যবস্থা প্রবর্তন করে তিনি শাসনব্যবস্থাকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করেন।
৩. চিকিৎসা বিদ্যায় অবদানঃ সুলতান সিকান্দার লােদীর পৃষ্ঠপােষকতায় চিকিৎসা বিজ্ঞানের ওপর সংস্কৃত ভাষায় লিখিত “তিব্বে সিকান্দরী’ নামে একটি পুস্তক ফারসি ভাষায় অনুবাদ করেন।
৪. রেশনিং প্রথা চালুঃ সিকান্দার লােদী অভাবী ও দুঃখীদের প্রতি দয়া এবং উদারতা প্রদর্শন করতেন। সাম্রাজ্যের সকল গরিবের অভিযােগসমূহ নিজেই শ্রবণ করতেন। রেশনিং ব্যবস্থা চালু করে তিনি প্রতি বছর ছয় মাসের জন্য গরিব দুঃস্থের অন্ন সমস্যার সমাধানে সাহায্য করতেন।
৫. কল্যাণমূলক শাসন প্রতিষ্ঠাঃ সুলতান প্রজাদের প্রতি অত্যন্ত দয়ালু ছিলেন। তিনি অনেক কর উঠিয়ে দেন, কৃষকদের উন্নতি বিধান করেন। ব্যবসায় বাণিজ্য ও সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ ঘটান এবং সাধারণ প্রজাদের আর্থিক দৈন্যদশা দূর করেন। এর ফলে সাম্রাজ্যে সুখ শান্তি ফিরে আসে।
৬. ন্যায়বিচারকঃ ঐতিহাসিক ত্রিপাঠী বলেন, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও সিকান্দার লােদীর কৃতিত্ব ছিল অনন্য। সুষ্ঠু বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি যথাযথ কার্যক্রম গ্রহণ করেন। ফলে সাম্রাজ্যের সর্বত্র চুরি ডাকাতি বন্ধ হয়ে নতুন জীবনের সূচনা হয়।
৭. শিক্ষা সংস্কৃতির পৃষ্ঠপােষকঃ ঐতিহাসিক ভি. ডি. মহাজন বলেন, সিকান্দার লােদী সাহিত্যানুরাগী ছিলেন এবং বিদ্বান ও পণ্ডিতদের পৃষ্ঠপােষকতা করতেন। তার সময়ে বহু খ্যাতনামা কবি সাহিত্যিক ফারসি ভাষায় কবিতা ও গ্রন্থ রচনা করেন। বিখ্যাত ‘ফেহরেস্তে সেকান্দারী’ গ্রন্থ তার আমলেই রচিত।
৮. শিল্প ও স্থাপত্যঃ সিকান্দার লােদীর সময়ে চারু ও কারুশিল্পের ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়। আগ্রায় বহু সুরম্য অট্টালিকা ও মসজিদ নির্মাণ করে নবনির্মিত আগ্রাকে তিনি আধুনিক শহরে রূপান্তর করেন। দিল্লীর ন্যায় নবপ্রতিষ্ঠিত আগ্রাতেও তিনি কারুশিল্পের উন্নতির দিকে দৃষ্টি দেন।
উপসংহারঃ লােদী বংশের শাসকদের মধ্যে সিকান্দার লােদী ছিলেন নিঃসন্দেহে সর্বশ্রেষ্ঠ সুলতান। সমসাময়িক ঐতিহাসিকগণ তার চরিত্র ও কার্যাবলির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তাই ড. পান্ডে বলেন- He was is no the whole, a better and greater administration than either his father or his son.
0 মন্তব্যসমূহ