মুহাম্মদ বিন তুঘলকের পরিকল্পনাগুলাে পর্যালােচনা কর


প্রশ্নঃ মুহাম্মদ বিন তুঘলকের পরিকল্পনাগুলাে পর্যালােচনা কর।

অথবা, মুহাম্মদ বিন তুঘলকের উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনাসমূহ বর্ণনা কর।

অথবা, মুহাম্মদ বিন তুঘলকের উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনাসমূহ সমালােচনাসহ বর্ণনা কর।

উপস্থাপনাঃ গিয়াসুদ্দিন তুঘলকের মৃত্যুর পর ১৩২৫ খ্রিস্টাব্দে জুনা খান ‘মুহাম্মদ বিন তুঘলক’ উপাধি ধারণ করে দিল্লীর সিংহাসনে আরােহণ করেন। তার রাজত্বকালে কতিপয় বিচিত্র কার্যকলাপের উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি কতগুলাে উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা গ্রহণ করে ভারতের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ নরপতি হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছেন। ড. ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন- He was unquestionably the best man among the crowned heads of the middle ages.

উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনাসমূহঃ মুহাম্মদ বিন তুঘলক সর্বমােট পাঁচটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তার পরিকল্পনাসমূহ হলাে- (ক) দেবগিরিতে রাজধানী স্থানান্তর (১৩২৭), (খ) খােরাসান অভিযান (১৩২৭-২৮ খ্রিঃ), (গ) প্রতীকী তাম্র মুদ্রার প্রচলন (১৩২৯-৩০ খ্রিঃ), (ঘ) কারাচিল অভিযান (১৩৩২-৩৩ খ্রিঃ), (ঙ) দোয়াবে কর বৃদ্ধি (১৩৩৪ খ্রিঃ)।

ক. দেবগিরিতে রাজধানী স্থানান্তরঃ মরক্কোর পরিব্রাজক ইবনে বতুতা বলেন, সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলক ১৩২৭ খ্রিস্টাব্দে রাজধানী স্থানান্তরের নির্দেশ জারি করেন এবং জনগণকে দিল্লী থেকে ৭০০ মাইল দূরবর্তী দাক্ষিণাত্যের দেবগিরিতে যাওয়ার নির্দেশ দেন। তিনি দেবগিরির নতুন নামকরণ করেন দৌলতাবাদ।

যাতায়াতের সুবিধার জন্য তিনি প্রশস্ত রাস্তা নির্মাণ করেন এবং যানবাহনের সকল বন্দোবস্ত করেন। তিনি ডাক প্রথারও প্রবর্তন করেন। ঐতিহাসিক বারানীর মতে, সুলতান প্রবাসী ব্যক্তিদের যাত্রাপথে ও গন্তব্যস্থলে সব ধরনের সুযােগ সুবিধাদানে যথেষ্ট উদারতা প্রকাশ করেন।

রাজধানী স্থানান্তরের কারণঃ দেবগিরিতে রাজধানী স্থাপনের পশ্চাতে কয়েকটি কারণ রয়েছে। যেমন-
১. সাম্রাজ্যের কেন্দ্রস্থলে রাজধানী স্থাপন।
২. মােঙ্গল আক্রমণ প্রতিহত করা।
৩. হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় ইসলামী সংস্কৃতির বিকাশ।
৪. দক্ষিণ ভারতের ধনভাণ্ডার আয়ত্ত করা।
৫. দাক্ষিণাত্যের হিন্দুদের বিদ্রোহ দমন করা।

পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার কারণঃ মুহাম্মদ বিন তুঘলকের রাজধানী স্থানান্তরের উদ্দেশ্য সৎ এবং মহৎ হওয়া সত্ত্বেও দুর্ভাগ্যবশত এ পরিকল্পনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। আর এ ব্যর্থতার কারণ ছিল-

১. স্থানান্তরের প্রক্রিয়া সম্পর্কে তার বাস্তব জ্ঞান ছিল না। শুধু সরকারি দপ্তর স্থানান্তর করেই যে রাজধানী স্থানান্তর করা যায় না তা তিনি বুঝতে পারেননি।

২. ব্যবহারিক বুদ্ধি ও সামঞ্জস্যহীন কার্যকলাপের জন্যও এ পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়।

৩. দিল্লী থেকে ৭০০ মাইল দূরবর্তী দেবগিরিতে রাজধানী স্থানান্তর হওয়ায় মােঙ্গলদের বিরুদ্ধে সুলতানের প্রতিরােধ ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে মােঙ্গলরা লাগাতার অভিযান শুরু করে।

৪. দিল্লীর মুসলমান নাগরিকগণ হিন্দু অধ্যুষিত দাক্ষিণাত্যে বাস করতে অসম্মতি জানায়।

৫. দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া।

উল্লিখিত কারণসমূহের প্রেক্ষিতে সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলোক রাজধানী পুনরায় দিল্লীতে ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দেন। বিশ্ববিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা বলেন, দিল্লীর লােকদের সমুচিত শাস্তি দেয়ার জন্যই সুলতান এ পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।

খ. খােরাসান অভিযানঃ খােরাসানের রাজনৈতিক গােলযােগের সুযােগে এবং কয়েকজন অভিজাত খােরাসানীর উৎসাহ-অনুপ্রেরণায় মুহাম্মদ বিন তুঘলক ১৩২৭ খ্রিস্টাব্দে খােরাসান অভিযানের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এ উপলক্ষে তিনি ৩ লাখ ৭০ হাজার সৈন্যের বিরাট বাহিনী গড়ে তুলে এক বছরের অগ্রিম বেতন পরিশােধ করেন। কিন্তু আমীর নওরােজ ও আল নাসীর কর্তৃক সাহায্য প্রদানের পূর্ব প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে এ অভিযান পরিচালনা অসম্ভব হয়ে পড়ে।

পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার কারণঃ

১. মুহাম্মদ বিন তুঘলকের খােরাসান অভিযানের পরিকল্পনা ছিল চূড়ান্তভাবে অরাজনৈতিক এবং অবাস্তব কল্পনাবিলাস।

২. বিভিন্ন জাতি গােষ্ঠীর সমন্বয়ে খােরাসান অভিযানের উদ্দেশে গড়ে তােলা সামরিক বাহিনী ছিল দুর্বল।

৩. সর্বোপরি পার্বত্য অঞ্চলের বিপজ্জনক পথে বিশাল সেনাবাহিনী পরিচালনা নিরাপদ ছিল না।

৪. এত বিশাল সেনাবাহিনীর খরচ পােষণ সম্ভব নয়। এসব কারণে সুলতান খােরাসান অভিযানের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করেন।

বারানীর ভাষায়, আকাঙ্ক্ষিত অঞ্চল বিজিত হয়নি এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস অর্থের অপচয় হয়। মূলত রাজনৈতিক অবস্থা পরিবর্তিত হওয়ার ফলেই তার এ অভিযান পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হতে পারেনি।

গ. প্রতীকী তাম্র মুদ্রার প্রচলনঃ সুলতানের উচ্চাভিলাষী মহাপরিকল্পনা ও সংস্কারের মধ্যে ছিল প্রতীকী তাম্র মুদ্রার প্রচলন। মুহাম্মদ বিন তুঘলক ১৩৩০ খ্রিস্টাব্দে দু’শ গ্রেনের স্বর্ণ মুদ্রা (দিনার) এবং একশ চল্লিশ গ্রেনের রৌপ্য মুদ্রা (আদলী) লেনদেনের পরিবর্তে স্বল্প ব্যয়ে নির্মিত প্রতীকী তাম্র মুদ্রার প্রচলন করেন। এ কারণে ঐতিহাসিক থমাস তাকে Prince of Moneyers বলে আখ্যায়িত করেন।

মুদ্রা প্রচলনের কারণঃ
১. রাজকোষের ঘাটতি পূরণ।
২. অর্থনৈতিক সংকট দূরীকরণে স্বর্ণ ও রৌপ্যের সংরক্ষণ।
৩. অবাধ বিনিয়ােগ ও লেনদেনের সুবিধা।
৪. স্বর্ণ-রৌপ্যের তুলনায় তামার দাম কম থাকায়।
৫. চীন ও পারস্যে তাম্র মুদ্রার সফলতায় অনুপ্রাণিত।

তাম্র মুদ্রা প্রচলনে ব্যর্থতার কারণঃ তুঘলকের তাম্র মুদ্রা প্রচলনের ব্যর্থতার কারণ নিম্নরূপ-

১. জনগণের অজ্ঞতাঃ সুলতান মহৎ উদ্দেশে তাম্র মুদ্রা চালু করলেও রক্ষণশীল জনগণ এ বিষয়ে ছিল অজ্ঞ। তারা মুদ্রা চালুর ব্যাপারে কোনাে ধরনের সহযােগিতা না করায় এ পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়।

২. বণিকদের অস্বীকৃতি।

৩. আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অসুবিধা।

৪. জাল মুদ্রাঃ প্রতাকা তাম্র মুদ্রা প্রচলন করার আগে জাল মুদ্রা প্রচলনের বিরুদ্ধে কোনাে সতর্ক প্রতিরােধ ব্যবস্থা গ্রহণ না করে তিনি মারাত্মক ভুল করেন। ঐতিহাসিক বারানী বলেন, প্রত্যেক হিন্দু গৃহ মুদ্রা তৈরির কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়। হিন্দুরা অজস্র জাল মুদ্রা ছাপত এবং এ মুদ্রার সাহায্যে কর প্রদান ও ব্যবসায়-বাণিজ্য চালাত।

মাসদী বলেন, দেশি জনগণের অনীহাই হলাে মুদ্রা প্রচলনে ব্যর্থতার অন্যতম কারণ।

ঘ. কারাচিল অভিযানঃ সমসাময়িক ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বারানি ও নিবাসী পরিব্রাজক ইবনে বতুতার মতে, মুহাম্মদ বিন তুঘলক ১৩৩২-৩৩ খ্রিস্টাব্দে নিজ রাজ্যের নিরাপত্তার স্বার্থে ভারত ও চীনের মধ্যবর্তী হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত কারাচিল পার্বত্য অঞ্চলে অভিযান প্রেরণ করেন। খসরু মালিকের নেতৃত্বে পরিচালিত এ অভিযানে কারাচিলের উপজাতীয় সর্দারগণ ভীত হয়ে সুলতানের বশ্যতা স্বীকার করে কর দিতে স্বীকৃতি জানান।

ব্যর্থতার কারণঃ সুলতানের আদেশ অমান্য করে খসরু মালিক কারাচিল বিজয়ের পর তিব্বত অভিযানে সৈন্য প্রেরণ করেন। তিব্বতী সৈন্যদের আক্রমণে ও তুষারে পতিত হয়ে গােটা সেনাবাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। রসদ ফুরিয়ে এলে খাদ্যের অভাবে অনেকে রােগাক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। আর বাকি সৈন্যরা নদী পার হতে গিয়ে নিমজ্জিত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। এভাবে সুলতানের সেনাবাহিনী ধ্বংস হয়ে যায়। ফলে সর্বশেষ অভিযানও ব্যর্থ হয়, তবে এজন্য দায়ী ছিল খসরু মালিক।

ঙ. দোয়াব অঞ্চলে কর বৃদ্ধিঃ পদ্মা যমুনার মধ্যবর্তী দোয়াব অঞ্চলে কর বৃদ্ধি সুলতানের একটি উল্লেখযােগ্য পরিকল্পনা। তিনি ১৩৩৪ খ্রিস্টাব্দে দোয়াব অঞ্চলের ধনী কৃষকদের কর বৃদ্ধি করেন।

কর বৃদ্ধির কারণঃ কর বৃদ্ধির বিশেষ কারণ হচ্ছে-
১. আর্থিক সংকট মােকাবেলা।
২. হিন্দু ভূস্বামীদের বিদ্রোহী মনােভাব দমন।
৩. শাসনকার্যের সুবিধার্থে তিনি এ অঞ্চলে কর বৃদ্ধি করেন। তার এ করনীতিও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

করবৃদ্ধির পরিকল্পনা ব্যর্থতার কারণঃ
১. দশ গুণ হতে বিশগুণ পর্যন্ত কর বৃদ্ধির অসঙ্গত ছিল।
২. কর পরিশােধ হিন্দু প্রজাদের আর্থিক সংকট ও অনীহা প্রদর্শন।
৩. কর আদায়ে কঠোরতা ও দমননীতি গ্রহণ করা অসঙ্গত।
৪. বিদ্রোহী হিন্দু-ভূস্বামীদের বিরূপ সমালােচনা।
৫. কর বৃদ্ধিকালীন সময়ে দোয়াব অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ বিরাজ করছিল।

উল্লিখিত প্রতিকূলতার কারণেই সুলতানের কর বৃদ্ধির পরিকল্পনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

উপসংহারঃ মুহাম্মদ বিন তুঘলকের গৃহীত পরিকল্পনাগুলাে গঠনমূলক ও মহৎ, উদ্দেশ্যপ্রণােদিত ছিল, কিন্তু বাস্তবায়ন পদ্ধতির ক্রটি এবং দুর্ভাগ্যের জন্যই প্রধানত তার পরিকল্পনাগুলাে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ঐতিহাসিক ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন-Never were benevolent schemes of reform more cruelly frustrated by an evil fate than in the care of Muhammad bin Tughlaq.

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক