সত্যতা সম্পর্কিত প্রয়ােগবাদী মতবাদ ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন কর


প্রশ্নঃ সত্যতা সম্পর্কিত প্রয়ােগবাদী মতবাদ ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন কর।
অথবা, সত্য সম্পর্কে প্রায়ােগিক মতবাদ আলােচনা কর।
অথবা, সত্যতাসম্পর্কিত মতবাদ হিসেবে সঙ্গতিবাদ ব্যাখ্যা কর।

ভূমিকাঃ ‘সত্যতা' এবং মিথ্যাত্বের প্রশ্নটি অবধারণের সঙ্গে জড়িত। অবধারণ সত্য বা মিথ্য হতে পারে। অবধারণের সত্যতা যাচাই করা দার্শনিক আলােচনায় অপরিহার্য। দর্শনের ইতিহাসে আমরা সত্যের প্রকৃতি ও সত্যের পরীক্ষার স্বরূপ নিয়ে দার্শনিকদের মধ্যে মতভেদ দেখি। এ মতবাদের পরিপ্রেক্ষিতে দর্শনের ইতিহাস আলােচনা করলে মােটামুটি চারটি প্রধান মতবাদ দেখতে পাই। যথা-১. স্বতঃপ্রতিবাদ, ২. সঙ্গতিবাদ, ৩. অনুরূপতাবাদ এবং ৪. প্রয়ােগবাদ। নিম্নে সত্যবিষয়ক মতবাদ হিসেবে প্রয়ােগবাদ মতবাদ আলােচনা করা হলাে-

সত্যের ধারণাঃ জ্ঞানের সঙ্গে ‘সত্য' অথবা ‘মিথ্যা’ সম্পর্কযুক্ত। জ্ঞান ও চিন্তার প্রকাশ ঘটে অবধারণের মাধ্যমে। সুতরাং যে জ্ঞান অবধারণের মাধ্যমে প্রকাশিত হয় না, তার সম্পর্কে সত্যাসত্যের প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু যে জ্ঞান যুক্তিবিদ্যাসম্মত, কেবল তারই সত্যাসত্য বিচারের প্রশ্ন ওঠে। অবধারণ সত্য অথবা মিথ্যা হতে পারে। যেমন ‘দুয়ে দুয়ে চার হয়’-এ অবধারণটি সত্য। কিন্তু ‘সব মানুষ হয় সৎ'- এ অবধারণটি মিথ্যা'

সত্যের স্বরূপঃ মানদণ্ডের পার্থক্যের ব্যাপারে বার্ট্রান্ড রাসেল বলেন, “কোনাে অবধারণের সত্যতা জানা একটি আকস্মিক ঘটনা। সত্যতা বা মিথ্যা না জানলেও অবধারণ সত্য অথবা মিথ্যা হতে পারে। প্রকৃতপক্ষে সত্যতার স্বরূপ সত্যতা জানার ওপর নির্ভরশীল নয়। দুয়ে দুয়ে চার হয়’-এটি সত্য, তবে একে জানলেও সত্য হবে, না জানলেও সত্য হবে।”

প্রয়ােগবাদ বা প্রায়ােগিক মতবাদঃ মানবিক প্রয়ােজনই হলাে সত্য নির্ণয়ের একমাত্র মাপকাঠি। যে মতবাদ ব্যবহারিক প্রয়ােজনীয়তার দিকে লক্ষ্য রেখে সত্যতার স্বরূপ ও সত্যতা পরীক্ষা করার কথা বলে তাকে প্রয়ােগবাদ বা প্রয়ােজনবাদ বলে। পার্স, জেমস, ডিউঙ্গ এবং শীলার প্রয়ােগবাদ মতবাদের প্রধান বক্তা। তবে এদের মধ্যে মতভেদ আছে। নিচে আমরা এদের মতামত আলাদাভাবে আলােচনা করব।

পার্সের বক্তব্যঃ পার্স কোনাে জিনিসের ব্যবহারিক ফলাফলের ওপর অত্যধিক গুরুত্ব আরােপ করেন। তার মতে, ব্যবহারিক ফলাফরের ওপরই কোনাে বচনের সত্যতা নির্ভর করে। অর্থাৎ ব্যবহারিক ফলাফলই হচ্ছে কোনাে বচনের সত্যতা পরীক্ষার একমাত্র মানদণ্ড। তাই যে বচনের ব্যবহারিক সার্থকতা রয়েছে সে বচন সত্য, আর যে বচনের ব্যবহারিক সার্থকতা নেই সে বচন মিথ্যা।

সি. এস. পার্সের বক্তব্যঃ সি. এস. পার্স কোনাে জিনিসের ব্যবহারিক ফলাফলের ওপর অত্যধিক গুরুত্বারােপ করেন। তার মতে, ব্যবহারিক ফলাফলের ওপরই কোনাে বচনের সত্যতা নির্ভর করে থাকে। অর্থাৎ ব্যবহারিক ফলাফলই হচ্ছে কোনাে বচনের সত্যতা পরীক্ষার একমাত্র মানদণ্ড। তাই যে বচনের ব্যবহারিক সার্থকতা রয়েছে, সেই বচন সত্য, আর যে বচনের ব্যবহারিক কোনাে সার্থকতা নেই সে বচন মিথ্যা। ব্যবহারিক ফলের মতের সাথে সঙ্গতি রেখে তিনি বলেন, সত্যতা হচ্ছে সুযােগ্য ও সুনিয়ন্ত্রিত অনুসন্ধানের ফল। অনুসন্ধানের সাফল্যের ওপর অবধারণের সত্যতা নির্ভরশীল। যেমন- টেবিলের উপর একটি গােলাপ ফুল দেখে আমরা অবধারণ করি যে এটা সুগন্ধি ফুল। সুতরাং ঐ অবধারণটি তখনই সত্য। হবে যদি তার কাছে গিয়ে দেখি এবং ঘ্রাণ নিয়ে পরখ করি। সি. এস পার্সের সাথে সুর মিলিয়ে ডিউই বলেন, সত্যতা ও সত্তা মানুষ সৃষ্টির ফল, সত্যতা হচ্ছে অর্জিত গুণ বা ধর্ম।

শীলারের বক্তব্যঃ প্রয়ােগবাদী দার্শনিক শীলারের মতে, ধারণার সত্যতা তাদের সফলতার ওপরই নির্ভর করে। যখন আমরা কোনাে ধারণা পােষণ করি তখন সে ধারণার বশবর্তী হয়ে আমরা জাগতিক ব্যাপার সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি। যদি এ ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হয়, সফল হয়, তবে ধারণা সত্য হয়ে ওঠে। যেকোনাে ধারণা হতে যেকোনাে ভবিষ্যদ্বাণী সফল হয়। যেমন, মনে করি একটি সুগন্ধের কথা। যদি বলা হয় অদূরের বাগান হতে একটি ফুলের সুবাস আসছে, তবে বুঝতে হবে এ ধারণার একটা সত্যতার দাবি আছে। তা ছাড়া আমরা যদি বাগানে গিয়ে দেখি সত্যিই সেখানে সুগন্ধি ফুল ফুটে রয়েছে, তবেই আমাদের ধারণা সত্য হবে।

ডিউঙ্গ-র বক্তব্যঃ জেমসের মতো ডিউঙ্গও সত্যতাকে বচনের কোনাে অভ্যন্তরীণ গুণ বলে মনে করেন না। জেমসের সুরে সুর মিলিয়ে তিনিও সত্যতাকে বচনের একটি অর্জিত গুণ বা ধর্ম বলে মনে করেন। তার মতে, সত্যতা হচ্ছে এক ধরনের অনুসন্ধানের ফলশ্রুতি, যে অনুসন্ধানকে সুযােগ্য ও সুনিয়ন্ত্রিত বলে অভিহিত করা হয়। অনুসন্ধানের ফলে যদি দেখা যায় কোনাে বচন তার বক্তব্য বিষয়কে তুষ্ট করতে পারে তাহলে সেই বচনকে আমরা সত্য আর অন্যথায় তাকে মিথ্যা বলে অভিহিত করে থাকি।

সমালােচনাঃ সত্য বিষয়ক মতবাদ প্রয়ােগবাদ ত্রুটিমুক্ত নয়। এ মতবাদের ত্রুটিগুলাে নিম্নরূপ-

(১) এ মতবাদ সত্যের রূপ উদঘাটন করতে পারেনাঃ প্রয়ােগবাদীরা সত্যের যথার্থ স্বরূপ উদঘাটন করতে পারে না। কারণ এ মতবাদ সত্যের স্বরূপ ও সত্যের পরীক্ষাকে অভিন্ন বলে মনে করে।

(২) এ মত সত্য নয়ঃ প্রয়ােগবাদীরা বলেন, সব বচনই জীবনে প্রয়ােজনে আসে বলে সত্য- এমন কথাটি বলা যায় না।

(৩) এ মত অপূর্ণঃ প্রয়ােগবাদীরা জীবনের উন্নতি এবং প্রয়ােজনের ওপর বেশি জোর দিতে গিয়ে জীবনের পরিণতি, লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যের কথা ভুলেই যান। এ মতবাদ মনের সত্য, শিব, সুন্দরের বিচার শক্তিকে অস্বীকার করে।

(৪) সত্যতা ও পরীক্ষা এক নয়ঃ প্রয়ােগবাদীরা ধারণার সত্যতা এবং সে সত্যতার পরীক্ষা এক জিনিস বলে মনে করেন। কিন্তু সত্যতা ও এর পরীক্ষা সম্পূর্ণ এক জিনিস নয়।

(৫) সত্যতা আগন্তুক গুণ নয়ঃ প্রয়ােগবাদীরা মনে করেন, সত্যতা অবধারণের আগন্তুক গুণ। কারণ কোনাে বিশ্বাস কার্যসিদ্ধির পক্ষে উপযােগী হলেই তাকে সত্য বলা যায়। কিন্তু সত্যতা আগন্তুক গুণ নয়। এটি একটি ধারণা, যা বিশ্বাসের মধ্যে স্বতঃই বিদ্যমান।

(৬) এ মত ভ্রান্তঃ সাফল্য লাভই সত্যতার একমাত্র মাপকাঠি নয়। ভ্রান্ত ধারনারও ব্যবাহরিক জীবনে বেশ সাফল্য আছে।

(৭) রাসেলের সমালােচনাঃ বিখ্যাত দার্শনিক রাসেল জেমসের সমালােচনা করে বলেন যে, অপ্রয়ােজন আছে যা কার্যকর, ফলপ্রসূ ইত্যাদি শব্দ দ্ব্যর্থক। বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে রাসেল বলেন যে, বিজ্ঞানের কোনো প্রকল্পের কার্যকারিতা বলতে বুঝায় যে, এ প্রকল্প থেকে যাচাইযােগ্য বাক্য নিঃসৃত হয়ে থাকে।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, প্রয়ােগবাদ সত্যতা সম্বন্ধীয় একটি সার্থক দার্শনিক মতবাদ না হলেও এ মতবাদ দর্শনের ইতিহাসে আলােড়ন সৃষ্টি করেছে। নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে জীবনকে অবলােকনের এক সুযােগ এনে দিয়েছে। দর্শনের ইতিহাসে প্রয়ােগবাদ এক বিশেষ ধরনের গণতান্ত্রিক মতবাদ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক