“ক্ষমতার পূর্ণ স্বতন্ত্রীকরণ সম্ভব নয়, কাম্যও নয়”- আলােচনা কর


প্রশ্নঃ “ক্ষমতার পূর্ণ স্বতন্ত্রীকরণ সম্ভব নয়, কাম্যও নয়”- আলােচনা কর।
অথবা, “ক্ষমতার পূর্ণ স্বতন্ত্রীকরণ সম্ভব নয়, কাম্য নয়” বিস্তারিত বর্ণনা কর।

ভূমিকাঃ Power বা ক্ষমতা হচ্ছে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। সমাজবদ্ধ মানুষ রাজনৈতিকভাবে সচেতন হওয়ার পর থেকে ক্ষমতা রাজনীতির এক ব্যাপক বিষয় হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। এ ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষিত না হলে নাগরিকের মৌলিক অধিকার ক্ষুন্ন হয়। এজন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ব্যক্তিস্বাধীনতা মতবাদের বিকাশের সাথে সাথে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ বা পৃথকীকরণ নীতির গুরুত্ব ও তাৎপর্য বৃদ্ধি পায়। যদিও রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হলাে ক্ষমতা, তথাপি কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা একদিকে যেমন সরকারকে স্বৈরাচারী করে তােলে অন্যদিকে তেমনি নাগরিক স্বাধীনতাও ক্ষুন্ন করে। তাই সরকারের স্বেচ্ছাচারিতা রােধ ও নাগরিক স্বাধীনতা রক্ষার্থে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি উদ্ভাবন করেছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক এরিস্টটল সর্বপ্রথম ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রবর্তন করলেও মধ্য অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফরাসি দার্শনিক মন্টেন্ধু 'The Spirit of The Laws' গ্রন্থের মাধ্যমে এ নীতির সঠিক ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন।

ক্ষমতার পূর্ণ স্বতন্ত্রীকরণ সম্ভব নয়, কাম্যও নয়ঃ আধুনিক সময়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ ক্ষমতা পৃথকীকরণ নীতিকে জোরালােভাবে সমালােচনা করেছেন। বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে প্রমাণিত হয় যে, সরকারি ক্ষমতাকে কঠোরভাবে তিনটি বিভাগের মধ্যে পৃথকভাবে ভাগ করে দেয়া বর্তমান সময়ে সম্ভব নয়।

রাষ্ট্র একটি জৈব সত্তা বিশেষ এবং এ ব্যবস্থায় বিভিন্ন বিভাগ পরস্পর সংযুক্ত। এদের সম্পূর্ণ পৃথকীকরণ সম্ভব নয়। কারণ সরকারের বিভিন্ন বিভাগ এমন অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত যে একটি অন্যটি থেকে সম্পূর্ণভাবে স্বতন্ত্র রাখলে রাষ্ট্রপরিচালনা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এ প্রসঙ্গে Prof MacIver যথার্থই বলেছেন, "What is needed infact, is not the separation of functions but their proper articulations, only then can responsibility be wedded to efficiency." অর্থাৎ, সরকারের কার্যাবলিকে পৃথক করার প্রয়ােজন নেই, বরং এদেরকে সঠিকভাবে সুবিন্যস্ত করার প্রয়ােজন রয়েছে। কেবল এভাবেই দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালনের সমন্বয়সাধন করা যায়। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি বাস্তবে কতটুকু অনুশীলনযােগ্য তা পরিষ্কার হয়ে ফুটে উঠবে নিম্নের আলােচনা থেকে-

১. ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি কাম্য নয়ঃ Prof MacIver রাষ্ট্রকে জীবদেহের সাথে তুলনা করেছেন। সরকার জীবদেহের ন্যায় একটি অখণ্ড সত্তা। বিভিন্ন অঙ্গপ্রতঙ্গের পারস্পরিক সহযােগিতার ফলে জীবদেহ যেমন টিকে থাকে তেমনি সরকারের বিভিন্ন বিভাগের পারস্পরিক সহযােগিতা ছাড়া সরকার চলতে পারে না। কাজেই পূর্ণ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের প্রত্যাশা করার অর্থ হচ্ছে সরকারের বিনাশ সাধন করা।

২. পরস্পরের সম্পর্কে যুক্তিঃ সরকারের তিনটি বিভাগ নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অপরাপর বিভাগের কাজও কিছু না কিছু করে থাকে। যত কঠোরভাবেই ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ করা হােক না কেন কোন বিভাগই সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে কাজ করতে পারে না। যেমন- সংসদীয় সরকার পদ্ধতিতে আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগ পরস্পরকে নিয়ন্ত্রণ করছে।

৩. সরকারের বিভিন্ন বিভাগকে বিভক্তিকরণ ঠিক নয়ঃ জেঙ্কস এর মতে, মন্টেস্কু ক্ষমতাকে যে তিনটি ভাগে বিভক্ত করেছেন তা ঠিক নয়। কারণ ক্ষমতা মূলত দুটি, যথাঃ শাসন বিভাগীয় ও আইন বিভাগীয়। বিচার বিভাগ মূলত শাসন বিভাগেরই অন্তর্গত।

৪. শাসনব্যবস্থায় অচলাবস্থা সৃষ্টিঃ অধ্যাপক লাস্কি মনে করেন যে, সরকারের তিনটি বিভাগকে যদি সম্পূর্ণভাবে পরস্পর থেকে পৃথক করা হয় তাহলে প্রতিটি বিভাগই নিজ নিজ দায়িত্ব এড়িয়ে তা অন্যের উপর চাপানাের চেষ্টা করবে। এর ফলে সমগ্র শাসনব্যবস্থা অচল হয়ে পড়বে।

৫. জনকল্যাণকর রাষ্ট্রের জন্য অনুপযােগীঃ বিভিন্ন সমালােচকদের দৃষ্টিতে কল্যাণরাষ্ট্রের কল্যাণকর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়, তা কখনাে ক্ষমতার পূর্ণ স্বতন্ত্রীকরণ হলে সম্ভব হবে না। জনকল্যাণকর রাষ্ট্রে জনকল্যাণকর নীতির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হলে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি কার্যকরী করা অসম্ভব। কেননা ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির জটিলতা কল্যাণকর রাষ্ট্রের আদর্শ ও উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করে।

৬. সরকারের তিনটি বিভাগের ক্ষমতা সমান নয়ঃ আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইন বিভাগের স্থান অন্য দুটি বিভাগের উর্ধ্বে। আইন বিভাগ শুধু আইন প্রণয়নই করে না, বরং শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণও করে থাকে। বর্তমান সময়ের সংসদীয় রাষ্ট্রের আইনসভাগুলাে কেবিনেটের সিদ্ধান্তকে অনুমােদনকারী সংস্থায় পরিণত হয়েছে। ফলে পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্বের পরিবর্তে কেবিনেটের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

৭. প্রকারের বিভিন্ন বিভাগকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব নয়ঃ সমালােচকদের মতে, সরকারের তিনটি বিভাগকে বিচ্ছিন্ন সম্ভব নয়। সরকার একটি অখণ্ড ও অবিচ্ছেদ্য সত্তা। সরকারের সকল কাজই কমবেশি সকল বিভাগের সাথে সংশ্লিষ্ট। সরকারের এ তিনটি বিভাগকে কোনক্রমেই কৃত্রিমভাবে পৃথক করা যায় না। এক সময় মনে করা হতাে যে, আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতার পূর্ণ স্বতন্ত্রীকরণ নীতি কার্যকরী করা হয়েছে। কিন্তু তা সম্ভব হয় নি। সেখানে সকল বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার পারস্পরিক নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতি চালু হয়েছে।

৮. ব্যক্তিস্বাধীনতার জন্য স্বতন্ত্রীকরণ একমাত্র উপাদান নয়ঃ মন্টেস্কু ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণকে ব্যক্তিস্বাধীনতার শ্রেষ্ঠ রক্ষাকবচ বলে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ব্যক্তিস্বাধীনতার শ্রেষ্ঠ রক্ষাকবচ হচ্ছে জনগণের সদাজাগ্রত মনােভাব। ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষার মতাে সুব্যবস্থা থাকলেও জনগণ যদি সচেতন না হয়, তবে এ সম্পর্কে কোন প্রচেষ্টাই সফল হবে না।

৯. দায়িত্বহীনতাঃ সরকারের তিনটি বিভাগ স্বতন্ত্র হয়ে নিজস্ব আওতার মধ্যে অবস্থান করলে তাদের দায়িত্বশীলতা বিলুপ্ত হবে, পরস্পরের মধ্যে সংঘাত বাধবে, সহযােগিতা বিনষ্ট হবে এবং এর ফল হিসেবে শাসনকার্যে বিশৃঙ্খলা ঘটবে। এ নীতি সুশৃঙ্খলভাবে শাসনকার্য পরিচালনায় সহায়ক হয় না।

১০. কর্মক্ষমতা হ্রাসঃ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির কঠোর প্রয়ােগ সরকারের বিভাগগুলাের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করে। ফলে ঐক্যের মনােভাব ক্ষুন্ন হয় এবং সরকারের কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়। তাই ক্ষমতার পৃথকীকরণ রাষ্ট্রের মঙ্গলের জন্য অবাঞ্ছনীয়।

১১. অস্বাভাবিকঃ নীতি অনুসারে প্রত্যেক বিভাগকে একই পর্যায়ে দেখতে হয়। কিন্তু সকল পদ্ধতিতে তিনটি বিভাগ সমান মর্যাদার অধিকারী হয় না। রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনে শাসন বিভাগ এবং মন্ত্রিপরিষদে আইন বিভাগের প্রাধান্য সর্বতােভাবে স্বীকৃত। কিন্তু বিচার বিভাগের প্রাধান্য স্বীকৃত না হলে শাসন প্রক্রিয়া ন্যায়ানুগ প্রক্রিয়ায় পরিচালিত হতে পারে না। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। উইলােবি বলেছেন, এর প্রয়ােগ করতে গেলে সমস্যায় পড়তে হবে।

১২. মন্টেস্কুর অভিমত অসম্পূর্ণঃ মন্টেস্কু অভিমত ব্যক্ত করে বলেছেন, “ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ ব্যতীত ব্যক্তিস্বাতন্ত্র রক্ষিত হতে পারে না।” কিন্তু তার এ অভিমত ঠিক নয়। কারণ জনগণের সতর্ক দৃষ্টিই ব্যক্তিস্বাধীনতার শ্রেষ্ঠ রক্ষাকবচ।

১৩. এ মতবাদ অনৈতিহাসিকঃ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ সম্পর্কে মন্টেস্কুর এ ধারণা ভ্রান্ত ও অনৈতিহাসিক। মন্টেস্কু বলেছিলেন যে, ইংল্যান্ডে ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ নীতি কার্যকরী হয়েছে। বাস্তবে লক্ষ্য করা যায় যে, সেখানে সংসদীয় গণতন্ত্র চালু হয়েছে। ফলে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি কার্যকরী হয় নি।

১৪. ফাইনারের অভিমতঃ এই নীতির কুফল সম্পর্কে অধ্যাপক ফাইনার (Finer) বলেন, “পরিপূর্ণ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি প্রয়ােগ করলে সরকার কখনাে মূৰ্ছা যাবে, কখনাে ধনুষ্টংকার রােগীর মতাে হাত পা ছুড়তে থাকবে, আবার কখনাে অসাড় হয়ে পড়বে।”

১৫. দায়িত্বহীনতার সৃষ্টিঃ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি অনুযায়ী আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগকে যদি সম্পূর্ণরূপে পৃথক করা হয়, তাহলে জরুরি প্রয়ােজনেও বিভাগ তিনটি পরস্পরের থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখবে এবং যে কোন ব্যাপারে সহযােগিতা ও পরামর্শ প্রদান থেকেও বিরত থাকবে। অর্থাৎ কোন বিভাগই দায়িত্বশীল আচরণ করবে না।

উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ অবাঞ্ছনীয়ও বটে। এ নীতিকে কঠোরভাবে প্রয়ােগ করা হলে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা ও অনৈক্যের সৃষ্টি হবে। প্রত্যেক বিভাগই আলাদা হয়ে যাবে এবং তাদের সহযােগিতা ও ঐক্যের মনােভার বিনষ্ট হবে। এতে করে সরকারের ক্ষমতাও হ্রাস পাবে। আর আধুনিক কালে প্রত্যেকটি সরকারেরই দায়িত্ব ও কার্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ প্রেক্ষিতে এক বিভাগ অপর বিভাগের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কার্য সম্পন্ন করতে হবে। মূলত শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণরূপে আলাদা রেখে কোন সরকারই গঠন করা যায় না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক