মহানবী (স)-এর কৃতিত্ব ও চরিত্র বর্ণনা কর


প্রশ্নঃ মহানবী (স)-এর কৃতিত্ব ও চরিত্র বর্ণনা কর।
অথবা, রাসূলুল্লাহ (স)-এর চারিত্রিক গুণাবলি সম্পর্কে যা জান লেখ।

উপস্থাপনাঃ বিশ্বের ইতিহাসে যে সকল মনীষী সার্বিক গুণে গুণান্বিত, তাদের মধ্যে মহানবী (স) অতুলনীয়। তার এ মহান চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বিশ্বের সমগ্র মানব জাতির জন্য উত্তম আদর্শ। মানব জীবনের এমন কোনাে দিক নেই যাতে তার উত্তম আদর্শের ছোঁয়া নেই। তিনি ছিলেন একজন সফল সেনাপতি, দূরদশী শাসক, বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ, আদর্শ সমাজ সংস্কারক, সংসারী ও অভিভাবক। তার সমকক্ষ কোনাে ব্যক্তিই হাতে পারে না, আর তা আদৌ সম্ভব নয়। তার তুলনা তিনি নিজেই।

মহানবী (স)-এর কৃতিত্বঃ মহানবী (স) একাধারে একটি ধর্ম, একটি জাতি ও একটি সুবিশাল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে পৃথিবীর ইতিহাসে গৌরবময় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। পৃথিবীর সব কীর্তিমান মহাপুরুষ যে কৃতিত্ব অর্জন করেছেন তা মহানবী (স)-এর কৃতিত্বের নিকট খুবই নগণ্য। আমেরিকার প্রখ্যাত জ্যোতির্বিদ ও ঐতিহাসিক মাইকেল হার্ট মহাবী (স)-কে জগতের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তিমান মহাপুরুষ বলে অভিহিত করেছেন। যে কোনাে দিক দিয়ে বিচার করা হােক না কেন, তিনি জীবনের সর্বক্ষেত্রেই সাফল্য অর্জন রেছেন। যে সকল ক্ষেত্রে মহানবী (স)-এর কৃতিত্বের ছাপ রয়েছে সেগুলাে হলাে-

১. পৌত্তলিক ও শিরকতন্ত্রের পরিবর্তে নির্ভেজাল একত্ববাদ প্রতিষ্ঠা।

২. একটি কলহপ্রিয় জাতিকে পৃথিবীর বুকে সভ্য জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা।

৩. একটি সুবিশাল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা।

৪. সফল সেনাপতি ও যােদ্ধা হিসেবে সকল যুদ্ধে সাফল্য অর্জন।

৫. একজন যােগ্য শাসক হিসেবে শাসন সংস্কার।

৬. পুঁজিবাদী অর্থনীতির মূলে কুঠারাঘাত করে সুষ্ঠু ইসলামী অর্থব্যবস্থার প্রচলন।

৭. সুষ্ঠু ও জনকল্যাণমূলক রাজস্ব ব্যবস্থা গড়ে তােলা।

৮. দক্ষ সমাজ সংস্কারক হিসেবে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন।

৯. নিরক্ষরতা দূরীকরণে শিক্ষাকে তিনি বাধ্যতামূলক করেন।

১০. দক্ষ রাজনৈতিক সংস্কারক হিসেবেও এমন কতিত্বের দাবিদার।

এক কথায়, জীবনের প্রত্যেক ক্ষেত্রেই তিনি পূর্ণ সফলতা অর্জন করেছিলেন। তার ন্যায় কৃতিত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব পৃথিবীর ইতিহাসে দ্বিতীয়টি নেই।

মহানবী (স)-এর চরিত্রঃ একজন চরিত্রবান পুরুষ হওয়ার জন্য যে সকল গুণ থাকা প্রয়ােজন সেসবের অপূর্ব সমাবেশ ঘটেছিল মহানবী (স)-এর চরিত্রে। তার চরিত্র সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ঘােষণা করেন- “হে নবী! নিশ্চয়ই আপনি উত্তম চরিত্রের অধিকারী”। মহানবী (স)-এর চারিত্রিক গুণাবলির কতিপয় দিক নিম্নে আলােচনা করা হলো।

১. সর্বশ্রেষ্ঠ মানবঃ হযরত মুহাম্মদ (স) ছিলেন ধরাপৃষ্ঠে আগত অনাগত সকল মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব। তার মতাে ন্যায়নিষ্ঠা ও উন্নত চারিত্রিক গুণাবলি সম্পন্ন মানুষ পৃথিবীতে কখনো আসেনি আর ভবিষ্যতেও আসবে না।

২. প্রগাঢ় বিশ্বাসীঃ তার সর্বোত্তষ্ট চারিত্রিক গুণাবলির মূল ভিত্তি ছিল আল্লাহর প্রতি প্রগাঢ় বিশ্বাস। সুখে দুঃখে, দরিদ্র এতিম অবস্থা থেকে শুরু করে রাজ্য শাসকের মর্যাদায় উন্নীত হয়েও প্রতিটি মুহূর্তে মহানবী (স) আল্লাহর প্রতি দৃঢ়বিশ্বাসী ও নির্ভরশীল ছিলেন।

৩. সত্যবাদিতা ও বিশ্বস্ততাঃ বিশ্বস্ততা ও সত্যবাদিতার জন্য মহাবী (স) বাল্যকালেই আরব সমাজে সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। অরব সমজের লােকেরা বাল্যকালে তাকে ‘আল আমীন' বলে ডাকত। তিনি কঠিন বিপদেও মিথ্যার আশ্রয় নিতেন না। মহানবী (স)-এর জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ই সত্যবাদিতা ও বিশ্বস্ততায় পরিপূর্ণ।

৪. সততা ও সদানন্দ স্বভাবঃ মহানবী (স)-এর চরিত্রের অন্যতম অলঙ্কার সততা। জীবনের কঠিন সময়ও তিনি বাস্তবতার বিপরীত কোনো পন্থা অবলম্বন করেননি। চরম বিপদেও তিনি হাসিমুখে সকলের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করতেন।

৫. ন্যায়পরায়ণতাঃ ন্যায়পরায়ণতা ছিল রাসূল (স)-এর অত্যুজ্জ্বল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। তিনিই পৃথিবীতে সর্বপ্রথম ন্যায়পরায়ণতার আলােকে সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। তিনি আত্মীয়-অনাত্মীয়, ধনী-গরিব, ছােট বড়, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের মাঝে কোনাে পার্থক্য করেননি।

৬. ওয়াদা পালনঃ ওয়াদা পালন মানব চরিত্রের উত্তম গুণাবলির অন্যতম। মহানবী (স) জীবনের সর্বস্তরে ওয়াদা পালনে সচেষ্ট ছিলেন। ইসলামের শত্রুদের সাথে সম্পাদিত বিভিন্ন ওয়াদা ও সন্ধিসমূহ তার পক্ষ থেকে কখনাে প্রথমে ভঙ্গ করা হয়নি।

৭. মার্জিত ব্যবহারঃ মহানবী (স)-এর ব্যবহার ছিল অত্যন্ত মার্জিত। তিনি সকলের সাথে দিন সহকারে কথা বলতেন। জীবনের কোনাে অংশেই তিনি কারাে সাথে দুর্ব্যবহার ও রূঢ় আচরণ করেননি। তিনি শত্রুদের সাথেও বিনয়ের সাথে কথা বলতেন।

৮. সাহসী যােদ্ধাঃ মহানবী (স) ছিলেন অসীম সাহসী যােদ্ধা। তিনি তার দৃঢ়টা ও সাহসিকতর দ্বারা অনেক পরাক্রমশালী শত্রু বাহিনীকেও পরাস্ত করতে সক্ষম হয়েছেন।

৯ বিপ্লবী বীরঃ মহানবী (স) ছিলেন একজন প্রখ্যাত বিপ্লবী বীর। অন্ধকারে নিপতিত আরব জাতির সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, রাষ্ট্রীয় সকল ক্ষেত্রেই তিনি বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন।

১০. পরম ক্ষমাশীলঃ মহানবী (স) ছিলেন পরম ক্ষমাশীল ও দয়ালু। তিনি শত্রুকে ক্ষমা করে ইসলামের দাওয়াত দিতেন। মক্কা বিজয়ের পর অত্যাচারী আরব জাতিকে তিনি সাধারণ ক্ষমা দান করে তার অনুপম চরিত্রেরই বহিঃপ্রকাশ করেছেন।

১১. ধৈর্যশীলঃ ধৈর্যশীলতা ছিল মহানবী (স)-এর চরিত্রের অন্যতম দিক। তিনি তায়েফে পাথরের আঘাতে জর্জরিত হওয়ার পরও ধৈর্য ধারণ করে তায়েফবাসীর হেদায়াতের জন্য পরম করুণাময়ের দরবারে প্রার্থনা করেছিলেন।

১২. সুদক্ষ শাসক ও কুটনীতিবিদঃ মহানবী (স) ছিলেন একজন সুদক্ষ শাসক ও সফল কুটনীতিবিদ। তার দক্ষতা ও কূটনৈতিক জ্ঞান দিয়েই তিনি মদিনাকে বিশ্বের আদর্শ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। হােদায়বিয়ার সন্ধি ও মদিনা সনদে তার রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রজ্ঞার শ্রেষ্ঠ পরিচয় ফুটে উঠেছে।

১৩. উত্তম প্রতিবেশীঃ মহানবী (স) ছিলেন প্রতিবেশীর প্রকৃত সাহায্যকারী। তিনি প্রতিবেশীদের সাথে কোমল কণ্ঠে কথা বলতেন। তাদের সুখে দুঃখে, বিপদে আপদে সর্বদ পাশে থাকতেন।

১৪. দয়ালু মহামানবঃ অভাবগ্রস্তকে তিনি কখনাে হতাশ করেননি। নিজে না খেয়েও তিনি গরিব মুসাফির ও ক্ষুধার্তের ক্ষুধা নিবৃত্ত করতেন। শত্রু-মিত্র, স্বজন-পরজন, সকলের ভইন তার অবারিত করুণা সমভাবে বর্ষিত হতাে।

১৫. অনাড়ম্বর জীবনঃ মহানবী (স) ছিলেন একজন আদর্শ সংসারকর্মী। তিন বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি হওয়া সত্ত্বেও নিজের জামা নিজেই সেলাই করতেন। দিনার মসজিদে নববী নির্মাণের সময় তিনি নিজের মাথায় বােঝা নিয়ে সে প্রমাণ রেখেছেন। তিনি একাধারে মেহবান পিতা, প্রেমময় স্বামী ও ধৈর্যশীল সংসারী ছিলেন।

উপসংহারঃ মহানবী (স) ছিলেন মানব জাতির জন্য এক মহান আদর্শ। তার চরিত্রে উত্তম মানবিক গুণাবলির সফল সমাবেশ ঘটেছিল। বিশ্বের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ। শাসক, সংস্কারক ও রাজনীতিবিদ হিসেবে যেমন তিনি খ্যাতিমান, তেমনি একজন সহজ, স্বাভাবিক, কোমল ও সুন্দর মনের মানুষ হিসেবেও তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক