একটি আদর্শ জাতি গঠনকারী হিসেবে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর অবদান বর্ণনা কর


প্রশ্নঃ একটি আদর্শ জাতি গঠনকারী হিসেবে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর অবদান বর্ণনা কর।
অথবা, সংস্কারক ও জাতি গঠনকারী হিসেবে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর কৃতিত্ব মূল্যায়ন কর।
অথবা, একটি নতুন জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মহানবী (স)-এর কৃতিত্ব আলােচনা কর।

উপস্থাপনাঃ বিশ্ব মানবের মুক্তির দিশারি হযরত মুহাম্মদ (স) নতুন জাতি গঠনে যে ভূমিকা রেখেছিলেন, বিশ্বের ইতিহাসে তা চির উজ্জ্বল ও অম্লান হয়ে থাকবে। তিনি ছিলেন মুসলিম উম্মাহর সঠিক দিশারি। অতি অল্প সময়ে কুসংস্কারাচ্ছন্ন, গােত্রীয় কলহে শতধাবিভক্ত একটি জাতিকে তিনি সুশৃঙ্খল ও সুসংবদ্ধ জাতিতে পরিণত করে বিশ্ব ইতিহাসে অম্লান হয়ে আছেন।

জাতি গঠনে মহানবী (স)-এর অবদান

১. সংঘবদ্ধ জাতি গঠনঃ ঐতিহাসিক আমীর আলী বলেন, হযরত মুহাম্মদ (স) মদিনায় আগমনের পূর্বে আরবরা ছিল শতধাবিভক্ত ছিল অন্যায়, অত্যাচার ও বিশৃঙখলায় নিমজ্জিত। তাই তিনি প্রথমেই সেখানে একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আরবদেরকে একটি সংঘবদ্ধ সুশৃঙ্খল জাতিতে পরিণত করেন।

২. রক্ত সম্পর্কের পরিবর্তে ধর্মীয় বন্ধনঃ কলহে লিপ্ত আরবদের পরস্পরের মধ্যে সৃষ্ট পর্বত সমান কৃত্রিম পার্থক্য দূরীকরণে ধর্মকে যথােপযুক্ত সেতু বন্ধন হিসাবে চিহ্নিত করে অভাবিত সাফল্য অর্জন করেন। আরবের ইতিহাসে রক্তের পরিবর্তে ধর্মের ভিত্তিতে সমাজ গঠনের এটাই প্রথম প্রয়াস।

৩. বিশ্বজনীন জাতির প্রতিষ্ঠাঃ বিশ্বনবী (স) ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে ভৌগােলিক সীমারেখা, দেশ, বর্ণ, গােত্র তথা সকল আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদের গণ্ডি পেরিয়ে এক বিশ্বজনীন মুসলিম জাতিসত্তার প্রতিষ্ঠা করেন।

৪. ভ্রাতৃত্ব ও সদিচ্ছার ভিত্তিতে সকল গােত্রের সমন্বয়ঃ মহানবী (স) জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণির মানুষের সদিচ্ছা ও সহযােগিতার ভিত্তিতে একটি জাতি গঠন করেন। সকল ধর্ম ও বংশের লােকদের সমন্বয়ে মদিনা সনদের মাধ্যমে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনে তার সফলতা বিস্ময়কর।

৫. মানবতাবােধের উন্মেষঃ হযরত (স) আরবদেরকে সংকীর্ণ গােত্রপ্রীতি পরিহারে উদ্বুদ্ধ করেন এবং মানবতাবােধের মহান আদর্শে অনুপ্রাণিত করেন। মদিনায় আনসার ও মুহাজিরদেরকে ভ্রাতৃত্বের সুমহান বন্ধনে আবদ্ধ করে এক নতুন দিগন্ত উন্মােচন করেন।

৬. আদর্শের ভিত্তিতে জাতিগঠনঃ মহানবী (স) আরবদের গােত্রপ্রীতি ভেঙ্গে সকল গােত্র ও সম্প্রদায়কে একই আদর্শের পথে পরিচালনার উদ্যোগ নেন। ফলে আরবরা এক আদর্শিক জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

৭. আন্তঃসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিঃ জাতি-ধর্ম-সম্প্রদায়ের মধ্যে এক জাতি গঠনের আদর্শকে বাস্তবায়িত করার মানসেই তিনি আন্তঃসাম্প্রদায়িক বিবাহে উৎসাহে দান এবং স্বয়ং ভিন্ন সম্প্রদায়িক বিবাহে উৎসাহে দান এবং স্বয়ং ভিন্ন সম্প্রদায়ের রমণীদের পানি গ্রহণ করেন। তার এসবের মূল লক্ষ ছিল বিভিন্ন বর্ণ ও গােত্রের সমন্বয়ে এক সংহত ইসলামী উম্মাহ গঠন।

৮. সকল সম্প্রদায়ের ঐক্যবিধানঃ মহানবী (স) অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে অরাজকতা ও অন্তর্দ্বন্দ্বে জর্জরিত আরব জনগােষ্ঠীর সার্বিক কল্যাণে ঐক্যবিধানের সাধনায় তার সমস্ত অন্তর শক্তি ও প্রজ্ঞা নিয়ােজিত করেন এবং তাদেরকে এক জাতিভুক্ত করে সকলের বিস্ময়ের উদ্রেক করেন।

৯. বিশ্বের প্রথম সংবিধান দাতাঃ বিশ্বনবী (স) মদিনার ইহুদি, খ্রিস্টান, পৌত্তলিক প্রভুতি অমুসলিম জনগােষ্ঠীর সমর্থন ও সহযােগিতা নিয়ে সকলের অধিকার সংবলিত একটি সর্বপ্রথম লিখিত সংবিধান দান করেন। এটি জাতি গঠনের অন্যতম অগ্রদূত।

১০. জাতিগঠন প্রক্রিয়ার নীতিঃ রাসূল (স) সকল ধর্মের নেতার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন এবং তাদের দেবদেবীর নিন্দা না করতে নির্দেশ দেন। এটাই পরধর্মের প্রতি তার উদারতা, সহনশীলতা ও মহত্তের পরিচয় পাওয়া যায়, এর ফলেই তার জাতিগঠন প্রক্রিয়া সহজতর হয়।

১১. সফল সেনাপতিঃ ঐতিহাসিক হিট্টি বলেন, মহানবী (স) ছিলেন একজন সফল সেনাপতি। ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন করার জন্য তিনি ছােট বড় ১৯টি যুদ্ধ পরিচালনা করেন। অপূর্ব যুদ্ধ কৌশল অবলম্বনে তিনি স্বল্পসংখ্যক সৈন্য নিয়ে বিরাট বাহিনীকে পরাজিত করেন।

১২. বিশ্ব গণতন্ত্রের মানসপুরুষঃ মহানবী (স) ছিলেন গণতন্ত্রপ্রিয়। তিনি পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করলেও তাদেরকে ঘৃণা করতে নিষেধ করেছেন। সকল পথ-মত-ধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে মদিনার সংবিধান রচনা ও সহাবস্থান, ইত্যাদি গণতন্ত্রেরই বাস্তব রূপায়ণ।

১৩. আদর্শ গৃহস্বামীঃ মহানবী (স) অন্যান্য দায়িত্ব সম্পাদনের সাথে সাথে একজন আদর্শ স্বামীর দায়িত্বও পালন করেছিলেন, যা আজও বিশ্বের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে।

সংস্কারক হিসেবে মহানবী (স)-এর অবদানঃ

১. ঐকমত্যের শাসন প্রতিষ্ঠাঃ সুষ্ঠু শাসন পরিচালনায় তিনি শাসক ও শাসিতের মধ্যে পার্থক্য দূরীভূত করে ঐকমত্যের শাসন কায়েম করেন। এভাবে শাসন সংস্কার করে আরব অনারব সকল সম্প্রদায়কে তিনি সমমর্যাদা দান করেন।

২. রাজনৈতিক সংস্কারকঃ ঐতিহাসিক মাসুদী বলেন, নবী করীম (স) একটি বিশখল জাতিকে সুসংহত করে সুশৃঙ্খল জাতিতে পরিণত করেন। তার প্রণীত মদিনা সনদ ইসলামী ভ্রাতৃত্ববােধের ভিত্তিতে একটি নতুন জাতির জন্ম দেয়। তার অপূর্ব রাজনৈতিক দূরদর্শিতায় স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটে এবং আল্লাহর সার্বভৌমত্ব স্বীকৃতি লাভ করে।

৩. সামাজিক সংস্কারকঃ হযরত মুহাম্মদ (স) সমাজের চেহারা পাল্টে দিয়ে যে অভূতপূর্ব বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেন তা সত্যিই বিস্ময়কর। মদ্যপান, জুয়া খেলা, নারী নির্যাতনসহ সকল প্রকার সমাজবিরােধী কার্যকলাপ তিনি সমূলে বিনাশ করেন। সমাজের সার্বিক কল্যাণ সাধনে তিনি একটি আদর্শ ইসলামী রাষ্ট্র উপহার দেন।

8. অর্থনৈতিক সংস্কারকঃ তৎকালীন আরবদের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ছিল পঙ্গু। মহানবী (স) সম্পদের সুষম বণ্টনে উঁচু নীচু ভেদাভেদ তুলে দিয়ে একটি সুখী সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন।

৫. শিক্ষা সংস্কারকঃ মহানবী (স) শিক্ষা প্রসারের ওপর সর্বাধিক গুরুত্বারােপ করেন। তিনি শিক্ষালাভ ও জ্ঞানার্জনকে জেহাদতুল্য ঘােষণা করেন। অহী দ্বারা প্রাপ্ত জ্ঞানের শিখা জ্বালিয়ে তিনি তিমিরাচ্ছন্ন আরবকে ধন্য করেন। মিল্টন যথার্থই বলেছেন Education is harmonious development of body mind and soul.

উপসংহারঃ ইসলামী প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মহানবী (স) বিশ্বের ইতিহাসে অমর অম্লান হয়ে আছেন। তার প্রচেষ্টা ও কঠোর সাধনার ফলস্বরূপ আরবে একটি আদর্শ জাতির আত্মপ্রকাশ ঘটে। তাই এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক P. k. Hitti বলেন, বর্ণ ও গােত্রের পরিবর্তে ধর্মের ভিত্তিতে সমাজ গঠনের প্রচেষ্টা আরবে এটাই প্রথম।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক