নৈতিক অবধারণের বিষয়বস্তু ব্যাখ্যা কর


প্রশ্নঃ নৈতিক অবধারণের বিষয়বস্তু ব্যাখ্যা কর।
অথবা, নৈতিক অবধারণের সঠিক বিষয়বস্তু নিরূপণ কর।
অথবা, নৈতিক অবধারণের প্রকৃত বিষয়বস্তু আলােচনা কর।
অথবা নৈতিক অবধারণের বিষয়বস্তু তুলে ধর।

উত্তরঃ ঐচ্ছিক ক্রিয়া, ব্যক্তি, চরিত্রের সংরক্ষণ ইত্যাদি হচ্ছে নৈতিক অবধারণের বিষয়বস্তু। যা ইচ্ছাকৃত নয়, তার কোনাে নৈতিক মূল্য নেই। স্বেচ্ছায় অভ্যাসলব্ধ ক্রিয়াও নৈতিক অবধারণের বিষয়বস্তু, কেননা ঐচ্ছিক ক্রিয়া পুনঃপুন সংঘটিত হলেই তা অভ্যাসলব্ধ ক্রিয়ায় পরিণত হয়। মানব আচরণের ভালােত্ব-মন্দত্ব, ন্যায়ত্ব, অন্যায়ত্ব, ঔচিত্য, অনৌচিত্য ইত্যাদি মূল্যায়ন করা হয় নৈতিক অবধারণের মাধ্যমে।

নৈতক অবধারণের বিষয়বস্তু (Object of Moral Judgement): নিম্নে নৈতিক অবধারণের বিষয়বস্তু সম্পর্কে আলােচনা করা হলাে-

সুখবাদী মতঃ সুখবাদীরা মনে করেন, নৈতিক অবধারণ গঠিত হয় কাজের ফলাফলের উপর। কাজের উদ্দেশ্যের উপর নয়। তাই এ মত অনুযায়ী বলা যায়, কাজের ফলাফল যদি ভালাে হয়, তাহলে কাজটি ভালাে এবং কাজের ফলাফল, যাদ মন্দ হয়, তাহলে কাজটি মন্দ। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একজন সুদক্ষ চিকিৎসক একজন রােগীকে রােগমুক্ত করার জন্য তার দেহে খুব সতর্কতার সাথে অস্ত্রোপচার করলেন। এতদসত্ত্বেও রােগীটি মারা গেল। এখানে উদ্দেশ্য ভালাে ছিল। কিন্তু ফল মন্দ হলে এখানে চিকিৎসকের কাজটিকে মন্দ বলা যায় না। কেননা তার উদ্দেশ্য ভালাে। কিন্তু ফল মন্দ হলাে। এখানে চিকিৎসকের কাজটিকে মন্দ বলা যায় না। কেননা তার উদ্দেশ্য ভালাে ছিল যদিও ফল মন্দ হয়েছিল। আবারও কখনও কখনও দেখা যায় যে, নৈতিক কর্তা ভার করতে চান নাই অর্থাৎ উদ্দেশ্য ভালাে ছিল না। কিন্তু কাজটির ফল ভালাে হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ড. জনসনের বক্তব্য উল্লেখ করা যায়। তিনি বলেন কোনাে কাজের নৈতিকতা নির্ভর করে উদ্দেশ্যের উপর, যে উদ্দেশ্যের দ্বারা পরিচালিত হয়ে আমরা কাজটি সম্পন্ন করে থাকি। বিরক্তি এড়াতে গিয়ে যদি আমি একজন ভিক্ষুককে মাথা ফাটানাের উদ্দেশ্যে তার দিকে একটা অর্ধ ক্রাউন ছুড়ে ফেলি এবং যদি ভিক্ষুকটি সেটি কুড়ে নিয়ে খাবার কিনে খেয়ে তার ক্ষুধা মেটায় তাহলে বাহ্যিক ফল ভালাে হওয়া সত্ত্বেও এখানে আমার কাজটি খুবই মন্দ। এখানে নিঃসন্দেহে কাজটি মন্দ। কেননা আমার উদ্দেশ্য মন্দ ছিল। যদিও ফলটি ভালাে ছিল। এটা দেখা যায় যে, কাজের ফলাফল দেখে সব সময় কাজের ভালােত্ব বা মন্দত্ব নিরূপণ করা সম্ভব নয়। তাই অভ্যন্তরীণ উদ্দেশ্যে ও বাহ্যিক ফলাফলের মধ্যে যখন অসঙ্গতি দেখা দেয়, তখন বাহ্যিক ফলাফলের পরিবর্তে অভ্যন্তরীণ উদ্দেশ্যের প্রেক্ষিতেই কাজটির নৈতিক মূল্য নিরূপণ করা হয়।

বুদ্ধিবাদী মতঃ বুদ্ধিবাদীদের মতে, কাজের উদ্দেশ্যের উপর নির্ভর করে কাজের ভালােত্ব ও মন্দত্ব নিরূপণ করা হয়। কাজটির ফলাফলের উপর নির্ভর করে নয়। অর্থাৎ কোনাে কাজের উদ্দেশ্য যদি ভালাে হয়, তাহলে কাজটি ভালাে এবং উদ্দেশ্য যদি মন্দ হয়, তাহলে কাজটি মন্দ। কান্টের মতে সদিচ্ছা ব্যতীত এই জগতে বা এই জগতের বাইরে এমন কিছু নেই যাকে ভালাে বলা যায়। তাই উদ্দেশ্যের দ্বারাই কাজের ভালােত্ব-মন্দত্ব নিরূপণ করা হয়।

কেবল উদ্দেশ্য নয়, অভিপ্রায়ঃ বুদ্ধিবাদীরা মনে করেন যে, নৈতিক অবধারণ কেবল উদ্দেশ্যের উপর গঠিত হয়। কিন্তু বুদ্ধিবাদীদের এই মতবাদ সন্তোষজনক নয়। কেননা নিছক উদ্দেশ্যের উপর নির্ভর করে নৈতিক-অবধারণ গঠন করলে তা ন্যায়সঙ্গত হয় না। উদ্দেশ্য ভালাে হলেও অনেক সময় উদ্দেশ্য সাধনের উপায় মন্দ হতে পারে এবং ফলে কাজটি মন্দ হতে পারে। ইংরেজ দস্যু রবিনহুডের উদ্দেশ্য ছিল ধনসম্পদ লণ্ঠন করে তা গরীবদের মধ্যে বিতরণ করা এবং গরীবদের কষ্ট লাঘব করা। এক্ষেত্রে তার উদ্দেশ্য যে ভালাে ছিল, সে সন্দেহ পােষণ করার অবকাশ নেই। কিন্তু তার উদ্দেশ্য সাধনের উপায় মন্দ ছিল বলে তার কাজকে ন্যায়সঙ্গত বলা যায় না। আর এ থেকে এটা নিঃসৃত হয়ে যে নিছক উদ্দেশ্য নয় বরং অভিপ্রায় নৈতিক অবধারণের বিষয়বস্তু। উল্লেখ্য যে, উদ্দেশ্য বলতে আমরা এক্ষেত্রে নির্বাচিত বস্তুর ধারণা এবং অভিপ্রায় বলতে নির্বাচিত বা কাম্যবস্তুর ধারণা ও উদ্দেশ্য সাধনের উপায়কে বুঝে থাকি। এখানে অভিপ্রায় উদ্দেশ্য থেকে ব্যাপকতর অর্থ বহন করে। অর্থাৎ অভিপ্রায় বলতে আমরা উদ্দেশ্য সাধনের উপায় ও কাজটির ঈপ্সিত বলতে বুঝে থাকি। এদিক থেকে উদ্দেশ্য অভিপ্রায়ের একটা অংশ বা দিক মাত্র। যারা বলেন যে, উদ্দেশ্য ভালাে হলেই কাজ ভালাে হবে, বা লক্ষ্যই উপায়কে সমর্থন করে বা যার শেষ ভালাে তার সব ভালাে, তাদের মতকে সমর্থন করা যায় না। তাই কেবল উদ্দেশ্য নয়, বরং অভিপ্রায় নৈতিক অবধারণের সঠিক বিষয়বস্তু।

কেবল চরিত্র নয়, অভিপ্রায়ঃ আবার অভিপ্রায়কে মানুষের চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করে চরিত্রকে নৈতিক অবধারণের বিষয়বস্তু বলে মনে করা হয়। ম্যাকেনজীর মতে, নৈতিক অবধারণের ক্ষেত্রে, প্রত্যক্ষভাবে হােক বা পরােক্ষভাবে হােক, নৈতিকতার চরিত্রকেই নৈতিক অবধারণের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তার মতে যে কাজটি করা হয়েছে। কেবল তার উপরে নয় বরং যে কাজটি করছে তাকেই সর্বদা নৈতিক অবধারণের বিষয়বস্তু বলে মনে করা হয়। চরিত্র অভিপ্রায়ের বহিঃপ্রকাশ বলে চরিত্রকে নৈতিক অবধারণের বিষয়বস্তু মনে করা হলে অসুবিধাও সৃষ্টি হয়। কেননা অনেক সৎ চরিত্রের লােকের অভিপ্রায় মন্দ হতে পারে। বা অসৎ, চরিত্রের লােকের অভিপ্রায় ভালাে হতে পারে এবং ফলে সৎ -চরিত্রের লােকও মন্দ কাজ এবং অসৎ তাদের চরিত্র ও অভিপ্রায়ের মধ্যে অসঙ্গতি থাকতে পারে। আর এদিক থেকে অভিপ্রায়কে নৈতিক অবধারণের সঠিক বিষয়বস্তু বলে বিবেচনা করা যেতে পারে।

উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, ঐচ্ছিক ক্রিয়া ও স্বেচ্ছালব্ধ কাজের নৈতিক মূল্যায়নকেই নৈতিক অবধারণ বলা হয়। কাজের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য সাধনের উপায়, কাজের ফলাফলের ভিত্তিতে নৈতিক অবধারণ মূল্যায়ন করা হয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক