উত্তরঃ সেলিনা হােসেনের ‘কাঁটাতারে প্রজাপতি’ উপন্যাসে ইলা মিত্র বাস্তব জীবন থেকে নেওয়া ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক চরিত্র। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠক এবং রমেন মিত্রের স্ত্রী।
সেলিনা হােসেনের ‘কাঁটাতারে প্রজাপতি' নাচোলের তেভাগা আন্দোলন ও তার কিংবদন্তিতুল্য সংগঠক ও নেত্রী ইলা মিত্রকে নিয়ে লেখা ইতিহাস-নির্ভর জীবনী-উপন্যাস। এ উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দু নাচোলের কৃষক বিদ্রোহের নেত্রী ইলা মিত্র। এ উপন্যাসের মতে জমিদার বাড়ির বউ ইলা মিত্রের তেভাগা আন্দোলনের নাচোল শাখার মুখ্য কর্তা রমেন মিত্রের সঙ্গে নাচোলের কৃষক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে সকলের ভালােবাসার রানিমা হয়ে ওঠার কাহিনি বিবৃত হয়েছে। ইলা মিত্রের জীবন অবলম্বনে উপন্যাস রচনা করতে গিয়ে লেখক কল্পনার আশ্রয় নিলেও ইলা মিত্রের জীবনের বাস্তব তথ্য এবং তেভাগা আন্দোলনে তার ভূমিকাকে যতটা সম্ভব যথাযথভাবে অনুসরণ করেছেন।
কলকাতার মেয়ে ইলা সেন ইলা মিত্র হয়ে নববধূ রূপে আসছেন শশুরবাড়ি। তার স্বামী রমেন সেন কেবল জমিদার তনয় নয়, নাচোল অঞ্চলে গড়ে ওঠা কৃষক আন্দোলনের প্রথম সারির রাজনৈতিক সংগঠক ও কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। প্রথম দর্শনেই ইলা মিত্রকে মনে হয়েছে প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বসম্পন্ন:
“শ্যামলা, ছিপছিপে লম্বা, জ্যামুক্ত ধনুকের মতাে বাঁকিয়ে ছেড়ে দিলে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে আঘাত হানতে পারে। নানা তথ্য সন্নিবেশ করে ঔপন্যাসিক ইলা মিত্রের পরিচয় তুলে ধরেছেন পাঠকের কাছে। শীর্ণকায়া এই বাঙালি মেয়ে ১৯৩৬ থেকে ১৯৪৩ পর্যন্ত ছিলেন প্রথম সারির ক্রীড়াবিদ। ভারতের অ্যাংলাে ইন্ডিয়ানদের রেকর্ড ভেঙে বিখ্যাত হয়েছেন। ১৯৪৩ সালে বি এ ক্লাসের ছাত্রী থাকাকালে কলকাতায় মহিলা আত্মরক্ষা কমিটির সদস্য হয়েছেন। একই বছর হয়েছেন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। উপন্যাসে এই চরিত্রকে লেখক যেভাবে উপস্থাপন করেছেন তাতে সহজেই ধরা পড়ে, নিছক গৃহবধূ হিসেবে জমিদার বাড়িতে ইলা মিত্রের আগমন হয়নি, তিনি এসেছেন স্বামীর উপযুক্ত সঙ্গী ও সহযােদ্ধা হিসেবে মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলন ও শােষণমুক্তির সংগ্রামে অংশ নিতে। কলকাতার শহুরে মুক্তজীবনে বেড়ে ওঠা মেয়ের পক্ষে গ্রামের রক্ষণশীল পরিবেশে মানিয়ে চলা ছিল কঠিন কাজ। কিন্তু মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকায় ইলা মিত্র সহজেই তাতে সফল হন।
জমিদার বাড়ির প্রথাবদ্ধ সামন্ততান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা মেনে নিয়ে ক্রমেই রক্ষণশীলতাকে পেরিয়ে যান তিনি। নেমে পড়েন নারী শিক্ষা বিস্তারের কাজে। বাড়ি বাড়ি ছােটেন মেয়েদের শিক্ষার প্রয়ােজনীয়তা বুঝাতে। সমাজের রক্ষণশীল অংশ থেকে নারী শিক্ষার পথে বাধা তৈরি হলে তিনি দৃঢ় পদক্ষেপ নেন তার মােকাবিলায়। স্কুলের চত্বরে আয়ােজন করেন মুক্তাঙ্গন বিতর্ক প্রতিযােগিতার। কেবল মেয়েদের স্কুল পরিচালনা নয় একই সঙ্গে ইলা মিত্র যুক্ত হন কৃষক সভা ও কমিউনিস্ট পার্টির কাজে। ছুটির দিনে গ্রামে গ্রামে যেতে শুরু করেন কৃষকদের সংগঠিত করতে। বৈঠক সভা সমাবেশে বক্তৃতা দিতে শুরু করেন। ক্যাম্পে তরুণদের প্রশিক্ষণ দেন। পুলিশি তৎপরতার মুখে আত্মগােপনে থেকে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে থাকেন। জোতদারেরা যারা তেভাগা মানেনি ইলা মিত্রের নির্দেশে তাদের খােলান থেকে ধান তুলে নিয়ে আসা হলাে। জোতদার, রাজনৈতিক নেতা এবং পুলিশ মিলে এ আন্দোলনের চিড় ধরাতে চাইলেও আজ কৃষকরা রানিমাকে ছেড়ে ভুল করতে রাজি নয়। এরই মধ্যে তার ছেলের জন্ম হয়। কিন্তু তেভাগা আন্দোলন জোরদার হতে থাকলে আন্দোলনের প্রয়ােজনে সন্তানকে ছেড়ে সাঁওতালদের মধ্যে কাজ করতে থাকেন। তিনি হয়ে ওঠেন সবার রানিমা।
পুলিশের দমন নীতি চরম পর্যায়ে পৌছালে ইলা মিত্র প্রীতিলতার মতাে আত্মত্যাগের মন্ত্রে উজ্জীবিত হন। তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরােয়ানা জারি হয়। অভিযান চলে তাকে জীবিত কিংবা মৃত ধরার জন্য। তিন পুলিশের খুনের পর সাধারণ চাষিদের উপর পাকিস্তানি পুলিশ শুরু করে নারকীয় অত্যাচার। যুবতী মেয়েদের ধর্ষণ করা থেকে শুরু করে বাড়ি ঘরের মধ্যে আগুন সংযোেগ, নাবালক শিশু থেকে দুধের গাই এমনকি বৃদ্ধ, বৃদ্ধারা জীবন্ত অবস্থায় পুড়ে মারা যায়। কিন্তু পুলিশ ইলা মিত্রকে কোথাও খুঁজে পায় না। কৃষক আন্দোলনের নেতাকর্মীরা সকলে মিলে শিগরির রানিমাকে সীমান্ত পেরিয়ে পালানাের ব্যবস্থা করে। কিন্তু এত চেষ্টার পরও শুধু চন্দ্রালােকিত রাতে পথ ভুল করার ফলে ঘটনাচক্রে রােহনপুর স্টেশনে পাকিস্তানি পুলিশের হাতে তিনি ধরা পড়েন। ছদ্মবেশী ইলার পরিচয় পুলিশের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল যে এ নারী সাঁওতাল মেয়ে নয়। রােহনপুর জেল হাজতে পুলিশ চুলের মুঠি ধরে ইলাকে নিয়ে যায়। দু-কান বধির হয়ে যায় ইলার এদের অশ্লীল রসিকতায়। তবু চোয়াল শক্ত করে পথ চলা অব্যাহত রাখতেই হবে। এরপর ইলার উপর বুটের লাথি, ঘুষি, বেত্রাঘাত আর চাবুকের ঝড় বয়ে গেল। কিন্তু এরপর তার ওপর চালানাে হয় বর্বর ও নৃশংস অত্যাচার। কিন্তু মধ্যযুগীয় সে বর্বরতা হার মানে ইলা মিত্রের মানসিক দৃঢ়তার কাছে।
ইলা মিত্রের বিচার ও তার জবানবন্দি সেই সময়কার তরুণ সমাজকে উদ্বুদ্ধ করেছিল- প্রতিবাদী হয়ে ওঠার প্রেরণা দিয়েছিল মুসলিম লীগ সরকারের ঘৃণ্য শাসনের বিরুদ্ধে। তাই প্রতিবাদী নারীচরিত্র, কৃষক আন্দোলনের অন্যতম পথপ্রদর্শক হিসেবে ইলা মিত্র বাংলার সংগ্রামী ইতিহাসে অনন্য। ইলা মিত্রের স্বামীপ্রেম, সন্তান-বাৎসল্য, অতিথিপরায়ণতা ইত্যাদিও স্বল্পরেখায় ফুটিয়ে তুলেছেন ঔপন্যাসিক।
0 মন্তব্যসমূহ