অথবা, ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির দোষসমূহ আলােচনা কর।
অথবা, ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির নেতিবাচক দিকসমূহ আলােচনা কর।
ভূমিকাঃ Power বা ক্ষমতা হচ্ছে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। সমাজবদ্ধ মানুষ রাজনৈতিকভাবে সচেতন হওয়ার পর থেকে ক্ষমতা রাজনীতির এক ব্যাপক বিষয় হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। এ ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষিত না হলে নাগরিকের মৌলিক অধিকার ক্ষুন্ন হয়। এজন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ব্যক্তিস্বাধীনতা মতবাদের বিকাশের সাথে সাথে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ বা পৃথকীকরণ নীতির গুরুত্ব ও তাৎপর্য বৃদ্ধি পায়। যদিও রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হলাে ক্ষমতা, তথাপি কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা একদিকে যেমন সরকারকে স্বৈরাচারী করে তুলে অন্যদিকে তেমনি নাগরিক স্বাধীনতাও ক্ষুন্ন করে। তাই সরকারের স্বেচ্ছাচারিতা রােধ ও নাগরিক স্বাধীনতা রক্ষার্থে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি উদ্ভাবন করেছেন।
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির অসুবিধাসমূহঃ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির ক্রটি অনেক। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা নানা দিক থেকে এ নীতির সমালােচনা করে থাকেন। নিম্নে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির অসুবিধাসমূহ আলােচনা করা হলাে-
১. রাষ্ট্র নিষ্প্রাণ হয়ে পড়েঃ আধুনিক রাষ্ট্রে ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ নীতি প্রয়ােগ করা সম্ভব নয়। কারণ ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ নীতি প্রয়ােগের ফলে রাষ্ট্র নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ে। বুন্টসলি তাই বলেছেন, “দেহ থেকে মস্তককে পৃথক করলে যেমন মানুষের প্রাণহানি ঘটে, তেমনি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করলে রাষ্ট্র নিপ্রাণ হয়ে পড়ে। কারণ রাষ্ট্র হচ্ছে মানুষের মতাে একটা জৈবিক প্রক্রিয়া।
২. অযৌক্তিকঃ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা করলে দেখা যায় যে, এ নীতি সরকারের তিনটি বিভাগের ক্ষমতাকে সমান বলে মনে করে। কোন দেশেই এরূপ সমক্ষমতাসম্পন্ন তিনটি বিভাগ দেখা যায় না। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় আইনসভা জনগণের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত হয় বলে এ বিভাগ অন্যান্য দুটি বিভাগ থেকে বেশি ক্ষমতার অধিকারী হয়ে থাকে।
৩. দায়িত্বহীনতার জন্ম হয়ঃ এ ব্যবস্থার ফলে দায়িত্বহীনতার সৃষ্টি হতে পারে। কেননা ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের ফলে আইন বিভাগের নিকট শাসন বিভাগ তার কাজের জন্য দায়ী থাকে না, এতে এ সরকার ব্যবস্থায় দায়িত্বহীনতার জন্ম হয়। অধ্যাপক শাস্কি বলেছেন, “শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগ যদি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে কাজ করে, তবে প্রত্যেক বিভাগের দায়িত্বশীলতা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হবে এবং পরস্পরের মধ্যে সংঘাত ও বিপ্লব সৃষ্টি হবে।”
৪. শাসনব্যবস্থায় অচলাবস্থাঃ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের ফলে সরকারের প্রত্যেক বিভাগ সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে পারে না। কারাে কাজের সাথে কোন সামঞ্জস্য থাকবে না এবং কর্মচারীদের দায়িত্বশীলতা বিলুপ্ত হবে। এতে শাসনব্যবস্থায় অচল অবস্থার সৃষ্টি হয়। জে, এস, মিল বলেছেন, “সরকারের প্রত্যেক বিভাগ যদি নিজ নিজ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র হয়, তাহলে এক বিভাগ অন্য বিভাগের কাজে হস্তক্ষেপ করবে। এতে শাসনব্যবস্থায় অচল অবস্থার সৃষ্টি হবে।”
৫. আইন বিভাগের প্রাধান্যঃ ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ নীতি অনুসারে সরকারের আইন, শাসন ও বিচার বিভাগের সমান ক্ষমতা থাকবে। কিন্তু আধুনিক যুগ গণতন্ত্রের যুগ। বর্তমান কালে যেসব রাষ্ট্রে ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়ােগ দেখা যায়, সেখানেও আইন বিভাগের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়।
৬. বিপ্লবের আশঙ্কাঃ সরকারের তিনটি বিভাগ স্বতন্ত্রভাবে যদি কাজ করতে থাকে তাহলে প্রত্যেক বিভাগের দায়িত্বশীলতা হ্রাস পাবে। এ বিভাগগুলাের মধ্যে সহযােগিতা বিনষ্ট হবে। অধ্যাপক লাস্কি অভিমত পােষণ করে বলেছেন, “শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগ যদি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে কাজ করে, তাহলে প্রত্যেক বিভাগেরই দায়িত্বশীলতা সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হবে। আর অনুরূপ স্বতন্ত্রতা পরস্পরের মধ্যে অবশ্যই সংঘাত বয়ে আনবে এবং সংঘাত থেকে বিপ্লব সৃষ্টির সম্ভাবনা থেকে যায়।”
৭. জনকল্যাণ ব্যাহতঃ বিভিন্ন সমালােচকদের দৃষ্টিতে কল্যাণরাষ্ট্রের কল্যাণকর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়, তা কখনাে ক্ষমতার পূর্ণ স্বতন্ত্রীকরণ হলে সম্ভব হবে না। জনকল্যাণের জন্য যেসব পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় তা বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সামঞ্জস্য প্রয়ােজন। আর ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির জটিলতা জনকল্যাণকে ব্যাহত করে।
৮. ব্যক্তিস্বাধীনতার রক্ষাকবচঃ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষা করে। এ নীতিকে ব্যক্তিস্বাধীনতার রক্ষাকবচ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতি ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষা করে, ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ নয়।
৯. রাজনৈতিক অচলাবস্থা ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিঃ ক্ষমতার পূর্ণ স্বতন্ত্রীকরণ নীতি প্রয়ােগ করা হলে সরকারের এক বিভাগের সাথে অপর বিভাগের কোন সামঞ্জস্য থাকবে না। ফলে রাজনৈতিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়। এক বিভাগ অন্য বিভাগকে দায়ী করতে থাকবে। এর ফলে দেশে রাজনৈতিক অচলাবস্থা ও অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হবে, যা দেশ ও জাতির কল্যাণের জন্য বাধাস্বরূপ।
১০. অস্বাভাবিকঃ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি অনুসারে প্রত্যেক বিভাগকে একই পর্যায়ে দেখতে হয়। কিন্তু সকল পদ্ধতিতে তিনটি বিভাগ সমান মর্যাদার অধিকারী হয় না। রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনে শাসন বিভাগ এবং মন্ত্রিপরিষদে আইন বিভাগের প্রাধান্য সর্বতােভাবে স্বীকৃত। কিন্তু বিচার বিভাগের প্রাধান্য স্বীকৃত না হলেও শাসন প্রক্রিয়া ন্যায়ানুগ প্রক্রিয়ায় পরিচালিত হতে পারে না। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। উইলােবি বলেছেন, “ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়ােগ করতে গেলে সমস্যায় পড়তে হবে।”
উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির সুবিধা ও অসুবিধা উভয়ই বিদ্যমান। তবে এ নীতির যৌক্তিকতা হলাে জনগণের স্বাতন্ত্র ও অধিকার সংরক্ষণ। যখন আইন ও শাসন বিভাগের ক্ষমতা একটি লােকের বা একদল শাসকের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়, তখন জনগণের স্বাধীনতা লুপ্ত হয়। আবার বিচার বিভাগীয় ক্ষমতা আইন পরিষদ বা শাসন বিভাগ থেকে স্বতন্ত্র না হলে স্বাধীনতা বজায় থাকে না। পূর্ণ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের নীতি আজকাল খুব সমর্থন না পেলেও এ নীতি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে খানিকটা গুরুত্ব দিয়ে আলােচনা করা হয়।
0 মন্তব্যসমূহ