অথবা, এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার কুফল আলােচনা কর।
অথবা, এককেন্দ্রিক সরকারের নেতিবাচক দিকসমূহ আলােচনা কর।
অথবা, এককেন্দ্রিক সরকারের অসুবিধাসমূহ আলােচনা কর।
ভূমিকাঃ কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন ও উভয়ের পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে সরকারকে এককেন্দ্রিক ও যুক্তরাষ্ট্রীয় এ দু'ভাগে ভাগ করা হয়। এককেন্দ্রিক সরকারে সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে অর্পিত থাকে। এ শাসনব্যবস্থায় প্রাদেশিক ও আঞ্চলিক সরকার বিদ্যমান থাকে, যা কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে থেকে বিভিন্ন কার্য সম্পন্ন করে। তবে কেন্দ্রীয় সরকার সাধারণ আইনের দ্বারা আঞ্চলিক সরকারসমূহের সীমানা, পরিধি এবং কর্তৃত্বের পরিবর্তন সাধন করতে পারে। অর্থাৎ এ শাসন ব্যবস্থার সর্বত্রই কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাধান্য বর্তমান থাকে।
এককেন্দ্রিক সরকারের দোষাবলিঃ এককেন্দ্রিক সরকারের যেমন কতকগুলাে গুণ রয়েছে, তেমনি কতকগুলাে ক্রটিও লক্ষ্য করা যায়। নিম্নে তা আলােচনা করা হলাে-
১. ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণঃ এককেন্দ্রিক সরকারের একটি অন্যতম দোষ হলাে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ। এ সরকার ব্যবস্থায় সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে। শাসন পরিচালনায় আঞ্চলিক সরকারের ভূমিকাকে কম না হলেও প্রকৃতপক্ষে এসব সরকার কোন প্রকার ক্ষমতা থাকে না। এতে প্রাদেশিক সরকারসমূহের কোন প্রকার কর্তৃত্বকে মান্য করা হয় না।
২. বৃহৎ রাষ্ট্রের জন্য অপ্রযােজ্যঃ বর্তমানে রাষ্ট্রের আয়তন ও জনসংখ্যা যেমন বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি এর কার্যাবলিও ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। কিন্তু একমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে এ বিপুল পরিমাণ কার্যভার বাস্তবে বহন করা অসম্ভব। তাই এটা বৃহৎ রাষ্ট্রের জন্য অনুপযােগী বলে অনেকে সমালােচনা করেছেন।
৩. সুশাসনের অনুপযােগীঃ এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা সুশাসনের জন্য অনুপযােগী। এ সরকার ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকার সমগ্র দেশের স্বার্থে পরিচালিত হয়। এর ফলে জাতীয় সমস্যার সমাধান হলেও স্থানীয় সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান। সাধিত হয় না।
৪. স্বায়ত্তশাসনের অবমাননাঃ এককেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থায় আঞ্চলিক সরকারগুলাে স্বায়ত্তশাসিত নয়, তারা সকল বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের উপর নির্ভরশীল হয়। সুতরাং আঞ্চলিক সরকারগুলাের প্রতিভা ও আশাভরসার বাস্তবায়ন হয় না।
৫. বিপ্লবের আশঙ্কাঃ এককেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থায় বিপ্লব সংগঠিত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। এ ধরনের সরকার ব্যবস্থায় সকল ক্ষমতা একজনের হাতে অর্পিত থাকে। জনগণ ইচ্ছা করলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিপ্লবের মাধ্যমে সরকারের পতন নিশ্চিত করতে পারে।
৬. স্বৈরাচারী শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়ঃ এ সরকার ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকারের স্বৈরাচারী হওয়ার প্রবণতা অনেক বৃদ্ধি পায়। কেননা কেবলমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারই রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা ভােগ করে থাকে। তাছাড়া কেন্দ্রীয় সরকার তার কাজের জন্য কারাে নিকট জবাবদিহি করে না বলে স্বৈরাচারী সরকারে পরিণত হয়।
৭. আমলাদের ক্ষমতা বৃদ্ধিঃ এককেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থায় কাজের অত্যধিক চাপের কারণে সরকার কিছু ক্ষমতা স্থায়ী কর্মচারীদের উপর ছেড়ে দেয় এবং তাদের উপর নির্ভরশীল হয়। ফলে সরকারি কর্মচারীদের ক্ষমতা ও প্রভাব প্রতিপত্তি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায় এবং আমলাতান্ত্রিক শাসন কায়েম হয়।
৮. রাজনৈতিক চেতনা বিকাশে বাধাঃ এ ধরনের সরকার ব্যবস্থায় জনগণের অংশগ্রহণের তেমন কোন সুযােগ থাকে না। ফলে জনগণের রাজনৈতিক চেতনাও বিকশিত হয় না। এমনকি এতে জনগণও উৎসাহ অনুভব করে না।
৯. আঞ্চলিক সমস্যার সমাধান হয় নাঃ কেন্দ্রীয় সরকার যতই শক্তিশালী ও দক্ষ হােক না কেন, এর দ্বারা দেশের সকল অঞ্চলের সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান হওয়া অসম্ভব। এর সুষ্ঠু সমাধানের জন্য আঞ্চলিক সরকারের সহযােগিতা অধিক ফলপ্রসূ। কিন্তু আঞ্চলিক সরকারের কোন ক্ষমতা না থাকায় স্থানীয় সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান ব্যাহত হয়।
১০. জাতীয় সংহতির সহায়ক নয়ঃ এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থায় বিভিন্ন ধরনের ভাষাভাষী ও ধর্মাবলম্বী লােক বসবাস করে। অনেক সময় তাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা কঠিন হয়ে পড়ে। ফলশ্রুতিতে সাম্প্রদায়িকতার সৃষ্টি হয়।
১১. ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের শক্তি হ্রাসঃ এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রগুলাে ক্ষুদ্র হলে সেগুলাে ক্ষমতাশালী হতে পারে না, বরং ছােট, দেশগুলাে বৃহৎ ও শক্তিশালী রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীনে থাকে। এসব ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের মর্যাদা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিনষ্ট হয়।
১২. নেতৃত্বের বিকাশের পরিপন্থীঃ এককেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থায় রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্ম কেন্দ্রের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। সেজন্য নেতৃত্ব বিকাশের সুবিধা সম্প্রসারিত হয় না এবং শাসনব্যবস্থায় সুনেতৃত্বের বিকাশ ঘটে না। জনসাধারণ অধিক পরিমাণে শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করতে পারে না। তাই তাদের মধ্যে নেতৃত্বের উন্মেষ ঘটে না।
উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, অন্যান্য সরকার ব্যবস্থার ন্যায় এককেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থায় যেমন কতকগুলাে গুণ আছে, তেমনি অনেক ক্রটিও আছে। এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা ভৌগােলিক ও জাতিগত ঐক্য সংবলিত ক্ষুদ্রাকার রাষ্ট্রের জন্য বিশেষভাবে উপযােগী। তবে যেসব দেশের জনগণ রাজনৈতিকভাবে সচেতন নয়, সেসব দেশে এ সরকার ব্যবস্থা ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বর্তমানে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এককেন্দ্রিক সরকারের জনপ্রিয়তা হ্রাস পাচ্ছে।
0 মন্তব্যসমূহ