প্রশ্নঃ জগতের উৎপত্তি বিষয়ক মতবাদ হিসেবে সৃষ্টিবাদ ও বিবর্তনবাদের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় কর। তুমি কোন মতবাদ সমর্থন কর এবং কেন?
অথবা, বিশ্বের উৎপত্তি বিষয়ক মতবাদ হিসেবে সৃষ্টিবাদ ও বিবর্তনবাদের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় কর।
ভূমিকাঃ জগৎ ও জীবনের রহস্য উন্মােচন করা এবং এদের যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যাদানের প্রচেষ্টা মানব ইতিহাসের সর্বযুগে লক্ষণীয়। খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে পাশ্চাত্য দর্শনের যে যাত্রা শুরু হয় তা এই সমস্যাকে কেন্দ্র করেই। এবং আজ পর্যন্ত সকল দার্শনিকই বিভিন্নভাবে জগতের উৎপত্তির ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বিভিন্ন মতামতের মধ্যে আমরা প্রধানত দু'টি মতবাদ পাই। এ দু'টি মতবাদ হলাে- সৃষ্টিবাদ ও বিবর্তনবাদ। নিচে আমরা এ দু’টি মতবাদ আলােচনা করব।
সৃষ্টিবাদঃ সৃষ্টিবাদ অনুসারে এমন এক সময় ছিলাে যখন জগতের কোনাে অস্তিত্ব ছিল না। কিন্তু স্রষ্টা কোনাে এক বিশেষ মুহূর্তে নিজ ইচ্ছাবলে এ জগৎ এবং এ জগতের মধ্যকার সব কিছু সৃষ্টি করেন। সাধারণত ধর্মতত্ত্ববিদ ও কিছুসংখ্যক দার্শনিক জগতের সৃষ্টি সম্পর্কে এ অভিমত ব্যক্ত করে থাকেন। যুক্তিতর্ক ছাড়াও তারা ধর্মগ্রন্থের সাহায্যে নিজেদের মতবাদ সমর্থন করেন। সৃষ্টিবাদ দু'ধরনের। এক সাপেক্ষ সৃষ্টিবাদ এবং দুই. নিরপেক্ষ সৃষ্টিবাদ।
বিবর্তনবাদঃ জগতের উৎপত্তি সম্পর্কিত মতবাদ হিসেবে বিবর্তনবাদ হলাে এমন এক মতবাদ যার মাধ্যমে জগৎ ও অন্যান্য যাবতীয় প্রাণী ও বস্তু অভ্যন্তরীণ শক্তির সাহায্যে সহজ সরল অবস্থা থেকে ক্রমপরিবর্তনের ধারায় বর্তমান জটিল অবস্থায় উপনীত হয়েছে। বিবর্তনবাদীরা মনে করেন, জগতের বর্তমান অবস্থা বহু পরিবর্তনের ফলে সম্ভব হয়েছে। তবে এ পরিবর্তন হলাে সহজ থেকে জটিল, সদৃশ বা সমজাতীয় অবস্থা থেকে বিসদৃশ ও ভিন্ন জাতীয় সুসংবদ্ধ অবস্থায় পরিবর্তন।
জ্যোতির্বিদ্যা, ভূতত্ত্ববিদ্যা, জীববিদ্যা ও সমাজবিদ্যা বিবর্তনবাদের সপক্ষে যথেষ্ট তথ্য সরবরাহ করে। জ্যোতির্বিদ্যা সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, সৌরজগৎহঠাৎকরে একদিনে গড়ে উঠেনি। বহু বছরের ক্রমপরিবর্তনের ফলেই বিভিন্ন গ্রহ উপগ্রহ বর্তমান রূপ লাভ করেছে। ভূবিদ্যা যে তথ্য সরবরাহ করেছে তাতে জানা যায় যে, এ পৃথিবী একদিন তরল অবস্থায় ছিল। বহুযুগের পরিবর্তনের ফলেই পৃথিবী আজকের রূপ লাভ করেছে। জীববিদ্যাও এ সাক্ষ্য দেয় যে, সব জাতিই বিভিন্ন প্রজাতি থেকে সৃষ্টি হয়েছে। যে বিবর্তন প্রক্রিয়ায় জগতের যাবতীয় বস্তু সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করা হয়, কনজারের মতে তার কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। এ বৈশিষ্ট্য হলােঃ (১) কালিক পরিবর্তন, (২) ক্রমিক শৃঙ্খলা, (৩) অভ্যন্তরীণ কারণ, (৪) সৃজনমূলক কারণ। হারবার্ট স্পেন্সার তিনটি পর্যায়ের কথা বলেছেন, এগুলাে হলাে- ঐক্য বিধান, পৃথকীকরণ ও নিয়ন্ত্রণ। বিবর্তনবাদ বিভিন্ন প্রকারের। যথা- (১) যান্ত্রিক বিবর্তনবাদ, (২) উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনবাদ, (৩) সৃজনমূলক বিবর্তনবাদ এবং উন্মেষমূলক বিবর্তনবাদ।
সৃষ্টিবাদ ও বিবর্তনবাদের পার্থক্যঃ সৃষ্টিবাদ ও বিবর্তনবাদ দু’টি পরস্পর বিরুদ্ধ মতবাদ। সুতরাং এ দু মতবাদের পার্থক্য থাকাই স্বাভাবিক। এদের মধ্যে আপাত দৃষ্টিতে যে পার্থক্য দেখা যায় তা হচ্ছে-
(১) সৃষ্টিতত্ত্ব বা সৃষ্টিবাদ অনুসারে কোনাে একটি শক্তি বা ঈশ্বর বিশেষ মুহূর্তে এ জগৎ সৃষ্টি করেছেন। অভিব্যক্তিবাদ বা বিবর্তনবাদ অনুসারে, এ জগৎ কেউ সৃষ্টি করেননি, এ জগৎ ক্রমবিকাশের ফল।
(২) সৃষ্টিবাদ অনুসারে জগতের বর্তমানের সব বস্তু সেই আদিতে সৃষ্ট জগতের বস্তুর অনুরূপ, কিছুই বদলায়নি। পক্ষান্তরে, বিবর্তনবাদ অনুসারে জগতের প্রতিটি বস্তুই ক্রমবিকাশের ফল। ধীর পরিবর্তনের মাঝে বহুপর্যায় পেরিয়ে জগতের প্রত্যেকটি বস্তু বর্তমান রূপ পেয়েছে।
(৩) সৃষ্টিবাদ অনুসারে ঈশ্বর জগৎকে কোনাে এক বিশেষ মুহূর্তে সৃষ্টি করেছেন। বিবর্তনবাদ জগতের উৎপত্তিতে কোনাে বিশেষ মুহূর্তকে স্বীকার করে না। কেননা কোনাে বিশেষ মুহূর্তেই এ জগৎ সৃষ্টি হয়েছে- এ কথার কোনাে যুক্তিযুক্ত কারণ নেই।
(৪) জগৎ সাপেক্ষ বা নিরপেক্ষ কোনােভাবেই সৃষ্টি হতে পারে না। সাপেক্ষ সৃষ্টিবাদ আল্লাহর সমান্তরাল শক্তিকে স্বীকার করে, আর নিরপেক্ষ সৃষ্টিবাদ আল্লাহর পূর্ণতাকে সম্পূর্ণরূপে স্বীকার করেন না। কাজেই উভয় মতবাদের মধ্যে বিরােধ আছে। অন্যদিকে, বিবর্তনবাদ সুষ্ঠু, বিরােধহীন এবং যুক্তিগ্রহ।
(৫) ধর্মীয় গ্রন্থসমূহ সৃষ্টিবাদকে সমর্থন করে। পক্ষান্তরে বিজ্ঞান ও দর্শনে বিবর্তনবাদের অধিক সমর্থন রয়েছে।
(৬) সৃষ্টিবাদ অনুসারে জগতের সাথে স্রষ্টার সম্পর্ক হলাে বাহ্যিক। পক্ষান্তরে বিবর্তনবাদ অনুসারে বিবর্তন হলাে জগতের ধর্ম। বিবর্তনের সাথে জগৎক্রিয়ার সম্পর্ক সম্পূর্ণরূপে আন্তঃসম্পর্ক।
(৭) অভিব্যক্তিবাদ বৈজ্ঞানিক মতবাদ। বিভিন্ন বিজ্ঞান থেকে অভিব্যক্তিবাদ নিজ মতের সপক্ষে যুক্তি এবং প্রমাণের অবতারণা করেছে। পক্ষান্তরে, সৃষ্টিবাদের পেছনে কোনাে যুক্তি বা প্রমাণ নেই।
(৮) সৃষ্টিবাদ একটা রক্ষণশীল মতবাদ। পক্ষান্তরে বিবর্তনবাদ প্রগতিশীল মতবাদ।
(৯) সৃষ্টিবাদের সাপেক্ষ ও নিরপেক্ষ এই দু’টি রূপ আছে। পক্ষান্তরে, বিবর্তনবাদের চারটি রূপ আছে। যথা- (ক) যান্ত্রিক, (খ) উদ্দেশ্য, (গ) সৃজনমূলক এবং (ঘ) উন্মেষমূলক।
(১০) সৃষ্টিবাদের পরিধি সংকীর্ণ। কিন্তু বিবর্তনবাদের পরিধি ব্যাপক।
কোন মত গ্রহণ করব এবং কেনঃ সৃষ্টিবাদ ও বিবর্তনবাদ আলােচনার পর আমরা এটা দেখতে পাই যে, জগতের উৎপত্তি বিষয়ক মতবাদ হিসেবে সৃষ্টিবাদ সমর্থনযােগ্য মতবাদ নয়। কেননা এ মতানুযায়ী জগৎ ঈশ্বর কর্তৃক সৃষ্ট। ঈশ্বর কোনাে এক সময় নিজ ইচ্ছাবলে এ জগৎ এবং এর মধ্যকার যাবতীয় সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু আমরা এ কথা মানতে পারি না। এ মতে ঈশ্বর কিভাবে কেন এ জগৎ সৃষ্টি করেছেন তার ব্যাখ্যা সুস্পষ্ট নয়। বাস্তব জীবনে আমরা দেখতে পাই যে, জগতের সবকিছুই বিবর্তনের মাধ্যমে পরিবর্তিত হচ্ছে। তা ছাড়া দর্শনে কোনাে কিছুকে বিনা বিচারে, প্রমাণ না করে, অযৌক্তিকভাবে মেনে নেওয়া যায় না। এদিক থেকে আমরা জগতের উৎপত্তিবিষয়ক মতবাদ হিসেবে বিবর্তনবাদকে অধিক গ্রহণীয় বলে মনে করতে পারি। কেননা, বিবর্তনবাদে যৌক্তিকভাবে সব কিছু ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, বিবর্তনবাদই বুদ্ধিনির্ভর মতবাদ। তবে অনেকের মতে, সৃষ্টিবাদ ও বিবর্তনবাদের মধ্যে বৈসাদৃশ্য যেমন রয়েছে, তেমনি সাদৃশ্যও আছে। তাদের মতে, বিবর্তনের ক্রমধারায় সৃষ্টির নব নব স্তরে এক মহাসত্যের প্রেরণা না থাকলে বিবর্তন অর্থবহ হতে পারে না। বিবর্তন শুধু পরিবর্তন নয়, এটা একটি লক্ষ্যের অভিমুখী ক্রমবিকাশের ধারা। বিবর্তনকে এ অর্থে গ্রহণ করলে সৃষ্টিবাদের সাথে এর ব্যবধান অবশ্যই কমে আসবে।
0 মন্তব্যসমূহ