জড় সম্পর্কে আধুনিক ও অত্যাধুনিক বৈজ্ঞানিক মতবাদ আলােচনা কর


প্রশ্নঃ জড় সম্পর্কে আধুনিক ও অত্যাধুনিক বৈজ্ঞানিক মতবাদ আলােচনা কর।
অথবা, জড় সম্পর্কে আধুনিক ও অত্যাধুনিক মতবাদ দু’টির একটি বিশ্লেষণমূলক ব্যাখ্যা দাও।

ভূমিকাঃ বাহ্যিক জগতে আমরা প্রতিনিয়তই দেখতে পাই যে, বিভিন্ন বস্তু সৃষ্টি হচ্ছে, আবার ধ্বংস হচ্ছে। তাদের আকৃতি ও গঠনে অনবরতই পরিবর্তন ঘটছে। কিন্তু শত পরিবর্তন সত্ত্বেও আমরা মনে করি না যে, এসব বস্তুর মূল উপাদান বিনষ্ট হয়েছে। যে কাঠকে পুড়িয়ে ছাই করা হলাে বা যে পাথরকে গুড়িয়ে ধুলাে করে ফেলা হলাে, তার মূল উপাদান বিনষ্ট হয়নি বলেই আমরা ধারণা করি। বস্তুর এ মূল উপাদানকে বলা হয় জড়। জড় অচেতন। জড়ের বিস্মৃতি ও অভেদ্য এবং আরও অনেক গুণ আছে যেগুলাে বিস্মৃতি ও অভেদ্য থেকে সৃষ্টি হয়।

জড়ের প্রকৃতিঃ জড় হচ্ছে জাগতিক বস্তুর একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য। জড় হলাে স্থায়ী এবং এক হিসেবে সর্বব্যাপক। জাগতিক বস্তুর পরির্তন সাধিত হতে পারে, কিন্তু জড়ের কোনাে পরিবর্তন সাধিত হয় না, কেননা জড় হচ্ছে জাগতিক বস্তুর মূল উপাদান। সুতরাং বলা যায়, জাগতিক বস্তুর সব পরিবর্তনের সাথেও যা অপরিবর্তিত থাকে তাকে বলা হয় জড়। জড় বা বস্তুকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠে জড়বাদ। এই জড়বাদীদের মতে, জড় থেকেই বিশ্বের সকল বস্তু, প্রাণ, মন প্রভৃতির উৎপত্তি। আবার জড়ের মধ্যেই সবকিছুর বিনাশ।

জড়বাদের প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্যঃ জড়বাদীরা তাদের বক্তব্যের স্বপক্ষে একাধিক যুক্তি উপস্থাপন করেন। যেমন-

(১) জড়বাদীরা প্রত্যক্ষণকেই একমাত্র প্রমাণ বলে মেনে নেন। যা প্রত্যক্ষের বিষয় নয় তার অস্তিত্ব স্বীকার করা চলে না। জড়কেই প্রত্যক্ষ করা যায়। .

(২) জড়বাদ জগতের বিভিন্ন ঘটনাবলির পারস্পরিক সম্পর্ককে কার্যকারণ সম্পর্কের দ্বারাই ব্যাখ্যা করে। জড় ও গতির ক্রিয়া যান্ত্রিকভাবেই সম্পন্ন হয়। জড় ও গতির মধ্যে কোনাে উদ্দেশ্য বা আদর্শ নেই।

(৩) জড়বাদীরা শক্তির নিত্যতা নিয়মে বিশ্বাসী। জগতের বস্তুগুলাের কোনাে গুণগত পার্থক্য নেই। তাদের কেবল রূপগত ও পরিমাণগত পার্থক্য আছে।

(৪) জীবন বা প্রাণের উদ্ভব জড় থেকেই। জড়ের সঙ্গে জীবনের কোনাে গুণগত পার্থক্য নেই। জড়ের তুলনায় প্রাণ জটিল।

(৫) মন বা চৈতন্য জড় থেকেই উদ্ভূত। মস্তিষ্কের কোনাে স্বাধীন চেতনা প্রক্রিয়ার অস্তিত্ব নেই। জড় প্রকৃতই বস্তু।

জড়ের প্রকৃতি সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদঃ পাশ্চাত্য দর্শনের আলােচনা করলে দেখা যায় যে, বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন চিন্তাবিদ জড়ের প্রকৃতি সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদের কথা বলেছেন। জড়ের প্রকৃতি সম্পর্কে চিন্তা বা বুদ্ধিপ্রসূত যে মতবাদগুলাে প্রচলিত সেগুলােকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা হয়। যথা- (১) প্রাচীন মতবাদ, (২) আধুনিক মতবাদ।

আধুনিক বৈজ্ঞানিক মতবাদঃ আধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা জডের সমস্যার ওপর নতুনভাবে আলােকপাত করেছে এবং মানুষের চিন্তার রাজ্যে এক বিপ্লবের সূচনা করেছে। জড় সম্পর্কে দু'প্রকার বৈজ্ঞানিক মতবাদ দেখা যায়। যথা- (ক) পরমাণুবাদ বা নিষ্ফল জড়বাদ; ও (খ) সচল জড়বাদ। নিম্নে এ বিষয় দু’টির আলােচনা করা হলাে-

(১) সচল জড়বাদঃ সচল জড়বাদ আধুনিক দর্শনের একটি উল্লেখযােগ্য দার্শনিক মতবাদ। বিজ্ঞানীরা ডাল্টনের নিষ্ক্রিয়তা ও গতিহীনতার নীতিকে অস্বীকার করে প্রমাণ করেন যে, পরমাণু নিষ্ক্রিয় ও নিশ্চল নয় বরং সক্রিয় এবং সচল। তাদের মতবাদ সচল জড়বাদ নামে পরিচিত। আধুনিককালের পদার্থবিদরা ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে পরমাণুর এ রহস্য উন্মােচন করেন। পাশ্চাত্যের অন্যতম বিজ্ঞানী ফ্যারাডে প্রমাণ করেন যে, পরমাণু নিষ্ক্রিয় নয়।

বরং প্রত্যেকটি পরমাণু তড়িৎযুক্ত, যার ফলে তারা একে অপরকে আকর্ষণ-বিকর্ষণ করতে পারে। বিজ্ঞানী নিউটনও পরমাণুর আকর্ষণ ও বিকর্ষণ শক্তিতে বিশ্বাস করতেন। লর্ড কেলভিনের মতে, পরমাণু হলাে সর্বব্যাপী তরল পদার্থের মত। অস্টওয়াল্ড-এর মতে, প্রত্যেকটি পরমাণু হচ্ছে শক্তির আধার। এ শক্তি সাধারণত সাম্যাবস্থাতেই থাকে, কিন্তু কোনাে কারণে সাম্যাবস্থা ব্যাহত হলে শক্তির প্রকাশ ঘটে।

(২) পরমাণুবাদ না নিশ্চল জড়বাদঃ আধুনিককালে বিজ্ঞানীদের মতে, বিভিন্ন জাগতিক বস্তু, যেমন-পানি, বাতাস ইত্যাদি বিশ্লেষণ করা হলে কতগুলাে মৌলিক উপাদান পাওয়া যায়। এগুলাে হলাে অক্সিজেন, কার্বন, নাইট্রোজেন ইত্যাদি। এ মৌলিক উপাদান দিয়েই সব জড়বস্তু গঠিত। মৌলিক উপাদানগুলাে বিভিন্ন অনুপাতে মিশ্রিত হওয়ার ফলেই বিভিন্ন বস্তুর সৃষ্টি হয়।

ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ডেমােক্রিটাসের পরমাণুবাদের ওপর ভিত্তি করে তার নিশ্চল জড়বাদ উপস্থাপন করেন। তার মতে, কোনাে জড়বস্তুকে ক্রমাগতভাবে ভাগ করা হলে শেষ পর্যন্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা পাওয়া যায়। যেগুলােকে আর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে ভাগ করা যায় না। এ ক্ষুদ্রতম কণাগুলাে অবিভাজ্য এবং অবিনাশী, অভেদ্য এবং গতিহীন। কিন্তু বাইরে থেকে শক্তি প্রয়ােগে এগুলােকে গতিশীল করা যায়।

ডাল্টন বলেন, জড় ও শক্তি হলাে পরস্পর নিরপেক্ষ স্বতন্ত্র সত্তা এবং তাদের কোন বিনাশ নেই, যদিও রূপান্তর ঘটতে পারে। আর একেই বলে জড় ও শক্তির অবিনশ্বরতা নীতি।

অত্যাধুনিক মতবাদঃ জড়ের প্রকৃতি সম্পর্কে অত্যাধুনিক মতবাদ দিয়েছেন আলেকজান্ডার ও হােয়াইটহেড। অধ্যাপক আলেকজান্ডারের মতে, জগতের আদিম উপাদান হলাে দেশ-কাল। জড়ের উৎপত্তি এ দেশ-কাল থেকে। জড় হল দেশ কাল উপাদান থেকে পরবর্তীকালের উন্মেষের ফল। দেশ-কাল আপেক্ষিকতা থেকে সমস্ত বস্তুর সৃষ্টি।

হােয়াইটহেড-এর মতামতঃ জড়ের স্বরূপের সবচেয়ে সুন্দর ব্যাখ্যা দেন প্রফেসর হােয়াইটহেড। তার মতে, জড় হলাে যাকে আমরা আমাদের ইন্দ্রিয়ের দ্বারা প্রত্যক্ষ করি। জগৎ পরিবর্তনের মাঝে আমাদের সামনে উপস্থিত হয়। কিন্তু আমরা একে প্রথম জানি সংবেদনের মধ্যে, তারপর ব্যাখ্যার ক্রমােন্নতির সাথে সাথে আমরা সেই জগৎকেই প্রত্যক্ষগত বস্তুর মাধ্যমে ভালােভাবে জানি। জড় অর্থে তিনি প্রকৃতিকে বুঝেন।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, জড়ের ধারণার অভূতপূর্ব পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। নিষ্ক্রিয় নির্জীব ধারণা এখন সুদীর্ঘ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে শক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে। পদার্থবিদ্যা ও গণিতের কৃপায় আমরা শক্তির এক বিস্ময়কর রাজ্যে প্রবেশ করেছি। এ জগৎ বস্তুর নিষ্ক্রিয় জগৎ নয়। শক্তির প্রচণ্ড লীলানিকেতন। এ বিশ্বজগৎ এক মহা আধ্যাত্মিক শক্তির বিকাশ বিশ্বের যাবতীয় পরিবর্তন সেই শক্তির উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য বিজ্ঞানশক্তির বাহ্যলীলা দর্শন করে বিস্মিত হয়েছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক