দেশ ও কালের সংজ্ঞা দাও। দেশ-কাল কী বিষয়গত না বিষয়ীগত, না উভয়ই? আলােচনা কর


প্রশ্নঃ দেশ ও কালের সংজ্ঞা দাও। দেশ-কাল কী বিষয়গত না বিষয়ীগত, না উভয়ই? আলােচনা কর।

অথবা, দেশ ও কাল কী? দেশ-কল কী বিষয়গত না বিষয়ীগত, না উভয়ই? ব্যাখ্যা কর।

ভূমিকাঃ জ্ঞানের মৌলিক ধারণাসমূহের মধ্যে দেশ, কাল, দ্রব্য এবং কার্যকারণ সম্পর্ক প্রধান বলে স্বীকৃত। বিশ্বতাত্ত্বিক ধারণা অন্তর্ভুক্ত হলাে দেশ ও কালের ধারণা। বিভিন্ন দার্শনিক বিভিন্নভাবে দেশ ও কালের সম্পর্কে আলােচনা করেছেন। দেশ ও কালের স্বরূপ সম্পর্কে এসব দার্শনিকদের মত বা আলােচনাকে প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথাঃ (১) বস্তুগত মত, (২) আত্মগত মত এবং (৩) বস্তুগত ও আত্মগত মত । দেশ ও কালের ধারণা দর্শনের জ্ঞানবিদ্যা নামক শাখার অন্যতম আলােচ্য বিষয়।

দেশের স্বরূপঃ সাধারণ দেশ বলতে বােঝায় বস্তুর পার্থিব আধারকে। এ দেশ আমাদের কাছে সর্বত্র বিস্তৃত এবং সীমাহীন বলে মনে হয়। আমরা যে দিকেই তাকাই না কেন অনন্তবিস্তত দেশকে চোখের সামনে দেখতে পাই। এ দেশের কোনাে সীমা নেই। কেননা, দেশের যেখানে সীমা কল্পনা করা হয় সেখানেই আবার অনন্ত দেশ দেখা যায়। দেশই দেশের সীমা বলা যায়। দেশের আরও কতগুলাে বৈশিষ্ট্য আমরা দেখতে পাই।।

কালের স্বরূপঃ কালের ধারণা সাধারণত ঘটনার পূর্বাপর সম্পর্ক থেকে জন্মে। এ জগতে নিয়ত ঘটনা ঘটে চলেছে। কোনােটি আগে, কোনােটি পরে, আবার কখনও বা একত্রে। মনে হয় যেন কালও চলছে। বিভিন্ন বস্তুর মধ্যে পরিবর্তন ও গতি দেখা যায়। কালের সাহায্যেই আমরা বস্তুর এ গতি ও পরিবর্তন উপলব্ধি করি। কালেরও কিছু বৈশিষ্ট্য আমরা দেখতে পাই।

দেশ ও কাল বিষয়ীগত, আত্মগত না বিষয়গত না বস্তুগতঃ দেশ ও কাল আত্মগত বা বিষয়ীগত বস্তুগত বা বিষয়গত এ সিদ্ধান্তে আসার পূর্বে আমাদের জানা প্রয়ােজন, আত্মগত বা বিষয়ীগত দেশ বলতে আমরা কী বুঝি আর বস্তুগত বা বিষয়গত দেশ বলতেই বা আমরা কী বুঝি।

বস্তুগত বা বিষয়গত বা প্রত্যক্ষগত দেশ ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে আমরা বিভিন্ন বস্তুর যে দৈহিক সম্পর্ক প্রত্যক্ষ করি তাকে বলা হয় বস্তুগত বা বিষয়গত বা প্রত্যক্ষগত দেশ। আমরা বিভিন্নবস্তু প্রত্যক্ষ করি তখন দেখি বস্তুগুলাে বিভিন্ন স্থান বা দেশ দখল করে রয়েছে। এরূপ খণ্ড-খণ্ড দেশের যে জ্ঞান তাকেই প্রত্যক্ষগত দেশের জ্ঞান। আর বস্তুর সাথে সম্পর্কযুক্ত বিধায় এসব খণ্ড-খণ্ড দেশকে বস্তুগত দেশ বলা হয়।

আত্মগত বা বিষয়ীগত বা ধারণাগত দেশেঃ আমরা যখন দেশকে বন্ধু থেকে পৃথক করে এক অসীম শূন্যতার কল্পনা করি তখন তাকে আত্মগত বা বিষয়গত বা ধারণাগত দেশ বলা হয়। এটা কল্পনায় বা ধারণায় সম্ভব। তাই এরূপ দেশকে আত্মগত বা বিষয়ীগত বা ধারণাগত দেশ বলা হয়।

বস্তুগত বা বিষয়গত বা প্রত্যক্ষণগত কালঃ ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষণের মাধ্যমে আমরা কালের যে রূপকে প্রত্যক্ষ করি তাকে বস্তুগত বা বিষয়গত বা প্রত্যক্ষণগত কাল বলে। এরূপ কালকে আমরা বস্তু বা ঘটনার সাথে সম্পর্কযুক্ত করে ব্যাখ্যা করি।

আত্মগত বা বিষয়ীগত কালঃ এই ধরনের কাল এক নিরবচ্ছিন্ন গতি বা প্রবাহমাত্র। এই ধরনেরকাল ঘটনার সাথে সম্পর্কহীন এক বিশুদ্ধ গতি। এ কাল অনন্ত, অখণ্ড, অব্যয়, অমর, অশেষ। উল্লেখ্য বিভিন্ন দার্শনিক দেশ ও কালকে বিভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেশ ও কালের স্বরূপ সম্পর্কে তিনটি স্বতন্ত্র মতবাদের সৃষ্টি করেন তা নিম্নরূপঃ

(১) দেশ ও কালের বস্তুগত বা বিষয়গত মতঃ সাধারণ দৃষ্টিতে দেশ ও কালের বিষয়গত বা বস্তুগত সত্তা রয়েছে। এ মতবাদ অনুযায়ী দেশ ও কালের সঙ্গে বস্তু ও ঘটনার এক অনিবার্য সম্পর্ক রয়েছে। বিভিন্ন দার্শনিক দেশ ও কালের বিষয়গততা বা বস্তুগততা স্বীকার করেন। যেমনঃ প্রাচীন গ্রীক পরমানুবাদী লিউসিপ্লাস, ডেমােক্রিটাস প্রমুখ দেশের বস্তুগত বা বিষয়গত সত্তায় বিশ্বাস করেন। তাদের মতে, যাবতীয় বস্তু নির্দিষ্ট স্থান দখল করে থাকে। দেশ হলাে অসংখ্য পরমাণুর সমন্বয়ে গঠিত বস্তুসমূহের আধার। স্পিনােজার মতে, ঈশ্বরই একমাত্র দ্রব্য। ঈশ্বরের অনন্ত গুণের মধ্যে একটি প্রধান গুণ হলাে বিস্তৃতি বা দেশ। এই প্রকৃতি বা দেশ বাস্তব। এই প্রকৃতি বা দেশ অসংখ্য বস্তুর বৈচিত্র্যের মাঝেও অখণ্ড। একইভাবে অখণ্ড হয়েও অসংখ্য বৈচিত্র্যের একটি আধার। আলেকজান্ডারের মতে, “দেশ-কাল জগতের সমস্ত বস্তুর আধার। দেশ-কাল অভিন্ন। জগতের যাবতীয় বস্তু দেশ ও কাল থেকে উদ্ভূত হয়”। ডেকার্টের মতে, “জগতের মূল উপাদান দু’টি। দেহ বা জড় ও মানবচৈতন্য।” তার মতে, জড়ের প্রধান ধর্ম হচ্ছে দেশ বা বিস্তৃতি। জগতের যাবতীয় বস্তুর আধার হলাে দেশ, দেশ হলাে কতকগুলাে বিন্দুর সমাবেশ।

(২) দেশ ও কালের আত্মগত বা বিষয়গত মতঃ অনেক দার্শনিক মনে করেন, দেশ ও কালের বস্তুগত সত্তা নেই। আত্মগত সত্তা রয়েছে। যেমনঃ লিবনিজের মতে, দেশ ও কালের কোনাে বস্তুগত সত্তা নেই। তার মতে, জাগতিক বস্তুর মূল উপাদান হচ্ছে চিৎপরমাণু। এই চিৎপরমাণুগুলাে জড় নয় বলে এর কোনাে স্থান বা দেশ দখল করে না। দেশ ও কালের প্রকৃতপক্ষে কোনাে বাস্তব অস্তিত্ব নেই। এগুলাে আমাদের মনের ধারণামাত্র। দেশ ও কালের বাস্তব ধারণা আমাদের মনে আসে, চিৎপরমাণুগুলাের সম্পর্কে আমাদের ভ্রান্ত ধারণার ফলে। কান্টের মতে, দেশ ও কালের ধারণা অভিজ্ঞতাপূর্ব বিধায় এগুলাের কেবল আত্মগত বা বিষয়ীগত সত্তা রয়েছে। দেশ ও কালের মধ্যদিয়ে আমরা যাবতীয় বস্তুর জ্ঞান পাই। উল্লেখ্য লাইবনিজ ও কান্টা ছাড়াও প্লেটো এবং এরিস্টটল ও দেশও কালের আত্মগত ও বিষয়ীগত অস্তিত্ব স্বীকার করেন। তাদের মতে, দেশ ও কাল ধারণায় অসীমভাবে বিভাজ্য হলেও বাস্তবে তাদের ভাগ করা যায় না।

(৩) দেশ ও কালের আত্মগত ও বস্তুগত উভয় মতঃ দার্শনিক হেগেল কান্টের দেশ ও কালের আত্মগততাকে অস্বীকার করেন, তার মতে দেশ ও কাল শুধু আত্মগত নয় বরং আত্মগত ও বস্তুগত উভয়ই এই জগত পরমাত্মা বা পরমসত্তারই বস্তুগত প্রকাশ। পরমসত্তা জগতের যাবতীয় বস্তুর মধ্যদিয়ে নিজেকে প্রকাশ করেন। হেগেল আরো বলেন দেশ ও কাল শুধু অভিজ্ঞতাপূর্ব বিষয়ই নয়। যার মধ্য দিয়ে আমরা বস্তুজ্ঞান লাভ করে থাকি। বরং দেশ ও কাল বাস্তব বিষয়ও বটে। আর দেশ ও কালের বাস্তব সত্তা আছে বলেই আমরা বস্তু ও ঘটনাকে প্রত্যক্ষ করি।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায়, দেশ ও কালের আলােচনা দর্শনে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। জ্ঞান বিদ্যা ও অধিবিদ্যা দেশ ও কালের আলােচনায় বিভিন্ন মতবাদের উদ্ভব ও বিকাশে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রেখেছে। দার্শনিকগণের দেশ ও কাল সম্পর্কিত চিন্তাধারা পদার্থবিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছে। তাই সমসাময়িক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে দেশ ও কালের আলােচনা লক্ষণীয়। দেশ ও কাল আত্মগত হােক আর বস্তুগত হােক একথা অনস্বীকার্য যে, “দেশ ও কাল দর্শনশাস্ত্রে একটি নব আলােচিত বিষয় হিসেবে দেখা দিয়ে দর্শন শাস্ত্রকে করেছে আরাে সমৃদ্ধ ও সুদূরপ্রসারী।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক