অথবা, বিবর্তনবাদের প্রকারভেদ হিসেবে উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনবাদ ও উন্মেষমূলক বিবর্তাদের ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন কর।
ভূমিকাঃ বিবর্তনবাদ জগতের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্বন্ধীয় একটি মতবাদ। বিবর্তনবাদ অনুসারে, এ বিশ্ব আকস্মিকভাবে সৃষ্টি হয়নি। জগতের অসংখ্য জীবজন্তু, কীটপতঙ্গ তথা সকল জীবন ও অজৈব সত্তা এক সহজ-সরল আদিম অবস্থা থেকে বিকশিত হয়ে বর্তমান অবস্থায় পৌঁছেছে। এবং এই বিবর্তনধারা অগ্রসর হয়ে চলেছে নিরন্তর। এ জগৎ এক অবিরাম পরিবর্তনপ্রবাহ। আর এ পরিবর্তনধারায় নিয়ত বদল হচ্ছে জগৎ, জীবন, সমাজ তথা জগতের সবাকছু। এই বিবর্তনবাদ কয়েক প্রকারের; যথা- যান্ত্রিক বিবর্তনবাদ, উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনবাদ, সৃজনমূলক বিবর্তনবাদ এবং উন্মেষমূলক বিবর্তনবাদ। নিচে আমরা উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনবাদ এবং উন্বেষমূলক বিবর্তনবাদ আলােচনা করব।
উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনবাদঃ উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনবাদ জগতের উৎপত্তি ও বিকাশসম্পকীয় একটি অতিপরিচিত মতবাদ। বিবর্তনের পেছনে যে একটি বিশেষ উদ্দেশ্য বা পরিণতি রয়েছে তার ওপর গুরুত্বারােপ করে এ মতবাদ প্রণীত বলেই এটি উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনবাদ নামে সর্বাধিক পরিচিত।
প্রাচীন যুগে উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনবাদঃ দর্শনে জগৎ সম্পর্কে উদ্দেশ্যমূলক ব্যাখ্যা নতুন নয়। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকদের অনেকেই জগৎকে উদ্দেশ্য বা পিরণতির সাহায্যে ব্যাখ্যা করেন। বলা হয় যে, এনাক্সাগােরাসই সর্বপ্রথম জগতের উদ্দেশ্যমূলক ব্যাখ্যা দেন। জগতের উদ্দেশ্যমূলক ব্যাখ্যা আরাে স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয় সক্রেটিসের হাতে। তিনি জগৎ সৃষ্টির পেছনে একজন বুদ্ধিমান কর্তার সন্ধান পান। তবে গ্রিক দার্শনিকদের মধ্যে এরিস্টটলই যুক্তিসঙ্গতভাবে জগতের উদ্দেশ্যমূলক ব্যাখ্যা দেন।
আধুনিক যুগে উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনবাদঃ আধুনিক যুগে যেসব দার্শনিক পরােক্ষভাবে জগতের উদ্দেশ্যমূলক ব্যাখ্যা দেন, তাদের মধ্যে ব্রুনাে, লাইবনিজ, ফিখটে, হেগেল, মার্টিনিউ প্রধান।
উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনবাদের সমর্থকগণ মনে করেন, এ জগৎ এক অন্ধ ও নিছক যান্ত্রিক বিবর্তনের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়নি। এর পেছনে কোনাে এক সচেতন সত্তার উদ্দেশ্য বা পরিকল্পনা রয়েছে। তারা উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনের পক্ষে যুক্তি দেখান, যে বিবর্তনের মাধ্যমে এ জগৎ সৃষ্টি হয়েছে তার পেছনে নিশ্চয়ই কোনাে কারণ রয়েছে। আর তা হলাে উদ্দেশ্য সাধন। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই বিবর্তনের মাধ্যমে জগৎ ও এর অন্তর্ভুক্ত প্রাণী ও পদার্থের সৃষ্টি। উদ্দেশ্যমূলক দার্শনিকেরা বিবর্তনপ্রক্রিয়াকে উদ্দেশ্যমুখী বলে স্বীকার করলেও উদ্দেশ্যের স্বরূপ সম্পর্কে দুটি ভিন্ন মত পােষণ করেন। কারাে মতে উদ্দেশ্যবাদ বাহ্য এবং কারাে মতে উদ্দেশ্যবাদ আন্তর। সুতরাং আমরা দু'ধরনের উদ্দেশ্যবাদ পাই- বাহ্য এবং আন্তর।
সমালােচনাঃ উদ্দেশ্যমূলক বিবর্তনবাদের বিপক্ষে অনেক আপত্তি উত্থাপন করা যেতে পারে। নিম্নে তা আলােচনা করা হলাে-
(১) উদ্দেশ্যবাদ স্রষ্টাকে কারিগরে পরিণত করেঃ উদ্দেশ্যবাদ স্রষ্টাকে একজন সাধারণ কারিগরে পরিণত করে। তা ছাড়া স্রষ্টা যদি জগতের বাইরে হন, তাহলে জগৎ ও স্রষ্টা দুটো সত্তাকে স্বীকার করতে হয়। এখানে দ্বৈতবাদের কথা এসে যায়। আবার স্রষ্টাও জগৎ দ্বারা সীমাবদ্ধ হয়ে যান।
(২) উদ্দেশ্যবাদ স্রষ্টা ও জগৎকে এক সত্তায় পরিণত করেঃ স্রষ্টা জগতে নিজেকে প্রকাশ করলেও তিনি জগৎ বহির্ভূত অন্য সব কিছুতেই বিদ্যমান। এক অনন্ত ও অসীম সত্তা হিসেবে স্রষ্টা জগতের বাইরে ও ভেতরে সব জায়গায় ব্যাপ্ত। হেনরি বার্গসাে মনে করেন, উদ্দেশ্যবাদ নিয়ন্ত্রণবাদের সমান্তর। এখানে ভবিষ্যৎ দ্বারা সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে।
উন্মেষমূলক বিবর্তনবাদঃ উন্মেষমূলক বিবর্তবাদ একটি অভিনব বিবর্তনবাদ। এমতানুসারে জগতের বিবর্তনপ্রক্রিয়ার প্রতি স্তরে নতুন নতুন সত্তা বা গুণের উন্মেষ ঘটে, যা পূর্ববর্তী স্তরে পুনর্বিন্যাস নয়। উন্মেষবাদীদের মতে, মন প্রাণ থেকে আর প্রাণ জড় থেকে উন্মােষিত হলেও প্রাণের মধ্যে এমন এক গুণ বা বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা জড়ের নেই, আবার মনের মধ্যে এমন গুণ রয়েছে যা প্রাণের মধ্যে নেই। তাদের মতে, জড় থেকে প্রাণ এবং প্রাণ থেকে মন পর্যায়ক্রমে নিরবচ্ছিন্ন থাকলেও প্রাণ জড়ের জটিল আকার মাত্র নয়, প্রাণ হলাে নতুন গুণ ও শক্তিবিশিষ্ট এমন এক সত্তা যা উন্মেষের আগে জড় ও প্রাণ প্রভৃতি স্তরের মধ্যে নিহিত ছিল না। উন্মেষবাদের দুজন সফল প্রবক্তা হলেন মর্গান এবং আলেকজান্ডার। আমরা এদের মত সংক্ষেপে আলােচনা করব।
মর্গানের উন্মেষমূলক বিবর্তনবাদঃ মর্গানের মতে, বিবর্তনপ্রক্রিয়ার প্রতিটি স্তরে নতুন উন্মােষিত গুণের আবির্ভাব ঘটে। তিনি বিবর্তনপ্রক্রিয়ার অনুকূল একটি শক্তির অস্তিত্ব স্বীকার করেন। তিনি এই শক্তি বা সক্রিয়তাকে কখনও মন, কখনও আত্মা আবার কখনও স্রষ্টা নামে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, এই শক্তিই আকর্ষণীশক্তিরূপে কাজ করে।
আপত্তি/ সমালােচনাঃ উন্মেষমূলক বিবর্তনের কিছু দোষ-ত্রুটি রয়েছে। এগুলাে নিচে আলােচনা করা হলাে-
(১) মর্গানের মত আত্মবিরােধীঃ লয়েড মর্গানের বিরুদ্ধে আত্মবিরােধিতার অভিযােগ উত্থাপন করা যায়। তিনি একদিকে স্রষ্টাকে বিবর্তনপ্রক্রিয়ার সক্রিয় শক্তিরূপে দেখিয়েছেন, আবার স্রষ্টাকে জগত্ত্বহিভূত সত্তা হিসেবেও গ্রহণ করেছেন। স্রষ্টাকে জগত্ত্বহির্ভূত সত্তা হিসেবে বিবেচনা করলে জগতের সাথে স্রষ্টার সম্পর্ক সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না।
(২) আলেকজান্ডারের মত যান্ত্রিকঃ আলেকজান্ডারের মতবাদ যান্ত্রিক বিবর্তনবাদের কথা ব্যক্ত করে। তার মতে, আদি উপাদান দেশ-কাল থেকে জড়ের গুণগুলাের উদ্ভব ঘটে। কিন্তু পরিমাপ থেকে কিভাবে গুণের উদ্ভব ঘটে তার ব্যাখ্যা তিনি বিশদভাবে দেননি।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, যদিও উদ্দেশ্যমূলক ও উন্মেষমূলক বিবর্তনের কিছু দোষ-ত্রুটি রয়েছে, তবুও এর গুরুত্বকে আমরা কোনােমতেই অস্বীকার করতে পারি না। বিবর্তনবাদের এ মত আজকের বিভিন্ন দার্শনিকের কাছে গ্রহণযােগ্য মতবাদ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে।
0 মন্তব্যসমূহ