অথবা, প্রাণের স্বরূপ সম্পৰ্কীয় বিভিন্ন মতবাদ ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন কর।
অথবা, জীবনের উৎপত্তি সম্পর্কীয় প্রধান মতবাদগুলাে আলােচনা কর।
ভূমিকাঃ প্রাণ হলাে সেই শক্তি বা ক্ষমতা, যা বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বিকাশ ঘটিয়ে তাদের মধ্যে এক স্থিতাবস্থা ও ঐক্য বজায় রাখে এবং পারিপার্শ্বিকের সাথে শরীরের সামঞ্জস্য রক্ষা করে তার ক্ষয়ক্ষতি পূরণ করণের মধ্যে দিয়া নিজেকে বহু বিভক্ত করে দেখা। প্রাণ বা জীবনকে আশ্রয় করেই দেহ নিজেকে বিকাশিত করে। অর্থাৎ দেহের মাধ্যমেই প্রাণের প্রকাশ ঘটে।
প্রাণ বা জীবনের উৎপত্তি বা স্বরূপ সম্পর্কিত মতবাদসমূহঃ প্রাণ বা জীবনের উৎপত্তিস্বরূপ সম্পর্কিত বিভিন্ন মতবাদ দর্শনে বিদ্যমান রয়েছে। এগুলাে হলো- ১. যন্ত্রবাদ, ২. প্রাণবাদ, ৩. উন্মােষবাদ ৪ ভাববাদী মতবাদ, ৫. বার্গষোর মতবাদ প্রভৃতি। নিম্নে এসব মতবাদ আলােচনা করা হলাে-
(১) যন্ত্রবাদঃ যন্ত্রবাদ বা যান্ত্রিকবাদের মতে, প্রাণ জড়েরই জটিল রূপমাত্র এবং জীবদেহ একটি জটিল সন্তান, প্রাণ ও জড়ের মধ্যে কোনাে মৌলিক পার্থক্য নেই এবং এদের মধ্যে শুধু পরিমাণগত পার্থক্য রয়েছে। জড় এর গতির যৌগিক প্রক্রিয়ার ফলে সমস্ত জীবের উদ্ভব হয়ে থাকে। যন্ত্রবাদীদের মতে, যেকোনাে জীবদেহ বিশ্লেষণ করলেই কার্বন, অক্সিজেন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন, ক্যালসিয়াম প্রভৃতি রাসয়নিক উপাদান দেখতে পাওয়া যায়। জীব দেহ এবং জড় পদার্থ উভয়ের মধ্যেই এসব উপাদান দেখা যায়। তাই জীবদেহ ও জড় পদার্থের মধ্যে উপাদানের দিক থেকে কোনাে পার্থক্য দেখা যায় না। জীবদেহ ও জড় পদার্থের মধ্যে শুধু পার্থক্য এই যে, জীবদেহের মধ্যে একটি জটিল গঠনব্যবস্থা দেখা যায় । অর্থাৎ যন্ত্রের তুলনায় জীবদেহ হলাে জটিলতর। মন্ত্রবাদের দু'টি দিক পরিলক্ষিত হয়। যথাঃ ক) প্রাণ জড়ের একটি রূপবিশেষ খ) উদ্দীপকের প্রতি প্রতিক্রিয়া।
(ক) প্রাণ জড়ের একটি রূপবিশেষঃ জড়বাদীদের মতে, জীব দেহে কোনাে রহস্যজনক প্রাণশক্তির স্থান নেই। প্রাণশক্তি জড়শক্তির একটি বিশেষ রূপ মাত্র। প্রাণজৈবিক প্রক্রিয়া থেকে স্বতন্ত্র কিছু নয়। যন্ত্রের মতাে জীবদেহকে ও যান্ত্রিক কার্যকারণ সম্পর্কে ব্যাখ্যা করা যায়। যন্ত্রবাদ বা জড়বাদের মূল বক্তব্য হলাে এই যে, যন্ত্র ও জীবদেহ একই জড়শক্তির দুটি ভিন্ন প্রকাশ মাত্র। প্রাণের মূলে রয়েছে বিভিন্ন রাসায়নিক প্রক্রিয়া এবং জড়শক্তিই ক্রিয়া। তাদের মতে, জড় থেকেই প্রাণের উৎপত্তি।
(খ) উদ্দীপকের প্রতিক্রিয়াঃ জড়বাদীদের মতে, উদ্দীপকের রাসায়নিক আকর্ষণের ফলেই জীবদেহের মধ্যে স্বতঃস্ফুর্ত প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। তাই জীবদেহে পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্য বিধানকালে যে উত্তেজনা দেখায়, তার মূলে যন্ত্রবাদীরা কোনাে প্রাণশক্তির উপস্থিতি স্বীকার করে না। যান্ত্রিক পদ্ধতিতে জীব দেহের ওপর উদ্দীপকের প্রতিক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করাই আধুনিক যন্ত্রবাদীদের মূল উদ্দেশ্য।
(২) প্রাণবাদঃ প্রাণবাদীদের মতে, প্রাণশক্তি জড়শক্তি থেকে স্বতন্ত্র শক্তি এবং এ দু'টি শক্তির মধ্যে মৌলিক ও গুণগত পার্থক্য রয়েছে। প্রাণশক্তি জড়শক্তি থেকে উদ্ভূত হয়েছে এ কথা সঠিক নয়। প্রাণ জড়কে বা জড়দেহকে আশ্রয় করেই নিজেকে বিকশিত করে। কিন্তু তাই বলে প্রাণশক্তিকে জড়দেহের ভৌতিক বা রাসায়নিক ক্রিয়া বলা চলে না। ভৌতিক ও রাসায়নিক প্রক্রিয়ার ফলে জীবকোষের সৃষ্টি সম্ভব হয়।
প্রাণবাদ সম্পর্কে অধ্যাপক এমতিন তার 'An Outline of Philosophy' গ্রন্থে বলেন, “প্রাণবাদ যন্ত্রবাদের বিরুদ্ধে তীব্র বিরােধ সৃষ্টি করেছে। এ মতবাদ অনুসারে, আমাদের দেহ শুধু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সমষ্টি নয়, এর মধ্যে একটি অজড় সত্তা বিদ্যমান।” জীবদেহ হলাে প্রাণশক্তির আধার এবং জীবদেহ ও যন্ত্র দু'টি ভিন্ন জিনিস। এদের প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। জীবের এমন কতগুলাে বৈশিষ্ট্য আছে যেমনঃ আত্মনিয়ন্ত্রণ, আত্মসংরক্ষণ, আত্মবিকাশ প্রভৃতি যেগুলাে যন্ত্রে সেই । তাই জীবদেহের বেলায় যান্ত্রিক ব্যাখ্যা প্রয়ােগ করা যায় না। প্রাণবাদীরা বলেন, প্রাণ একটি অজড় সূক্ষ্ম সত্তা থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। অর্থাৎ প্রাণসত্তা থেকেই উদ্ভূত হয়েছে। প্রাণবাদ সম্পর্কে সাধারণ দুটি মত পরিলক্ষিত হয়। যথাঃ
(ক) প্রাচীন প্রাণবাদঃ প্রাচীন প্রাণবাদের প্রবর্তক গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল। তার মতে, আত্মাই জীবনের উৎস এবং আত্মাই জীবনসত্তা । তিনি বলেন, গাছপালা, উদ্ভিদ প্রভৃতির মধ্যে উদ্ভিদাত্মা এবং জীবজন্তু বা প্রাণীর মধ্যে জীবাত্মা বা জনশক্তি প্রাণ রয়েছে। আর মানুষের মধ্যে আরাে একটি শক্তি রয়েছে, যার নাম বৃত্তি বা বৌদ্ধিক শক্তি। এ প্রাণশক্তিই জীবের সাংগঠনিক শক্তি।
(খ) নব্য প্রাণবাদঃ প্রাচীন প্রাণবাদের এ মতবাদকে নব্য প্রাণবাদ পুরােপুরি সমর্থন করে না। তাদের কথা এই যে, প্রাণকে জড় এবং গতিতে রূপান্তরিত করা যায় না একথা ঠিকই; কিন্তু একথা সত্য যে প্রাণের ধারণায় প্রাচীন প্রাণবাদারা এমন এক রহস্যমমতার সৃষ্টি করেছেন, যা দর্শন বা বিজ্ঞান কোনােটাই পুরােপুরিভাবে গ্রহণ করতে পারে না। হ্যানস ড্রেক বলেন, জীবন কখনও জড়বস্তু থেকে উৎপত্তি লাভ করতে পারে না। এবং সে জন্য ভৌতিক এবং রাসায়নিক প্রক্রিয়ার সাহায্যে প্রাণকে ব্যাখ্যা করা যায় না। প্রাণ হলাে একটি পৃথক মৌলিক সত্তা এবং প্রাণের মধ্যে এমন কতকগুলাে। বৈশিষ্ট্য আছে যেগুলাে জড় পদার্থে উপস্থিত নেই।
(৩) উন্মেষবাদঃ আলেকজান্ডার, মর্গান প্রমুখ দার্শনিক প্রাণের উৎপত্তি সম্পর্কে এক নতুন মতবাদের কথা প্রচার করেন। তাদের মতে, প্রাণের মৌলিকত্ব আছে ঠিকই, কিন্তু তা সত্ত্বেও এই প্রাণশক্তি জড়শক্তি থেকেই উদ্ভূত হয়ে থাকে। কারণ জড়ই জগতের আদিম উপাদান। অধ্যাপক এ, মতিন তার 'An Outline of Philosophy' গ্রন্থে এ সম্পর্কে বলেন, “প্রাণ জড় থেকে সতন্ত্র এই কারণে যে প্রাণ জড় থেকে অনেক নতুন গুণাবলি ও আচরণ অর্পণ করে থাকে। প্রাণের উন্মেষ অন্যান্য বস্তুর মতাে জড় থেকে ঘটলেও প্রাণ জড় নয় বরং এ হলাে একটি সম্পূর্ণ মৌলিক সত্তা।”
(8) ভাববাদী দার্শনিকদের মতবাদঃ ভাববাদী দার্শনিকেরা নব্য প্রাণবাদিদের সমর্থন করে বলেন যে, প্রাণ জড় থেকে স্বতন্দ্র এবং ভৌতিক ও রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় প্রাণের ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু ভাবাদীরা বলেন যে, প্রাণ যেহেতু জড়ে অতিরিক্ত সত্তা, সেহেতু এ প্রাণ নিজের প্রয়ােজনে উপযােগী জীবদেহ গঠন করতে পারে কি না, এটি প্রশ্নাসাপেক্ষ। তাই তাদের মতে, পরম আধ্যাত্মিক সত্তা এই বিশ্বজগতে বিবর্তনের বিভিন্ন স্তরের মাধ্যমে নিজ স্বরূপকে উপলব্ধি ও প্রকাশ করার প্রয়ােজনের খাতিরেই প্রাণের আবির্ভাব। এদিক থেকে প্রাণ সেই চেতন পরম সত্তার আত্মােপলব্ধি ও আত্মপ্রকাশের পথে একটি স্তর মাত্র।
(৫) বার্গসের মতবাদঃ দার্শনিক হেনার বার্গসের মত অনুযায়ী, “বিবর্তনের পথে এক সৃজণধর্মী শক্তির পরিকল্পিত উন্নতমানের প্রভাবে নব নব বস্তু ও জীবের উন্মেষ এ পৃথিবীতে অলংকারিত করে থাকে। এ উন্নতমানের বিবর্তনের পথে প্রাণ হলাে এক নতুন সত্তা। এর ফলে প্রাণের মধ্যে বির্তনের পথে এমন কতকগুলাে নতুন গুণের সমন্বয় ঘটে, যা পূর্ববর্তী উপাদানগুলাের মধ্যে থাকে না। বার্গসের মতে, প্রকৃতির মধ্যে বিবর্তনের পথে একটি সাংগঠনিক শক্তি অনবরত কাজ করছে এবং তার দ্বারা প্রাণের সৃষ্টি হয়ে থাকে।
সমালােচনাঃ প্রাণ বা জীবনের উৎপত্তির স্বরূপ সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ প্রচলিত থাকলেও কোনাে মতবাদই সমালােচনা উর্ধ্বে নয়। এ মতবাদগুলাের বিরুদ্ধে উত্থাপিত সমালােচনাগুলাে নিম্নে উল্লেখ করা হলাে-
(১) যন্ত্রবাদীদের মতবাদ জড়বাদের স্বাভাবিক পরিণতি ছাড়া আর কিছুই নয়। জড় ও প্রাণ এক বা অভিন্ন হতে পারে না। কেননা জড় ও প্রাণের মধ্যে মৌলিক ও গুণগত পার্থক্য রয়েছে।
(২) যন্ত্র ও প্রাণের মধ্যে পার্থক্য থাকলে একই প্রাণশক্তি একটি মৌলিক শক্তি হিসাবে গণ্য হলে জড় দেহে প্রাণের অস্তিত্ব কীভাবে সম্ভবপর, তার সঠিক ও সন্তোষজনক কোনাে ব্যাখ্যা প্রাণবাদীদের মতবাদে দেখা যায় না।
(৩) যন্ত্রবাদী দার্শনিকেরা প্রাণের প্রকৃতি ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে যে মতবাদের কথা বলেছেন, তা সন্তোষজনক নয়। তারা প্রাণের প্রকৃতি সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে যান্ত্রিক মতবাদের সাহায্য নেয় এবং তাদের মতবাদেরই স্ববিরােধী বক্তব্য পেশ করেন।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় প্রাণ বা জীবনের উৎপত্তি ও স্বরূপ সম্পর্কে দার্শনিকদের মধ্যে মতভেদের অন্ত নেই। জড়বাদীরা মান করেন, জড় থেকেই প্রাণের সৃষ্টি। প্রাণবাদীরা এমতবাদের বিরােধিতা করে বলেন, জড় থেকে প্রাণের উদ্ভব অসম্ভব। তাদের মতে, প্রাণ থেকেই প্রাণের উদ্ভব হয়। উন্মেষবাদীরা বলেন, জড় থেকেই প্রাণের উদ্ভব, তবে এরা পরস্পর আলাদা। সুতরাং প্রাণের উৎপত্তি সংক্রান্ত কোনাে মতবাদই সন্তোষজনক বলা যায় না।
0 মন্তব্যসমূহ