প্রশ্নঃ প্রাণ বা জীবনবিষয়ক মতবাদ হিসেবে যন্ত্রবাদ ও প্রাণবাদের মধ্যকার বিতর্ক বা পার্থক্য আলােচনা কর।
অথবা, প্রাণের উৎপত্তিবিষয়ক মতবাদ হিসেবে যন্ত্রবাদ ও প্রাণবাদ আলােচনা কর।
অথবা, জীবনের উৎপত্তি সম্পকীয় মতবাদ হিসেবে যন্ত্রবাদ ও প্রাণবাদের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ কর।
ভূমিকাঃ পৃথিবীতে প্রাণের আবির্ভাব একটি আশ্চর্যজনক ব্যাপার। এ বিষয়টি দার্শনিক, বিজ্ঞানী, ধর্মতত্ত্ববিদ; এককথায় প্রতিটি বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন ব্যক্তির দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। প্রতিটি একসৃষ্টিবাদী ধর্মে বলা হয়ে থাকে যে, স্রষ্টা নিছক শূন্য থেকে অথবা পূর্বস্থিত কোনাে জড়পদার্থ থেকে প্রাণ সৃষ্টি করেছেন। কিছু কিছু বিজ্ঞানী মনে করেন, জড় থেকেই প্রাণের উদ্ভব ঘটেছে। এখন কথা হলাে প্রাণ কী? সাধারণত প্রাণ বলতে এক ধরনের শক্তি বােঝায় যা জড়দেহকে কেন্দ্র করেই বিদ্যমান। এটি জীবদেহের বিভিন্ন অংশের সামঞ্জস্য বিধান করে সন্তানসন্ততি উৎপাদনের মাধ্যমে স্বীয় বংশ রক্ষা করে।
প্রাণবাদঃ প্রাণবাদ অনুসারে প্রাণ বা জীবন কোনাে প্রাণহীন জড় থেকে উৎপন্ন নয়। প্রাণ একটি অজড়ীয় শক্তি প্রাণশক্তি থেকেই এর উদ্ভব। প্রাণবাদীদের মতে, প্রাণ অনিবার্যভাবে জড় দেহকে আশ্রয় করে থাকলেও এটি স্বরূপগত জড় পদার্থ থেকে স্বতন্ত্র। প্রাণীর মধ্যে যে কর্মচঞ্চলতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা, আত্মবিশ্বাস ও বংশবৃদ্ধির ক্ষমতা পরিলক্ষিত হয় তা জড়ের মধ্যে নেই। কাজেই জড়শক্তির প্রকৃতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন গুণবিশিষ্ট প্রাণী বা জীবকে নিছক ভৌতিক ও রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যান্ত্রিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না। তারা বলেন, শরীরের ভেতরে প্রাণশক্তিনামক এক বিশেষ শক্তি বিদ্যমান যা জড়াতিরিক্ত এই শক্তি থেকেই প্রাণের উৎপত্তি।
প্রাচীন যুগে প্রাণবাদঃ গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলের চিন্তাধারার মধ্যে প্রাণবাদের আভাস পাওয়া যায়। তিনি প্রাণশক্তিকে জীবের সাংগঠনিক শক্তি হিসেবে গণ্য করেন। এই সাংগঠনিক শক্তিই তার ভাষায় জীবনশক্তি।
মধ্যযুগের প্রাণবাদঃ এরিস্টলের চিন্তাধারার প্রভাব মধ্যযুগেও লক্ষণীয়। মধ্যযুগে এটি বিশ্বাস করা হত যে, প্রাণের উৎস জড় থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই উৎসকে আধ্যাত্মিক বা মনস্তাত্ত্বিক প্রকৃতি বলে মনে করা হত।
আধুনিককালের প্রাণবাদঃ আধুনিককালেও প্রাণবাদ জীববিজ্ঞানীও শরীরতত্ত্ববিদদের সমর্থন লাভ করেছে। জার্মান জীববিজ্ঞানী হ্যান্স ড্রিস প্রাণবাদের পক্ষে বৈজ্ঞানিক তথ্য পরিবেশন করেন। তিনি পরীক্ষণমূলক প্রমাণের সাহায্যে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছানাে যে, প্রাণকে যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। সুতরাং আমরা বলতে পারি যে, প্রাণবাদ হলাে এমন একটি মতবাদ যেটা প্রাণকে একটি মৌলিক শক্তিরূপে গণ্য করে, যার অবস্থান জড়দেহে।
প্রাণবাদের ত্রুটিসমূহঃ প্রাণের উৎপত্তিসংক্রান্ত মতবাদ হিসেবে প্রাণবাদের কতগুলাে ত্রুটি বিদ্যমান। এগুলাে নিচে আলােচনা করা হলাে-
(১) প্রাণ জড় থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন নয়ঃ প্রাণ জড় থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং একেবারেই জড় থেকে বিচ্ছিন্ন এ কথা ঠিক নয়। জড়ের সাথে প্রাণের এক ধরনের সম্পর্ক ও ধারাবাহিকতা রয়েছে। জড়ের সাথে সম্পর্কিত হয়েই প্রাণ বিদ্যমান। জড়ের সাথে প্রাণের এ সম্পর্কটি প্রাণবাদে উপেক্ষিত হয়েছে।
(২) প্রাণবাদ যৌক্তিক নয়ঃ প্রাণবাদীদের মতে, প্রাণ একটি মৌলিক শক্তিরূপে জড়দেহে অবস্থান করে, কিন্তু শক্তি হিসেবে কীভাবে প্রাণশক্তি জড়দেহে অস্তিত্বশীল, তা প্রাণবাদীরা যুক্তি সহকারে ব্যাখ্যা করেননি।
(৩) প্রাণবাদ প্রমাণিত নয়ঃ জড়দেহে দার্শনিকগণ প্রাণশক্তিকে জড়শক্তির অতিরিক্ত এক স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবে বিবেচনা করেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত পরীক্ষণের সাহায্যে জীবদেহে ভৌত রাসায়নিক শক্তি ছাড়া অন্য কোনাে প্রাণশক্তির অস্তিত্বের কথা জানা সম্ভব হয়নি।
যন্ত্রবাদঃ যন্ত্রবাদ অনুসারে প্রাণ ভৌত রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট। কার্বন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন, সালফার, ক্যালসিয়াম প্রভৃতি ভৌত-রাসায়নিক উপাদান জীবকোষ গঠন করে এবং কালক্রমে ভৌত রাসায়নিক শক্তির প্রক্রিয়ার ফলে জীবদেহের উৎপত্তি হয় এবং প্রাণশক্তি লাভ করে। যন্ত্রবাদীদের মতে, জড় ও জীবের মধ্যে প্রকৃতিগত কোনাে পার্থক্য নেই। তবে জীবন জড়পদার্থের চেয়ে অধিকতর সূক্ষ্ম ও জটিল। যন্ত্রবাদীরা ভৌত রাসায়নিক শক্তি ব্যতীত অন্য কোন রকম রহস্যজনক প্রাণশক্তির উপস্থিতি স্বীকার করেন না।
যত্নবাদীদের মতে, জড়পদার্থের মত জীবদেহও প্রাকৃতিক নিয়মের অধীন। কাজেই যান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রাণের ব্যাখ্যা প্রদান সম্ভব, এখানে কোনাে অতিপ্রাকৃত রহস্যজনক শক্তির প্রয়ােজন নেই। তারা আরাে বলেন, দৈহিক শক্তির বৃদ্ধির ফলে প্রাণশক্তি বৃদ্ধি পায়। আবার দৈহিক ক্ষয়ের ফলে প্রাণশক্তিও হ্রাস পায়। এর ওপর ভিত্তি করেই যন্ত্রবাদীরা সিদ্ধান্ত নেন যে, জড় থেকে প্রাণ বা জীবনের উৎপত্তি।
যন্ত্রবাদের সমালােচনাঃ প্রাণের উৎপত্তিবিষয়ক মতবাদ হিসেবে যন্ত্রবাদ সন্তোষজনক মতবাদ নয়। নিচে যন্ত্রবাদের প্রধান আপণ্ডিগুলাে আলােচনা করা হলাে-
(১) যন্ত্রবাদে প্রাণের বৈশিষ্ট্য নেইঃ প্রাণের মধ্যে কতগুলাে বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান; যেমন- নির্বাচন, উদ্দেশ্য ও ক্ষমতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ, আত্মরক্ষা ইত্যাদি। প্রাণের এসব বৈশিষ্ট্য যন্ত্রের মাধ্যমে ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না।
(২) যন্ত্রবাদের ব্যাখ্যা অযৌক্তিকঃ যন্ত্রবাদীদের মতে, ভৌত রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় জীবনের উৎপত্তি হয়। কিন্তু জীবকোষে এমন কতগুলাে গুণ বর্তমান, যা ভৌত রাসায়নিক পদার্থ থেকে উৎপন্ন হতে পারে না। সুতরাং যন্ত্রবাদীদের ব্যাখ্যা অযৌক্তিক।
যন্ত্রবাদ ও প্রাণবাদের পার্থক্যঃ এতক্ষণ আমরা যন্ত্রবাদ এবং প্রাণবাদ আলােচনা করলাম, এখন আমরা এদের মধ্যকার পার্থক্য আলােচনা করব।
(১) যন্ত্র মানুষের সৃষ্টি আর প্রাণ প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় সৃষ্টি ও মানুষ বুদ্ধির সাহায্যে যন্ত্র আবিষ্কার করতে পারে। কিন্তু বুদ্ধির সাহায্যে জীব বা প্রাণ সৃষ্টি করতে পারে না। প্রাণ প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি হয়।
(২) যন্ত্র স্থানান্তরযােগ্য কিছু প্রাণ স্থানান্তরযােগ্য নয়ঃ যন্ত্রের বিভিন্ন অঙ্গ বিচ্ছিন্ন করে আবার যথাস্থানে লাগালে যন্ত্রটি আবার পূর্ণাঙ্গ হয়, কিন্তু প্রাণ বা জীবের কোকোনাে অংশ এভাবে লাগানাে বা স্থানান্তর করা যায় না।
(৩) যন্ত্র চালানাের জন্য চালকের দরকার, কিন্তু প্রাণ চালানাের জন্য চালকের দরকার নেই। কোনাে যন্ত্রকে চালাতে একজন চালক লাগবেই, চালকই ঐ যন্ত্রটিকে সঠিকভাবে চালাতে পারবে। কিন্তু প্রাণ চালাতে বাইরের কোনাে চালকের দরকার হয় না। প্রাণের চালক সে-ই যার প্রাণ আছে। প্রাণের কর্তাই প্রাণের চালক।
(৪) যন্ত্র উদ্দেশ্যহীন, প্রাণ উদ্দেশ্যপ্রণােদিত ও যন্ত্রের নিজস্ব কোনাে উদ্দেশ্য নেই, লক্ষ্য সম্পর্কে সচেতনতাও নেই। যন্ত্র অন্যের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু প্রাণের নিজস্ব উদ্দেশ্য আছে। প্রাণের বিভিন্ন অঙ্গের মাধ্যমে সে উদ্দেশ্য সাধন করে।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, প্রাণ এবং যন্ত্র আলাদা শক্তি। প্রাণের মধ্যে যন্ত্রের কোনাে অস্তিত্ব নেই, আবার যন্ত্রের মধ্যেও প্রাণের কোনাে অস্তিত্ব নেই। উভয়হ সম্পূর্ণ আলাদা।
0 মন্তব্যসমূহ