অনুভবের পূর্বতঃসিদ্ধ আকার হিসেবে কান্টের দেশ ও কাল সম্পর্কে আলােচনা কর


প্রশ্নঃ অনুভবের পূর্বতঃসিদ্ধ আকার হিসেবে কান্টের দেশ ও কাল সম্পর্কে আলােচনা কর।
অথবা, দেশ ও কালের স্বরূপ বিশ্লেষণ কর। কান্টের অভিমত ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন কর।

ভূমিকাঃ দর্শনের ইতিহাস পর্যালােচনা করলে দেখা যায় অষ্টাদশ শতকের স্বনামধন্য জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট (১৭২৪ -১৮০৪) দর্শনজগতের আলােড়ন সৃষ্টিকারী নাম। তার মতবাদগুলাের মধ্যে দেশ ও কাল সম্পর্কিত মতবাদ অন্যতম। কান্ট তার 'Critique of Pure Reason' গ্রন্থের 'Doctrine of Elements' অংশের Transcendental Aesthetic শিরােনামে দেশ ও কাল সম্পর্কে আলােচনা করেন। উক্ত অংশে তিনি দেশ ও কালকে অনুভবের পূর্বতঃসিদ্ধ আকার বলে প্রমাণ করেন। নিম্নে তার মতানুসারে দেশ-কালের ব্যাখ্যা দেওয়া হলাে-

দেশ ও কালের স্বরূপঃ সাধারণত দেশ বলতে বােঝায় বস্তুর পার্থিব আঁধারকে। এ দেশ আমাদের কাছে সর্বত্র বিস্তৃত এবং সীমাহীন বলে মনে হয়। কেননা আমরা যেদিকেই তাকাই না কেন অনন্তবিস্তৃত দেশকে চোখের সামনে দেখতে পাই। এ দেশের কোনাে সীমা নেই। কেননা দেশের যেখানে সীমা কল্পনা করা হয় সেখানেই আবার অনন্ত দেশ দেখা যায়। দেশই দেশের সীমা বলা যায়। দেশের আরও কতগুলাে বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাই; যেমন- দেশ সীমাহীন, দেশ ত্রিমাত্রাবিশিষ্ট, দেশ অনন্ত ও অখণ্ড, দেশ কতগুলাে বিন্দুর সমাবেশ। কালের স্বরূপ সম্পর্কে বলা যায়,কালের ধারণা সাধারণত ঘটনার পূর্বাপর সম্পর্ক থেকে জন্ম। এ জগতে নিয়ত ঘটনা ঘটে। কোনােটি পরে, আবার কখনও বা একত্রে। মনে হয় যেন কালও চলছে। বিভিন্ন বস্তুর মধ্যে পরিবর্তন ও গতি দেখা যায়। কালের সাহায্যেই আমরা বস্তুর এ গতি ও পরিবর্তন উপলব্ধি করি। কালেরও কিছু বৈশিষ্ট্য আমরা দেখতে পাই; যেমন- কাল অনাদি ও অনন্ত, কালের সংখ্যা মুহূর্ত, কালের প্রবাহ আছে, কাল ত্রিমাত্রাবিশিষ্ট নয়।

কান্টের জ্ঞানতত্ত্বের সূচনাপর্বঃ দর্শনে জ্ঞান উৎপত্তির ইতিহাস পর্যালােচনা করলে দেখা যায়, বুদ্ধিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদ তাদের নিজস্ব মতামত ও যুক্তি তুলে ধরে। বুদ্ধিবাদ অনুসারে একমাত্র বুদ্ধিই জ্ঞানেই উৎস। অন্য কোনাে উৎস থেকে আমরা জ্ঞান লাভ করতে পারি না। অপরপক্ষে, অভিজ্ঞতাবাদ অনুসারে, অভিজ্ঞতাই জ্ঞানের একমাত্র মাধ্যম। অন্য কোন মাধ্যম হতে আমরা জ্ঞান পাইনা। পক্ষান্তরে, বিচারবাদী দার্শনিক কান্ট এসে ঘােষণা করলেন যে, জ্ঞানের ক্ষেত্রে বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা উভয়ই প্রয়ােজন। কান্টের মতে, যথার্থ জ্ঞানের বৈশিষ্ট্য দুটি; যথা- সার্বিকতা ও অনিবার্যতা থাকতে হবে এবং জ্ঞানে নতুনত্ব থাকবে। বুদ্ধি দেয় জ্ঞানের সার্বিকতা ও অনিবার্যতা, আর অভিজ্ঞতা দেয় জ্ঞানে নতুনত্ব। তাই যথার্থ জ্ঞানের জন্য বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা উভয়ই প্রয়ােজন। এভাবে কান্ট বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতাবাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করেন। কান্টের মতে, যথার্থ জ্ঞানের দুটি পর্ব আছে। প্রথম পর্ব হলাে বাইরের জগৎ থেকে ইন্দ্রিয়পথে আগত তথ্য। আর দ্বিতীয় পর্ব হলাে মন দ্বারা সেই তথ্য গ্রহণ ও বিচার। প্রথম পর্বে বস্তুসত্তার জগৎ থেকে আমরা যে ইন্দ্রিয়ানুভব পাই সেগুলােকে সেভাবেই গ্রহণ করি না। সেগুলাের দেশ ও কাল নামক অনুভবের দু'টি আকারের মাধ্যমে গ্রহণ করি। যেকোনাে ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতাকে কেবল দৈশিক-কালিক মুহূর্তে সংগঠিত হতে হবে।

দেশ যে অনুভবের পূর্বতঃসিদ্ধ আকার তার তত্ত্ববিষয়ক যুক্তি-
প্রথমত, দেশ অভিজ্ঞতাপ্রসূত কোনাে ধারণা নয়। আমরা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে দেশ সম্পর্কে ধারণা পাই না। বরং দেশ সম্পর্কে পূর্বতঃসিদ্ধ ধারণা আছে বলেই অভিজ্ঞতা সম্ভব হয়। অবশ্য কান্ট সামগ্রিকতার বিরােধিতা করেছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- আমরা অনেকগুলাে বিড়াল দেখে ধারণা করি বিড়ালের চারটি পা আছে, এটা সামগ্রিক কারণ বা অভিজ্ঞতালব্ধ। কিন্তু দেশ অভিজ্ঞতালব্ধ নয়। আমরা সব সময়ই কোনাে বস্তুকে কোনাে স্থানে দেখি, আমাদের দেশবােধ আছেই বলেই বাইরের জগতের বস্তুর অবস্থিতি সম্পর্কে অনুভব সম্ভব। সুতরাং দেশ অভিজ্ঞতাপূর্ব।

দ্বিতীয়ত, দেশবােধ আছে বলেই বাহ্য পদার্থের অনুভব সম্ভব হয়। দেশ পূর্বতঃসিদ্ধ ধারণা, কারণ দেশের ধারণা অনিবার্য ধারণা এবং অনিবার্যতা অভিজ্ঞতাপূর্ব বা পূর্বতঃসিদ্ধ।

তৃতীয়ত, দেশ কোনাে সামান্য ধারণা নয়, একটি ইন্দ্রিয় অনুভব। কান্টের মতে, দেশের ধারণা অসীম। এর কোনাে সীমারেখা নেই। দেশকে অভিজ্ঞতায় জানা যায় না। অভিজ্ঞতায় জানতে হলে তাকে সসীম হতে হয়। কিন্তু দেশ অভিজ্ঞতাপূর্ব এবং অসীম বলে এটি মৌলিক।

দেশের অতীন্দ্রিয় ব্যাখ্যাঃ অতীন্দ্রিয় ব্যাখ্যায় কান্ট এটাই দেখাতে চেয়েছেন যে, দেশ যদি অভিজ্ঞতাপূর্ব না হতাে তবে অনেকগুলাে সংশয়াতীত সুনিশ্চিত বিজ্ঞান অসম্ভব হয়ে যেত। দেশ অভিজ্ঞতাপূর্ব বলেই সংশ্লেষণাত্মক পূর্বতঃসিদ্ধ বচন সম্ভব। জ্যামিতি হলাে একটা বিজ্ঞান যা দেশের ধর্মগুলােকে সংশ্লেষণাত্মকভাবে অথচ পূবর্তঃসিদ্ধরূপে নিরূপণ করে। সুতরাং দেশে কোনাে সামান্য ধারণা নয়, বরং এটি একটি ইন্দ্রিয়ানুভব। কারণ কোনাে সামান্য ধারণায় আমরা কখনাে কোনাে সংশ্লেষণাত্মক জ্ঞানকে পেতে পারি না। দেশবােধ ইন্দ্রিয় অনুভব বলেই দৈশিক বিধানপূর্ণ জ্যামিতি শাস্ত্র থেকে আমরা নতুন জ্ঞান লাভ করে থাকি।

দেশের ন্যায় কালও যে পূর্বতঃসিদ্ধ জ্ঞান তার তত্ত্বগত প্রমাণঃ দেশকে পূর্বতঃসিদ্ধ জ্ঞান হিসেবে দেখাতে গিয়ে কান্ট যে চারটি তত্ত্ববিদ্যাগত প্রমাণ ব্যবহার করেন, কালের ক্ষেত্রেও একই যুক্তি ব্যবহার করেন। যথা-

প্রথমত, কাল কোনাে অভিজ্ঞতাপ্রসূত প্রত্যয় বা সামান্য ধারণা নয়। কাল সম্পর্কে কোনাে পূর্বতঃসিদ্ধ জ্ঞান না থাকলে বাইরের জগৎবা মনের জগৎসম্পর্কে আমরা কোনাে অভিজ্ঞতা পাই না। প্রত্যেকটা ঘটনা একটা কালে ঘটে থাকে। অর্থাৎ ঘটনার সাথে দেশ ও কাল জড়িত।

দ্বিতীয়ত, কালও একটি অনিবার্য ধারণা। কাল বাহ্যজগতে বা মনােজগতে এমন কোনাে ঘটনা নেই যা কোনাে সময়ে ঘটে না। অর্থাৎ এমন কোনাে ঘটনা নেই যা আগে বা পরে বা একই সময়ে ঘটে না। কালের ধারণা সার্বিক ও অপরিহার্য বা অনিবার্য অর্থাৎ কাল অভিজ্ঞতাপূর্ব ধারণা।

তৃতীয়ত, কাল সামান্য জ্ঞানের বিষয় নয়। যুক্তির দ্বারা লভ্য সাধারণ প্রত্যয় নয়। দেশের মতাে একটি কালেরও বিষয়গত অস্তিত্ব আছে। বিভিন্ন কাল একটি অভিন্ন কালেরই অংশ। বিভিন্ন কালের ধারণা থেকে এক কালের ধারণা হয় না। এ ক্ষেত্রে কাল সামান্য ধারণা হয়ে যাবে। আমরা একই কালকে সীমিত করে নানা কালরূপে কল্পনা করি।

কালের অতীন্দ্রিয় ব্যাখ্যাঃ কালের অতীন্দ্রিয় ব্যাখ্যায় কান্ট এটাই দেখাতে চেয়েছেন যে কালের ধারণা পূর্বতঃসিদ্ধ না হলে কতকগুলাে সংশয়াতীত জ্ঞান (যেমন পাটিগণিত) অসম্ভব হয়ে যেত। কাল অভিজ্ঞতাপূর্ব বলেই গণিতের সংশ্লেষণাত্মক পূর্বতঃসিদ্ধ জ্ঞান সম্ভব। পাটিগণিত এমন একটি বিজ্ঞান যা কালের ধর্মগুলােকে সংশ্লেষণাত্মকভাবে অথচ পূর্বতঃসিদ্ধরূপে নিরূপণ করে। সুতরাং কাল কোনাে সামান্য ধারণা নয়, বরং এটি একটি ইন্দ্রিয়ানুভব।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, কান্ট দেশ-কাল সম্পর্কে যে অনুভবের পূর্বতঃসিদ্ধ মতবাদ দেন তা বিভিন্ন সমালােচনার সম্মুখীন হয়। তা সত্ত্বেও তিনি যে যুক্তিগুলাে দাঁড় করিয়েছেন তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। কেননা দেশ-কাল এমন একটি প্রত্যয় যা আমাদের বাস্তব জীবনের প্রতিটি স্থানে প্রতিটি কালে কাজে লাগে। সবশেষে কান্টের উক্ত মতবাদ অনুসারে বলা যায়, দেশ ও কাল স্বতন্ত্র কোনাে বাহ্য পদার্থ নয়, আমাদের ইন্দ্রিয়ানুভবের আকার; আর এ আকার হলাে সংবেদনের পূর্বতঃসিদ্ধ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক