প্রাণের লক্ষণসমূহ বর্ণনা কর। প্রাণের উৎপত্তি সম্পর্কিত মতবাদের মধ্যে তুমি কোন মতবাদটি সমর্থন কর?


প্রশ্নঃ প্রাণের লক্ষণসমূহ ব্যাখ্যা কর। প্রাণের উৎপত্তি সম্পর্কিত মতবাদের মধ্যে তুমি কোন মতবাদটি সমর্থন কর? আলােচনা কর।

অথবা, প্রাণের লক্ষণসমূহ বর্ণনা কর। প্রাণের উৎপত্তি সম্পর্কিত মতবাদের মধ্যে তুমি কোন মতবাদটি সমর্থন কর? ব্যাখ্যা কর।

ভূমিকাঃ সচরাচর আমরা যেসব বস্তু প্রত্যক্ষ করি তাদের তিন ভাগে ভাগ করতে পারি। এগুলাে হলাে- ১. নির্জীব বা প্রাণহীন যারা জড়, ২. সজীব বা যাদের প্রাণ আছে এবং ৩. জীবের মধ্যে যাদের চেতনা আছে অর্থাৎ যারা চেতনশীল প্রাণী অর্থাৎ মানুষ। প্রাণ বলতে আমরা এমন এক জীবনীশক্তিকে বুঝি, যার ফলে জীবের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের বিকাশ সাধন, ঐক্য স্থাপন, দেহের ক্ষয়পূরণ, পারিপার্শ্বিকের সাথে দেহের সামঞ্জস্য বিধান, দেহ থেকে দেহের উৎপাদন অর্থাৎ বংশবৃদ্ধিকরণ প্রভৃতি কাজ সাধিত হয়।

প্রাণবাদঃ প্রাণবাদ অনুসারে প্রাণ বা জীবন কোনাে প্রাণহীন জড় থেকে উৎপন্ন নয়। প্রাণ একটি অজড়ীয় শক্তি প্রাণশক্তি থেকেই এর উদ্ভব। প্রাণবাদীদের মতে, প্রাণ অনিবার্যভাবে জড় দেহকে আশ্রয় করে থাকলেও এটি স্বরূপগত জড় পদার্থ থেকে স্বতন্ত্র। প্রাণীর মধ্যে যে কর্মচঞ্চলতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা, আত্মবিশ্বাস ও বংশবৃদ্ধির ক্ষমতা পরিলক্ষিত হয় তা জড়ের মধ্যে নেই। কাজেই জড়শক্তির প্রকৃতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন গুণবিশিষ্ট প্রাণী বা জীবকে নিছক ভৌতিক ও রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যান্ত্রিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না। তারা বলেন, শরীরের ভেতরে প্রাণশক্তিনামক এক বিশেষ শক্তিবিদ্যমান যা জড়াতিরিক্ত। এই শক্তি থেকেই প্রাণের উৎপত্তি।

প্রাণের উৎপত্তি সম্পর্কিত মতবাদঃ প্রাণের উৎপত্তি সম্পর্কিত মতবাদের মধ্যে দুটি মতবাদ উল্লেখযােগ্য। যথা জড়বাদীদের মতবাদ এবং প্রাণবাদীদের মতবাদ। জড়বাদীদের মতবাদের নাম ‘অজীবজনি মতবাদ’ এবং প্রাণবাদীদের মতবাদ ‘জীবজনি মতবাদ'। নিম্নে এ দু'টি মতবাদ আলােচনা করা হলাে-

অজীবজনি মতবাদঃ জড়বাদীরা কেবল যান্ত্রিক কার্যকারণ সম্পর্ককে স্বীকার করেন। তাদের মতে, প্রাণ প্রাকৃতিক এবং রাসায়নিক শক্তির এক জটিল সমষ্টি। অজৈব পদার্থ থেকেই অভিব্যক্তির মাধ্যমে জীব বা জীবনের উৎপত্তি হয়েছে। কারণ হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন ইত্যাদিরাসায়নিক উপাদানের পরমাণুর আকস্মিক সংমিশ্রণেই জীবনের উৎপত্তি। প্রাথমিক আবির্ভাব আমরা পাই জীবকোষে। পরে অভিব্যক্তির মাধ্যমে জীবকোষ থেকে বিভিন্ন জাতের উদ্ভিদ ও প্রাণীর আবির্ভাব হয়। প্রাণশক্তি বা জীবনীশক্তি বলে আমরা স্বতন্ত্র শক্তির অস্তিত্ব পাই না। এ মতকে অজীবজনি মতবাদ বলে।

জড়বাদীরা মনে করেন, জগতের উৎপত্তির আদি উপাদান জড় পরমাণু। জড় পরমাণুর অন্ধগতির ফলে বিবর্তনের ধারায় জড়বস্তু প্রাণীদেহ সৃষ্টি হয়েছে। জড় ও প্রাণের মধ্যে গুণগত কোনাে পার্থক্য নেই। এরা একই জড় পদার্থের স্থুল ও সূক্ষ্ম অবস্থা মাত্র।

জীবজনি মতবাদঃ জীবজনি মতবাদীরা মনে করেন যে অজীবজনি মতবাদ সঠিক নয়। তাদের মতে, অজৈব পদার্থ থেকে জীবনের উৎপত্তি হতে পারে না। অজৈব পদার্থ ও জীবের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য আছে। জৈব পদার্থ হলাে সৃজনশীল এবং স্বনিয়ন্ত্রিত। সুতরাং জৈব পদার্থ থেকেই জীবনের উৎপত্তি হয়। এই মতবাদের নামই জীবজনি মতবাদ।

প্রাণবাদীরা হলেন এই জীবজনি মতবাদের ব্যাখ্যাকারী। বিজ্ঞানী ড. পাস্তুর ও ড. লিস্টার পরীক্ষণ পদ্ধতির মাধ্যমে প্রমাণ করেন যে, জীবন থেকেই জীবনের উৎপত্তি। তারা অজৈব পদার্থ থেকে জীবের উৎপত্তি সম্ভব কিনা এটা পরীক্ষা করার জন্য পানিকে সম্পূর্ণ জীবাণুমুক্ত করে বােতলে রেখে দেন বহুদিন রাখার পরও তাতে কোনাে জীবাণু দেখতে না পাওয়ায় তারা সিদ্ধান্ত নেন যে জীব থেকেই জীবাণুর উৎপত্তি।

যন্ত্রবাদ বা অজীবজনি মতবাদ এবং প্রাণবাদ বা জীবজনিবাদ মতবাদ ছাড়াও আর দু'টি মতবাদ প্রাণের উৎপত্তি সম্পর্কে ব্যাখ্যা করে। যথা-

(ক) উন্মেষবাদঃ আলেকজান্ডার, ফ্রয়েড, মর্গান, লুইস প্রমুখ উন্মেষবাদী দার্শনিক প্রাণশক্তির মৌলিকত্বে বিশ্বাস করেন। কিন্তু তাদের মতে, জড় থেকেই প্রাণের উৎপত্তি। জড় হলাে পৃথিবীর আদিমতম উপাদান। প্রাণ, মন এই জড় থেকে উদ্ভূত হয়েছে। জড় থেকে প্রাণের সৃষ্টির আর প্রাণ থেকে মনের সৃষ্টি। জড়, প্রাণ ও মন সত্তার তিনটি স্তর মাত্র। জীবন জড় থেকে উন্নততর এবং মন জীবন থেকে উন্নততর স্তর। বিবর্তন সৃজনশীল সমন্বয়ের মাধ্যমে চলছে। যার ফলে সর্বদা নতুন ক্রিয়া-প্রক্রিয়া বা নতুন সত্তার উদ্ভব হয়। জড় থেকে যদিও জীবনের উন্মেষ তবুও জীবন জড় নয়। জীবন একটি সম্পূর্ণ মৌলিক সত্তা। প্রাণ সম্পর্কে এ মতবাদই হচ্ছে উন্মেষবাদ।

(খ) সৃজনবাদঃ বিখ্যাত জীববিজ্ঞানী ও চিন্তানায়ক হেনরি বার্গসো তার সৃজনধর্মী মতবাদে বলেছেন, প্রাণপ্রবাহ হলাে একমাত্র সত্তা। এ প্রাণপ্রবাহ বা চরমতত্ত্ব স্থিতিশীল নয়, গতিশীল। প্রাণপ্রবাহ অখণ্ড ও অবিভাজ্য। এ প্রাণপ্রবাহ হচ্ছে বিশ্ব বিবর্তনের উৎস এবং এর ধর্ম বিবর্তনকে প্রেরণা জুগিয়ে এগিয়ে নেওয়া। তিনি প্রাণপ্রবাহকে কখনাে নিত্য বহমান কাল প্রবাহও বলেছেন। এই কালপ্রবাহে কোনাে ছেদ নেই, কোনাে বিরাম নেই। এখানে অতীত, বর্তমানে এসে আবার ভবিষ্যতের দিকে ছুটে চলেছে। চলাই হচ্ছে এর মূল ধর্ম বার্গসের মতে, জীবন বা প্রাণ জড়ের দ্বারা সৃষ্ট নয়। এটা জড়ের উন্মেষাত্মক কোনাে বস্তুও নয়। জড় হলাে প্রাণশূন্য মাত্র । প্রাণপ্রবাহ সৃজনধর্মী। প্রাণপ্রবাহ উদ্দেশ্যমূলক ও যান্ত্রিক নয়।

কোন মতটি সমর্থনযােগ্যঃ অজীবজনি ও জীবজনি মতবাদ দুটির মধ্যে জীবজনি মতবাদই যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়। কেননা বাস্তবে পরীক্ষার মাধ্যমে জীববিজ্ঞানী পাস্তুর ও লিস্টার প্রমাণ করেছেন যে, জীবাণুমুক্ত পানি থেকে জীবাণুর উৎপত্তি অসম্ভব। আমাদের অভিজ্ঞতায়ও দেখি যে, জীব থেকেই জীবনের উৎপত্তি। তা ছাড়া জড়ের গঠনবৈশিষ্ট্য এবং প্রাণীর গঠনবৈশিষ্ট্যের মধ্যে কোনাে মিল বা সাদৃশ্য নেই। অথচ এক জীবের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাথে অন্য জীবের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের যথেষ্ট সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। কাজেই উভয় মতবাদের মধ্যে আমরা জীবজনি মতবাদকেই গ্রহণযােগ্য মতবাদ বলে মনে করতে পারি।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, প্রাণ বা জীবন হলাে এক প্রকার সংগঠন শক্তি, যা দেহের সমস্ত ক্রিয়া-কর্ম নিয়ন্ত্রণ করে। কাজেই দেখা যাচ্ছে যে, জীবদেহ কেবল জড় পদার্থ নয় বরং জড়কে নিয়ন্ত্রণ করার শক্তিও তার আছে। এই শক্তিই প্রাণশক্তি, যা জড়ের গতিক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে। সুতরাং অজীবজনি মতবাদ ও জীবজনি মতবাদের মধ্যে জীবজনি মতবাদই সঠিক ও যুক্তিযুক্ত মতবাদ বলে মনে হয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক