আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’ রাজনৈতিক উপন্যাস কিনা তা আলােচনা কর


প্রশ্নঃ আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’ রাজনৈতিক উপন্যাস কিনা তা আলােচনা কর। 

অথবা, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’ উপন্যাসে যে রাজনৈতিক চিত্র অঙ্কিত হয়েছে তার স্বরূপ বিশ্লেষণ কর।

উত্তরঃ ষাটের দশকের অন্যতম বিশিষ্ট লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (১৯৪৩-১৯৯৭)। সে যুগটা ছিল প্রকৃত পক্ষে বাংলা সাহিত্যে নতুন রীতিকৌশল অভিযােজনার উদ্দাম প্রয়াসের যুগ। সাহিত্যে নতুন টেকনিক আনয়নে- কী ভাষায়, কী বাক্য ও শব্দ গঠনে কিংবা শৈলী ও ভঙ্গিতে, বিষয়ের সংবীক্ষণ ও উপস্থাপনায়, সর্বোপরি আত্মমগ্ন চেতনার স্বাক্ষর পরাবাস্তব প্রকাশে তৎকালীন প্রজন্মের কিছু তরুণ তাদের কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সেই প্রতিভাবান তরুণদের একজন। আখতারুজ্জামান ভিন্ন ধারায় হেঁটেছেন। তার লেখার ধরন থেকেই তা স্পষ্ট হয়। কল্পনার ইন্দ্রজাল আর ক্ষুরধার মেদহীন লেখা তাকে স্বাতন্ত্র দিয়েছে। তিনি রাজনীতি সচেতন একজন লেখক। তিনি সমসাময়িক কালের রাজনীতিকে এড়িয়ে চলতে পারেননি। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময়ের প্রেক্ষাপটে রচিত হয়েছে এই উপন্যাসটি। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধেও দুই বছর আগে বিপুল গণঅসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছিল। লেখকের কাছে তা আগের যে কোনাে আন্দোলনের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

এই উপন্যাসের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য এর মনােবিশ্লেষণ। ঊনসত্তর সালের প্রবল গণঅভ্যুত্থানের যারা প্রধান শক্তি ছিল, সেই শ্রমজীবী জনসাধারণ কীভাবে আন্দোলন পরবর্তী সময়টিতে প্রতারিত এবং বঞ্চিত হলাে, বামপন্থিদের দোদুল্যমানতা আর ভাঙ্গনের ফলে, জাতীয় মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে যথাযথভাবে ধারণ করতে না পারার কারণে অজস্র রক্তপাতের পরও রাজনীতির ময়দান থেকে তাদের পশ্চাদপসরণ ঘটলাে, আওয়ামী লীগ প্রধান শক্তি হয়ে উঠল, উপন্যাসের উপজীব্য সেই ঐতিহাসিক সময়টুটুই। ফলে এই উপন্যাসটি রাজনৈতিক উপন্যাস কি-না তা বিবেচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অন্যান্য যে কোন উপন্যাস থেকে রাজনৈতিক উপন্যাস লেখা অনেক কঠিন। রাজনৈতিক গল্পটা যদি বাস্তবতার সাথে মিল না থাকে তাহলে যেমন সমালােচনার খােরাক যোেগায় তেমনি কাল্পনিক হলে তা হারায় পাঠকের আগ্রহ। এদিক থেকে বিচার করলে আমরা দেখতে পাই এই উপন্যাসটি রাজনৈতিক ঘটনাবলির সাথে বাস্তবতার মিল রয়েছে। কেননা এ উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে ঊনসত্তরের উত্তাল দিনগুলাের কথা সেখানে আমরা দেখতে পাই, ১৯৬৯ সালের পূর্ব বাংলা। কী এক জীবনস্পর্শী মন্ত্রের মুখে বিস্ফোরিত চারদিক। কেঁপে ওঠে নগর ঢাকা। কাঁপে শহর, বন্দর গঞ্জ, নিভৃত গ্রাম, এমনকি যমুনার দুর্গম চর এলাকা। কখনাে কঠিন বুলেটের আঘাতে, কখনাে ঘুম ভেঙে দেওয়া আঁধির ঝাপটায়। মিটিং আর মিছিল আর গুলি বর্ষণ আর কারফু ভাঙা আর গণআদালত সব জায়গায় ফেটে পড়ে ক্ষোভ ও বিদ্রোহ। সব মানুষেরই হৃদয়ের অভিষেক ঘটে একটি অবিচল লক্ষ্যে। মুক্তি। মুক্তি? তার আসার পথও এক রকম নয়। কারাে স্লোগান, দিকে দিকে আগুন জ্বালাে, কারাে পদ্মা মেঘনা যমুনা।

১৯৬৭ সালের শেষে আইয়ুব সরকার পূর্ব বাংলার কয়েকজন সামরিক ও বেসামরিক চাকরিজীবীর নামে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার নামে একটি মামলা খাড়া করে। মাস দুয়েকের মধ্যেই আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানকেও এই মামলায় জড়ানাে হয় এবং তাকে মামলার এক নম্বর আসামি করা হয়। আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযােগ ছিল যে, তারা পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করে পূর্ব বাংলা নামে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। ১৯৬৮ সালের শুরুতে আগতলা ষড়যন্ত্র মামলার খবর প্রচারিত হওয়ার সাথে সাথে জনগণের সচেতনতা শতগুণে বৃদ্ধি পায়। শুরু হয় ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের চিলেকোঠার সেপাই- এ গণঅভ্যুত্থানের উপন্যাস।

ষাট সালের দিকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ও আন্দোলনের সাক্ষী ‘চিলেকোঠার সেপাই'। প্লট মূলত উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান। গল্পের প্রধান চরিত্র রঞ্জু ওরফে ওসমান, ওসমানের বন্ধু আনােয়ার আর আলতাফ। আছে রিকশা শ্রমিক বস্তি বাসিন্দা খিজির। আনােয়ার বামপন্থি আর আলতাফ ডানপন্থি। আনােয়ার আর আলতাফের কথােপকথনের মাধ্যমে লেখক অনেক জটিল রাজনৈতিক জটিলতাকে মুক্তি দিতে চেয়েছেন।

মিছিলে আবু তালেব নিহত। স্লোগান উঠছে- শহিদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না। ছাত্ররা শ্লোগান দিচ্ছে ওরা লাশ চায়। হাতিরপুলের পাওয়ার স্টেশনে কাজ করত আবু তালেব। মাওলানা ভাসানীর ডাকা স্ট্রাইকে মিছিলের মধ্যে পুলিশের গুলি চলে। স্বেচ্ছাচারী সরকারের গুলিতে নিহত আবু তালেবের লাশ উদ্ধারের জন্য এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কজন ছাত্র। এ ভাড়াটে বাড়িতে আবু তালেবের অর্থে সংসার চলত। লাশ পুলিশে প্রহরা দিচ্ছে। এ এলাকার মাতব্বর বাড়িওয়ালা রহমতউল্লাহ দ্রুত দাফন কাফনের কাজটা শেষ করতে চায়। দারােগা শান্ত-স্বরে বলে- আপনারা এডুকেটেড লােক, হাইয়েস্ট এডুকেশনাল ইনস্টিটিউটের ছাত্র। জানেন না মুর্দাকে ইজ্জত করতে হয়, মুর্দার সামনে হইচই করলে গাের আজাবের চেয়েও মুর্দা বেশি তকলিফ পায়। ওদিকে বটতলায় মিটিং চলে। বিকেল তিনটায় বায়তুল মােকাররমে জনসভা।

শেষাবধি পুলিশ ও রহমতউল্লাহ দ্রুত লাশ জুরাইন গােরস্থানে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করে। দারােগা ইতােমধ্যে সশস্ত্র। ছাত্ররা দল বেঁধে এসে পড়লে লাশ আটকানাে মুশকিল হবে। উপস্থিত দু’চার জন ছাত্রকে কোনােরকমে তারা সামলে রেখেছে। মুর্দার সাথে আপনাদের যাওয়ার দরকার নেই। আপনারা অনেক কষ্ট করলেন, এবার বাড়ি গিয়ে আরাম করেন। শেষাবধি পুলিশ ভ্যান জুরাইন মুখেই চলে আবু তালেবের লাশ নিয়ে। সাথে সাথে গুঞ্জন ওঠে- শহিদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না। আইয়ুব শাহী, জুলুম শাহী- ধ্বংস হােক, ধ্বংস হােক।

সারা পূর্ব পাকিস্তানে আবু তালেবের গায়েবানা জানাজা হয়। আমজাদিয়ায় আনােয়ার, আলতাফ, ইফতিখারদের সাথে ওসমানের সাক্ষাৎ হয়। ওরা সবাই রাজনীতির নানা মতাদর্শের পক্ষে বিপক্ষে অবস্থান নেয়। এর মাঝে মিছিল আসে। মিছিলের কিছু ছেলে হােটেলে ঢুকে আইয়ুবের ছবি নামিয়ে পা দিয়ে ভেঙে ফেলে, নানা স্লাং শব্দ ব্যবহার করে আইয়ুবের প্রতি। আনােয়ার বামপন্থি মধ্যবিত্ত টিপিক্যাল চরিত্র। শেখ সাহেবকে ছাড়া না ছাড়া নিয়ে তীব্র তর্ক বিতর্ক চলে। আনােয়ার গ্রামে গিয়েছিল। গ্রাম সম্পর্কে সে বলে যে গ্রামের লােক কনশাস হয়ে উঠেছে। গ্রামের যারা মাথা, কয়েক পুরুষ ধরে যারা বল খাটিয়ে এসেছে, কর্নার্ড হতে হতে তাদের এহেন অবস্থা হয়েছে যে, ঘাের মুসলিম লীগাররাও পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি চায়।

আনােয়ার কলেজের শিক্ষক। ঢাকার উত্তাল আন্দোলন ছেড়ে সে চলে যায় গ্রামে। গ্রামে বিডি মেম্বারদের দাপট। ভূমিহীন, বর্গাচাষিদের গরু অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয় ডাকাত মারা চরে। আইয়ুবের বেসিক ডেমােক্রেসি বা ভােটার রাইট এরা কেউ বুঝে না। শুধু জানে খয়বার গাজীর সহকর্মী হােসেন মিয়ার তত্ত্বাবধানে আইয়ুবের ফুলমার্কা এক রাত্রের অর্থের বিনিময়ে জয়লাভ করেছে। এখন সে প্রভাবে মিলিটারি প্রশাসন পূর্ণাঙ্গভাবে তাদের এক্তিয়ারে। কৃষকেরা তাদের সমস্যা নিয়ে সংঘবদ্ধভাবে দেন দরবার করতে চাইলে তাদের মাথায় ও পিঠে পুলিশের লাঠি পড়েছে। শ্রেণি বৈষম্য ভাঙতে আনােয়ার বদ্ধপরিকর। আফসার গাজী, খয়বার গাজী, হােসেন আলী নামক শােষক মহাজনদের হাতে জিম্মি খেটে খাওয়া। যমুনা পাড়ের সাধারণ মানুষদের মুক্তি দেওয়া তার প্রধান উদ্দেশ্য। আফসার গাজী, খয়বার গাজীরা লতায় পাতায়। আনােয়ারের আত্মীয় হলেও সে তারে ক্ষমা করতে রাজি নয়। কিন্তু না, শেষ পর্যন্ত তা আর হয়ে ওঠে না। শহরের রাজনৈতিক হাওয়া গ্রামে লাগলে পাল্টে যায় সবকিছু। যে মহাজনদের গ্রামের মানুষ শাস্তি দিতে চেয়েছিল, আলীবক্স আর আনােয়ারের দাপটে মহাজনদের অবস্থা যখন নড়বড়ে তখন সেই মহাজনেরাই নতুন রাজনৈতিক হাওয়ায় ফিরে আসে আগের অবস্থানে। সাধারণ মানুষের ভাগ্যের কোনাে পরিবর্তন হয় না।

এদিকে শহরভিত্তিক আন্দোলন বাড়তে থাকে। আইয়ুবের রাজনৈতিক আত্মজীবনী পাকিস্তানি পতাকা পােডানাে হয়। আগরতলা মামলা সাজিয়ে আইয়ুব খান বাঙালি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের পেছনে সিভিল সার্ভিস, আর্মি, নেভি, এয়ার ফোর্সের লােকজন সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে বাধ্য করেছে।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি শিক্ষক ডা. শামসুজ্জোহা, ছাত্রনেতা আসাদের মৃত্যুতে রাজপথ প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। তীব্র অগ্নিসংযােগ শুরু হয় সরকারি প্রতিষ্ঠানে। কারফিউ জারি করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করা হয়। শহর নগর বন্দর সর্বত্র এর রােষ ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয় খিজিরের। আন্দোলনের মুখে অবশেষে সামরিক ডিকটেটর বাধ্য হয় শেখ মজিবর রহমানকে মুক্তি দিতে। কয়েক লক্ষ মানুষ মিটিং শেষ করে ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার মানুষ একতাবদ্ধ, বিপরীতে সামরিক ডিকটেটরদের বিরুদ্ধে বিস্ফোরিত। আনােয়ারের গ্রামে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এর কার্যক্রম লক্ষগােচর হয়। আলিবক্সরা রাজনীতির বাইরে শ্রেণিশত্রু নিধনের কাজে মনোেযােগী হয়। খয়বার গাজীর আদালত নিয়ে ব্যস্ত। মধ্যবিত্তের রাজনীতির আস্ফালনে কৃষক সমাজ নিজের ভাগ্যোন্নয়নের দিশা পায় না।

আলিবক্স শুনতে পায় পদুমশহর স্কুলের মাঠে, চন্দনদহে মিটিং হচ্ছে। শহরে পড়ুয়া ছাত্ররা অনেকেই গ্রামে এসেছে। বৈরাগীর ভিটায় মাইকে বক্তৃতা করে আনােয়ারের মামা (ইয়াসিন মামা)। এক পর্যায়ে শােনা যায় আলিবক্সদের হাত থেকে পালানাে জুলুমবাজ আফসার গাজী ঐসব মিটিং এর পৃষ্ঠপােষক। মৌলিক গণতন্ত্রীদের মুখে এখন গণতন্ত্রের গালভরা বুলি, জনকল্যাণের কথা। গণআদালত থেকে পালানাে গাজী, আফসার গাজীরা বগুড়ায় তাদের আত্মীয়স্বজন নিয়ে আবার একত্রিত। গণতন্ত্রী সেজে স্কুল ছাত্রদের পৃষ্ঠপােষকতা দিয়ে সরকার বিরােধী আন্দোলন করছে ওদের ওপর এখন বুর্জোয়া গণতন্ত্রের ছায়া। একদিন যে শ্রেণিশক্তি তাদের ওপর ফুসে উঠেছিল। তাদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত ব্যবস্থা হিসেবে চেংটুর লাশ পাওয়া যায় চন্দনদহের ধান খেতে।

অন্যদিকে, কেন্দ্রীয় চরিত্র ওসমান কোনাে আন্দোলনে তেমন নেই। কিন্তু সে দিন-রাত্রি স্বাধীনতা আর মুক্তি নিয়ে ভাবে। আন্দোলনে রাস্তায় বের হওয়া মানুষ দেখলে সে যেন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ওসমান ভাবতে থাকে…..

বাংলা বাজার, তাঁতি বাজারের মানুষ সুপ্ত-খালের হিম হৃদপিণ্ড থেকে উঠে এসেছে? ঐ তাে ইব্রাহীম খাঁর আমলে শাহজাদা খসরুর সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত পাগড়ি পরা সেপাইরা । শায়েস্তা খার টাকায় আট মণ চালের আমলে না খেয়ে মরা মানুষ দেখে ওসমান আঁতকে ওঠে। ৩০০ বছর ধরে তাদের খাওয়া নাই, কেউ চুলের তরঙ্গ উড়িয়ে তারা এগিয়ে চলে পায়ে পায়ে। মুঘলের হাতে মার খাওয়া, কোম্পানির বেনেদের হাতে মার খাওয়া-সব মানুষ না এলে মিছিল কি এত বড়াে শােষণ থেকে মুক্তির সুরাহা দিয়েছে লেখক ওসমানের চিন্তার মাধ্যমে তা দেখিয়েছেন। আরােপ করা সামরিক শাসনের নির্যাতনে বন্ধুরা যখন বিহ্বল, ওসমানের ডানায় তখন লাগে প্রবল বেগ। সহনামী কিশােরকে সে চুম্বনে রক্তাক্ত করে বিকৃত যৌনতার বশে নয়, আত্মপ্রেমে পরাজিত হয়ে। ওসমান একজন। সে এক নার্সিসাস। কিন্তু এখানে তার শেষ নয়। নিজের খাচা থেকে বেরুবার জন্য তার ডানা ঝাপটানাে পরিণত হয় প্রচণ্ড ক্রোধে। রঞ্জুকে ছাদ থেকে নিচে ফেলে দেওয়ার জন্য সে প্রাণান্ত উদ্যোগ্ন নেয়। এ কি তার আত্মপ্রেম বিসর্জনের প্রস্তুতি? পরিচিত সবাই ওসমানকে চিহ্নিত করে বদ্ধ পাগল হিসেবে। অনুরাগী বন্ধুরা তাকে বন্দি করে রাখে নিজের ঘরে। এখন এই বিচ্ছিন্ন ঘর থেকে ওসমানকে উদ্ধার করতে পারে কে। এক নেতায় বিশ্বাসী আলাউদ্দিন? ভােটের রাইট প্রার্থী আলতাফ? রাজনৈতিক বিশ্লেষক বামপন্থি আনােয়ার? এরা কেউ নয়। চিলেকোঠার দুর্গ থেকে ওসমানকে বেরিয়ে পড়তে প্ররােচনা দেয় হাড্ডি খিজির যে নিজের বাপের নাম জানে, যে বড়াে হয়েছে রাস্তায় রাস্তায়, যার মা বৌ দুজনেই মহাজনের ভােগ্য এবং গণঅভ্যুত্থানের সদস্য হওয়ার অপরাধে মধ্যরাতে কারফু চাপা রাস্তায় যে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হয় মিলিটারির হাতে। নিহত খিজিরের আমন্ত্রণে সক্রিয় সাড়া দিয়ে ওসমান ঘরের তালা ভাঙে। সবার অগােচরে সে বেরিয়ে আসে রাস্তায়, কারফুর দাফট অগ্রাহ্য করে। তার সামনে এখন অজস্র পথ। পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ সব দিকেই পা বাড়ায় সেদিকেই পূর্ব বাংলা। একসময় শিজোফ্রেনিয়াতে আক্রান্ত হয় ওসমান। স্বাধীনতার নেশাই হয়তাে তাকে পাগল করে ফেলে।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের চিলেকোঠার সেপাই জন্মপূর্ব বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তির দলিল। রাজনৈতিক চেতনা উপন্যাসটির বহির্বাস্তব হলেও সমান মর্যাদা ও গুরুত্ব নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে এর অন্তকাঠামাে। চরিত্রগুলাে মনস্তত্তে, স্পন্দনশীল ঘটনার পারম্পর্যে এক অনিবার্য গতিতে উত্তেজনায় পাঠকের কাছে পৌছে যায়। প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি আধুনিক সময়ের মানুষের আর্থসামাজিক পরিপ্রেক্ষিতকে বদলে দিয়েছে। রাজনীতির দাপট তখন সর্বত্র। দেশ ও জাতি যে ক্রান্তিলগ্নের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলেছে, পাকিস্তান আমলের জাতিগত শশাষণ বা সামরিক শােষণ বা স্বাধীনােত্তর বাংলাদেশে পুনরায় সামরিক শাসন, গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে সামরিকতন্ত্র ও কায়েমি স্বার্থবাদের আধিপত্য এ সবই একজন লেখকের সমাজ ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ হওয়ার দাবি জানিয়েছে। এজন্য লেখক উপন্যাসের বিষয়বস্তু হিসেবে বেছে নিয়েছেন রাজনীতি। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের চিলেকোঠার সেপাই রাজনৈতিক চেতনারই প্রতিরূপ, নিঃসন্দেহে।

পরিশেষে বলা যায় যে, ‘চিলেকোঠার সেপাই' বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়কে প্রেক্ষাপট হিসেবে নিয়ে রচিত হয়েছে। এ সময় রাজনৈতিক অঙ্গন ছিল উত্তাল। সেই উত্তাল রাজনৈতিক সময়কে লেখক এড়িয়ে যেতে পারেননি। তৎকালীন রাজনীতির বিশ্লেষণ উঠে এসেছে এই উপন্যাসের বিভিন্ন চরিত্রের মনােবিশ্লেষণের মাধ্যমে। ফলে, আপাততদৃষ্টিতে এই উপন্যাসটিকে রাজনৈতিক উপন্যাস মনে হতে পারে কিন্তু লেখক রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য এ উপন্যাসটি লেখেননি। আসলে ‘চিলেকোঠার সেপাই’ ইতিহাস নয়, উপন্যাস। বাংলা ভাষার গুটিকয় সফল উপন্যাসের মধ্যে অন্যতম একটি উপন্যাস। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাসের জন্য আমাদের দ্বারস্থ হতে হয় সেই ‘চিলেকোঠার সেপাই'-এর কাছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক