নবী করীম (স)-এর শাসনব্যবস্থার বিবরণ দাও


প্রশ্নঃ নবী করীম (স)-এর শাসনব্যবস্থার বিবরণ দাও।

উপস্থাপনাঃ মহানবী (স) সর্বকালের ও সর্বযুগের শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে স্বীকৃত। তার প্রতিষ্ঠিত ইসলামী প্রজাতন্ত্র মদিনা ছিল সর্বোত্তম জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র। তিনি গােত্রীয় কলহে শতধাবিভক্ত একটি জাতিকে সুশৃঙ্খল ও সুসংবদ্ধ জাতিতে পরিণত করে বিশ্বের ইতিহাসে অমর অম্লান হয়ে আছেন।

মহানবী (স)-এর শাসনব্যবস্থাঃ মহানবী (স)-এর রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা কুরআনের আলােকেই প্রণীত। তার শাসনকালে মদিনার রাষ্ট্রীয় সংহতি, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, জানমালের নিরাপত্তা ছিল, সর্বকালের জন্য উপমাস্বরূপ। নিম্নে মহানবী (স)-এর শাসনব্যবস্থার বিস্তারিত বিবরণ আলােচনা করা হলাে-

১. মহানবী (স)-এর শাসননীতিঃ মহানবী (স) প্রতিষ্ঠিত মদিনা রাষ্ট্র ছিল মানব জাতির ইতিহাসের সর্বোত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। আইনের চোখে মদিনার সকল নাগরিকের সমান অধিকার স্বীকৃত ছিল। এ রাষ্ট্রে কারাে জন্য গােত্র বর্ণভেদে কোনাে বিশেষ সুবিধা বা অধিকার সংরক্ষিত ছিল না। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক হিট্টি বলেন- Thus by one stroke the most vital bond of Arab relationship, that of tribal kingship, was replaced by new bond, that of faith.

২. শূরা-ই নিযাম প্রতিষ্ঠাঃ মহানবী (স) শূরা-ই নিযাম বা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পথিকৃৎ। তিনি পরামর্শভিত্তিক শাসনকার্য পরিচালনার রীতি প্রবর্তন করেন।

৩. সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থার প্রবর্তনঃ মহানবী (স) মদিনা রাষ্ট্রে শাসক ও শাসিতের মধ্যে প্রভেদ দূরীভূত করে আল্লাহ প্রদত্ত বিধানের ভিত্তিতে এক চমৎকার শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করেন।

৪. মহানবী (স)-এর রাষ্ট্রীয় শাসন কাঠামােঃ মদিনা রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা গড়ে ওঠে ইসলামী সমাজের প্রকৃতি, কর্মসূচি, ঐতিহ্য ও বৈশিষ্ট্যের প্রেক্ষিতে। মদিনা রাষ্ট্রের শাসন কাঠামােয় যে সকল সাহাবী দায়িত্ব পালনরত ছিলেন, তারা মহানবী (স) কর্তৃক বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। শাসনকার্য পরিচালনা ব্যতীত রাজকর্মচারী নিয়ােগ, বদলি, জিযিয়া আদায়, করনীতি প্রণয়ন, বিদেশী দূত বা আগন্তুকদের দেখাশােনা প্রভৃতি কাজ তিনি নিজেই করতেন।

৫. মহানবী (স)-এর কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থাঃ মহানবী (স) একজন প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ হিসেবে আরবের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক বিরাট পরিবর্তনের সূচনা করে মদিনা সনদের মাধ্যমে মদিনা রাষ্ট্রের গােড়াপত্তন করেন। তিনি বহুধাবিভক্ত আরববাসীকে এককেন্দ্রিক ইসলামী শাসনের আওতায় এনে একটি কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার প্রচলন করেন। শাসনব্যবস্থার শীর্ষে ছিলেন স্বয়ং রাসূল (স) তার সরাসরি নিয়ন্ত্রণে শাসনকার্যের সাথে জড়িত বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্বশীলগণ পরিচালিত হতেন।

৬. প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনঃ মহানবী (স) সমগ্র আরবে শাসনব্যবস্থা সুদৃঢ় করার জন্য মদিনা রাষ্ট্রের আওতাধীন মদিনা, খায়বার, মক্কা, তায়েফ, তায়ামা, বাহরাইন প্রভৃতি অঞ্চলকে কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত করেন। প্রতিটি প্রদেশে শাসনকার্য পরিচালনা করার জন্য তিনি একজন করে ওয়ালী বা প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিযুক্ত করতেন। মদিনা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহের প্রশাসনিক দিক তিনি নিজেই দেখাশােনা করতেন।

৭. স্থানীয় শাসনব্যবস্থাঃ প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা ছাড়াও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঞ্চল বা বড় বড় গােত্রের ওপর স্থানীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছিল। স্থানীয় প্রশাসককে ‘আমেল’ বলা হতাে। মদিনা রাষ্ট্রে এরূপ ২২টি স্থানীয় শাসনাধীন অঞ্চল বা গােত্র ছিল।

৮. মদিনার অর্থ বিভাগঃ মহানবী (স) মদিনা রাষ্ট্রের জন্য একটি সমৃদ্ধ অর্থ ব্যবস্থা গড়ে তােলেন। মদিনার কেন্দ্রীয় অর্থভাণ্ডার বায়তুল মাল নামে পরিচিত ছিল। মহানবী (স) নিজেই এ বিভাগ নিয়ন্ত্রণ করতেন। বায়তুল মালের আয়ের উৎস ছিল প্রধানত ৫টি। যথা- (১) গনীমত বা যুদ্ধলব্ধ সম্পদ, (২) খারাজ বা ভূমিকর, (৩) যাকাত ও সদকা, (৪) জিযিয়া কর, (৫) ওশর বা উৎপাদিত ফসলের ১/১০ অংশ।

উপসংহারঃ মহানবী (স) ছিলেন নিঃসন্দেহে বিশ্ব ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম শাসক। ধর্মীয় চেতনা ও সামাজিক মূল্যবােধের ভিত্তিতে তার প্রতিষ্ঠিত মদিনা রাষ্ট্র ছিল বিশ্বের সর্বকালের সকল রাষ্ট্র থেকে শ্রেষ্ঠ। মানবীয় সংস্কার ও সফলতার যতগুলাে মাপকাঠি আছে তা দিয়ে তুলনা করলে কোনাে লােকই তার সমান কৃতিত্ববান বলে দাবি করতে পারবে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক