অথবা, জগতের উৎপত্তি বিষয়ক মতবাদ হিসেবে সৃষ্টিবাদ সমালােচনাসহ ব্যাখ্যা কর।
ভূমিকাঃ এ বিশ্বজগতের যাবতীয় বস্তু নিয়ে কোনাে উদ্দেশ্যময় সত্তার সৃষ্টি না প্রাকৃতিক শক্তির স্বাভাবিক পরিণতি এ বিষয়ে যে মতবাদগুলাে ওঠে আসে সেগুলাের মধ্যে সৃষ্টিবাদ অন্যতম। সৃষ্টিবাদ অনুসারে স্রষ্টা তার নিজ উদ্দেশ্যসাধনের জন্য কোনাে এক সময় এ জগতকে সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টিবাদ জগতের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশে এক পরম সচেতন আধ্যাত্মিক সত্তায় বিশ্বাস করে। এ মতবাদ অনুসারে পরমসত্তার উদ্দেশ্য পূর্ণ করার জন্যই জগতের সৃষ্টি।
সৃষ্টিবাদঃ সৃষ্টিবাদের মূলকথা হলাে কোনাে এক বিশেষ মুহূর্তে ঈশ্বরের সৃষ্টির ইচ্ছার রূপায়ণ হিসেবে এ বিশ্বজগতের সৃষ্টি। এই মতবাদ অনুসারে বিশ্বজগত সৃষ্টির সাথে সাথে বস্তু ও জীবসহ সবকিছু সৃষ্টি হয়ে থাকে। অর্থাৎ সব সৃষ্টিসহ বিশ্বজগৎ সৃষ্টির সময় যেমন ছিল বর্তমানেও তেমন আছে। মূলত এদের মধ্যে কোনাে পরিবর্তন সাধিত হয়নি। সাধারণত ধর্মবিশ্বাসী লােকেরা ঈশ্বরকে জগতের স্রষ্টা বলে মনে করেন। সৃষ্টিবাদীরা ঈশ্বরকে অনাদী, অনন্ত, সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ ও সর্বগুণে গুণান্বিত মনে করেন। তাদের মতে ঈশ্বরের কোনাে অভাব অভিযােগ বা কোনাে ধরনের সীমাবদ্ধতা নেই। কিন্তু তবুও কোনাে এক বিশেষ মুহূর্তে ইচ্ছার বশীভূত হয়ে তিনি নিজ ক্ষমতাবলেই এ জগত সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টিবাদ দুই ধরনের হয়ে থাকে। যথা-
(১) সাপেক্ষ সৃষ্টিবাদঃ সাপেক্ষ সৃষ্টিবাদ অনুসারে ঈশ্বর পূর্ব থেকেই বর্তমান উপকরণাদি বা জড় থেকে এ জগত সৃষ্টি করেছেন। এই পূর্ববস্থিত উপকরণগুলাে বিশৃংখল অবস্থায় ছিল। তিনি এদেরকে সুশৃংখল করে একটা সামগ্রিক পৃথিবী গড়ে তুলেছেন। এই মতবাদ অনুসারে ঈশ্বরকে একজন স্থপতি বা একজন প্রকৌশলী বলা চলে। এই মতবাদ ধর্ম দ্বারা সমর্থিত নয়। কিন্তু দর্শন দ্বারা সমর্থিত। দার্শনিক প্লেটো এ মতবাদ সমর্থন করেন। তার মতে ঈশ্বর জড় থেকে জগত সৃষ্টি করেছেন। শাশ্বত ধারণার অনুকরণে জড়পিণ্ড থেকে জাগতিক বস্তুর সৃষ্ট হয়ে থাকে। প্লেটো তার ধারণাবাদে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনা করেছেন। দার্শনিক মার্টিনিউ এ মতবাদের সমর্থন করেন। তিনি সাপেক্ষ সৃষ্টিবাদের বেশ কিছু বৈশিষ্টের কথা উল্লেখ করেন। তা হলাে-
প্রথমতঃ জগত সৃষ্টির পূর্বেই স্রষ্টা অস্তিত্বশীল ছিলেন। ঈশ্বর কোনাে এক নির্দিষ্ট সময়ে জগত সৃষ্টি করেছেন। এ জগত কাল ক্রমে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। কিন্তু স্রষ্টা জগতের আদিকারণ হিসেবে অস্তিত্বশীল থাকবেন।
দ্বিতীয়তঃ জগতের আদিকারণ হলেন ঈশ্বর। জগত সৃষ্টির পর থেকেই আজ পর্যন্ত জগতের স্রষ্টা কর্তৃক প্রদত্ত নিয়ম কার্যকর রয়েছে। এসব নিয়মকে মার্টিনিউ গৌণ নিয়ম বলে আখ্যায়িত করেছেন।
তৃতীয়তঃ স্রষ্টা জগত সৃষ্টির পর জগত থেকে বাইরে অবস্থান করেন। তবে প্রয়ােজনে জাগতিক নিয়মে তিনি হস্তক্ষেপ করেন। জগতের ওপর স্রষ্টার এ ধরনের হস্তাক্ষেপকে স্বর্গীয় হস্তক্ষেপ বলে আখ্যায়িত করা হয়।
চতুর্থতঃ মার্টিনিউ এর মতে, স্রষ্টা জগতের অভ্যন্তরে নয় বরং জগতের বাইরে অবস্থান করেন।
(২) নিরপেক্ষ সৃষ্টিবাদঃ এ মতবাদ অনুযায়ী ঈশ্বর নিছক শূন্য থেকে আপন দৈব শক্তির প্রভাবে জগত সৃষ্টি করেছেন। এই মতবাদের সমর্থনকারীরা বলেন, যেহেতু ঈশ্বর এক পরিপূর্ণ সত্তা সেহেতু তার ইচ্ছার অসাধ্য কিছুই নেই। তাই শূন্য থেকে এ জগত সৃষ্টি করা তার পক্ষে কঠিন কিছু নয়। তিনি ইচ্ছা করলেন জগত সৃষ্টি হােক, সাথে সাথে জগতের সৃষ্টি হলাে। ঈশ্বরের কোনাে অভাব নেই, তার এই জগতের প্রয়ােজন ছিল না তবুও তিনি জীবের ওপর দয়ার পরশ হয়ে তার আশীর্বাদ বিতরণের জন্য এ জগত সৃষ্টি করলেন। জগত সৃষ্টি হওয়ার পর জগতকে ঈশ্বর তার সৃষ্ট প্রাকৃতিক শক্তির দ্বারা জগত নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হতে থাকল। এই জগতের মুখ্য বা প্রথম কারণ হলেন ঈশ্বর। এবং গৌণ বা দ্বিতীয় কারণ হলাে প্রাকৃতিক শক্তিগুলাে। ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টি হওয়ার পর জগতের বাইরে অবস্থান করেন এবং কেবলমাত্র প্রয়ােজন হলেই জগতের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে থাকেন। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট সমর্থন রয়েছে। এ মতবাদ অনুসারে ঈশ্বর এক পরিপূর্ণ সত্তা হওয়ায় তার অসাধ্য বলে কিছুই নেই। তাই জগতকে শূন্য থেকে সৃষ্টি করা তার পক্ষে অসম্ভ নয়। দার্শনিক মার্টিনিউ ছিলেন এ মতবাদের একজন একনিষ্ঠ সমর্থক।
সৃষ্টিবাদের বৈশিষ্ট্যঃ সৃষ্টিবাদ তথা সাপেক্ষ ও নিরপেক্ষ সৃষ্টিবাদ বিশ্লেষণ করলে কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট দেখতে পাওয়া যায়। যথা-
প্রথমতঃ জগত স্রষ্টা বা ঈশ্বর কোনাে নির্দিষ্ট সময়ে জগত সৃষ্টি করেছেন।
দ্বিতীয়তঃ জগত সৃষ্টি হলাে মুহুর্তের মধ্যে সীমিত একটি আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়া।
তৃতীয়তঃ জগত সৃষ্টির পর জগত স্রষ্টার পূর্বানির্ধারিত পরিকল্পনা অনুসারে জগত চলতে থাকে তবে জগতে বিশৃংখলা দেখা দিলে ঈশ্বর প্রয়ােজনানুসারে জাগতিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারেন।
চতুর্থতঃ ঈশ্বর বহুকাল একাকী ছিলেন। তখন জগত বলে কিছুই ছিল না এবং জগতের কোনাে প্রয়ােজনও তখন ছিল না।
সমালােচনাঃ সৃষ্টিতত্ত্ব ধর্মীয় অনুভূতির সাথে সংগতিপূর্ণ হলেও এটি বিভিন্নভাবে সমালােচিত হয়েছে। নিম্নে তা সবিস্তারে আলােচনা করা হলাে-
(১) ঈশ্বরের পূর্ণতাকে খর্ব করেঃ এ মতবাদ অনুসারে কিন্তু পূর্ণপুরুষের কোনাে অভাব থাকতে পারে। আর সে হিসেবে ঈশ্বর কি হিসেবে জগত সৃষ্ট করলেন তার সঠিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না।
(২) দ্বৈতবাদের সৃষ্টিরঃ শূন্য থেকে জগতের সৃষ্টি যুক্তিসংগত নয়। কেননা শূন্য থেকে শূন্যেরই সৃষ্টি হয়। আবার জড় থেকে ঈশ্বর জগত সৃষ্টি করলে জড়ের অস্তিত্ব ঈশ্বরকে সীমিত করে। ফলে ঈশ্বরের অসীম ও অনন্ত শাক্তর হানি ঘটে। তাই ঈশ্বরের অস্তিত্বের সাথে পুর্বৈ অবস্থিত জড়ের অস্তিত্ব স্বীকার করলে দ্বৈতবাদের উদ্ভব ঘটে।
(৩) যুক্তির পরিবর্তে বিশ্বাসের গুরুত্বঃ এ মতবাদ অনুসারে যুক্তির ওপর গুরুত্ব না দিয়ে বিশ্বাসের ওপর অধিক গুরুত্ব দেয়, সৃষ্টিবাদ যুক্তির পরিবর্তে বিশ্বাসের মতবাদ বলে এটি যুক্তিসম্পন্ন মানুষের স্পৃহাকে মেটাতে পারে না।
(৪) স্রষ্টাকে প্রকৌশলীতে রূপান্তরিত করেঃ সৃষ্টিবাদ জগতের উৎপত্তি সম্পর্কে যে মতবাদ প্রদান করেছে তাতে ঈশ্বরকে একজন সাধারণ শিল্পে বা প্রকৌশলীতে রূপান্তর করে। কিন্তু ঈশ্বর কোনাে সাধারণ প্রকৌশলী হতে পারেন না।
(৫) ঈশ্বরকে সসীম সত্তায় রূপান্তরিত করেঃ সৃষ্টি তত্ত্ব অনুসারে জগতে বিশৃংখলা দেখা দিলে ঈশ্বর প্রয়ােজনে জাগতিক ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারেন। কিন্তু আমরা ঈশ্বরকে সর্বজ্ঞ পূর্ণসত্তা বলেই জানি। তিনি যদি সর্বজ্ঞ হন তবে তার সৃষ্ট জগতে বিশৃংখলা দেখা দিবে কেন?
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায়, সৃষ্টিবাদের কিছু ত্রুটি থাকলেও এর গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। তাদের মতে, ঈশ্বর কোনাে এক সময়ে নিজের উদ্দেশ্যসাধনের জন্য জগত সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টির সময় জগত যেরকম ছিল বর্তমানেও তাই আছে। সৃষ্টিবাদ জগতের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের ক্ষেত্রে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে স্বীকার করে তাদের মতাদর্শকে প্রচলিত ধর্মীয় বিশ্বাসের কাছাকাছি নিয়েছে এ সাধারণ মানুষের কাছে বােধগম্য করে তুলেছে।
0 মন্তব্যসমূহ