অথবা, যন্ত্র কী? জীবদেহ ও যন্ত্রের মধ্যকার সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যগুলাে তুলে ধর।
ভূমিকাঃ প্রাণবাদের আবির্ভাব পৃথিবীর একটি বিস্ময়কর ঘটনা। প্রাণের স্বরূপ ব্যাখ্যা করার জন্য দর্শনের ইতিহাসে যে কয়টি প্রত্যয় অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে আলােচিত হয়ে থাকে যন্ত্র সেগুলাের মধ্যে অন্যতম। সাধারণভাবে যন্ত্র বলতে শক্তি দ্বারা চালিত এবং বিভিন্ন জড় অংশের সমন্বয়ে কোনাে বস্তুকে বােঝায়। যার নিজস্ব কোনাে উদ্দেশ্য না থাকলেও মানুষের উদ্দেশ্যসাধনের ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ যন্ত্র মানুষের উদ্দেশ্যসাধনের জন্য মানুষ কর্তৃক কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট কোনাে জড়বস্তু বিশেষ।
যন্ত্রের সংজ্ঞাঃ যন্ত্র কথাটি মনে করলে মনে ভেসে ওঠে কতকগুলাে অংশের সমষ্টি, যাদের আকার, আয়তন ও অবস্থানের দিক দিয়ে এমনভাবে খাপখাওয়ানাে হয়েছে যে তাদের পারস্পরিক ক্রিয়া এবং সহযােগিতার সাথে একটা যুক্ত ফলের উৎপাদন হতে পারে। যেমনঃ মটরগাড়ি, বাস, ট্রেন ইত্যাদি নিঃপ্রাণ এবং কৃত্রিম উপায়ে তৈরি জড়বস্তু বিশেষ। যন্ত্র হলাে বাহ্য সম্পর্কের ভিত্তিতে একত্রিত কতকগুলাে জড় অংশের সমষ্টি যা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যসাধনের জন্য কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট। যন্ত্রের কোনাে উদ্দেশ্য নেই। মানুষের লক্ষ্য পূরণ করাই তর লক্ষ্য। যন্ত্রের আত্মােন্নয়ন, আত্মসংবরণ, স্ব-বিবর্তন ও প্রজননের জন্য কোনাে অন্তর শক্তির প্রয়ােজন হয় না । যন্ত্রের অংশগুলাের অস্তিত্ব এ সমগ্রতার ওপর নির্ভর না করলেও যন্ত্রের সমগ্রতা এর অংশগুলাের ওপর নির্ভর করে। যন্ত্র স্ব-নিয়ন্ত্রিত নয় কিংবা এর কোনাে স্ব-উদ্দেশ্য নেই; অন্যের কল্যাণসাধনের জন্যই যন্ত্রের সৃষ্টি। সুতরাং বলা যায়, যন্ত্র কৃত্রিম উপায়ে সৃষ্ট বস্তু বিশেষ।
জীবদেহ ও যন্ত্রের মধ্যকার পার্থক্যঃ জীবদেহ ও যন্ত্রের মধ্যে শুধু মৌলিক পার্থক্যই নেই আছে কিছু মিল। নিম্নে পর্যায়ক্রমে এদের মধ্যকার সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যগুলাে আলােচনা করা হলাে-
জীবদেহ ও যন্ত্রের মধ্যকার সাদৃশ্যঃ নিম্নে জীবদেহ ও যন্ত্রের মধ্যকার সাদৃশ্যগুলাে সবিস্তারে উল্লেখ করা হলাে-
(১) জীবদেহ যেমন বিভিন্ন অংগ তথা অংশের সমষ্টি, যন্ত্র ও তেমনি কতকগুলি অংশের সমন্বয়ে গঠিত, সুতরাং এটা একটা সাদৃশ্য দিক।
(২) জীবদেহের বিভিন্ন অংগ পরস্পরের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত। ঠিক একইভাবে যন্ত্রের বিভিন্ন অংশগুলাে ও একে অপরের সাথে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত।
(৩) জীবদেহের কোনাে অঙ্গহানি কিংবা বিকল হয়ে পড়লে জীবের সার্বিক কার্যক্রম যেমন বাধাগ্রস্ত হয় ঠিক তেমনি যন্ত্রের কোনাে অংশ বিকল হলে যন্ত্রের কার্যক্রম ব্যাহত হয়।
(৪) যন্ত্রের বিভিন্ন অংশের মতই জীবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ এক সাধারণ উদ্দেশ্যসাধন বা কার্যনির্বাহের জন্য নিয়ােজিত হয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এরা পরস্পর সম্পর্কিত হতে দেখা যায়। এ থেকে পণ্ডিতগণ জীবদেহ ও যন্ত্রের মধ্যে কোনাে মূল পার্থক্য নেই বলে মনে করেন।
জীবদেহ ও যন্ত্রের মধ্যে বৈসাদৃশ্যঃ নিম্নে জীবদেহ ও যন্ত্রের মধ্যে বৈসাদৃশ্যগুলাে বিস্তারিত আলােচনা করা হলাে-
(১) যন্ত্র হলাে প্রাণহীন জড় পদার্থ। যন্ত্রের মধ্যে প্রাণের কোনাে অস্তিত্ব নেই। অন্যদিকে জীবদেহ প্রাণবন্ত। প্রাণের উপস্থিতিতে জীবদেহ সক্রিয় হয়ে ওঠে।
(২) যন্ত্র মানুষ কর্তৃক সৃষ্ট। মানুষ তার উদ্দেশ্যসাধনের জন্য যন্ত্রের সৃষ্টি করেছে। কিন্তু জীবদেহ মানবসৃষ্ট নয়। মানুষের পক্ষে জীবদেহের কোনাে অংশ সৃষ্টি করা সম্ভব নয়।
(৩) জীবদেহ স্ব-নিয়ন্ত্রিত। জীবদেহ নিজে নিজেই চলতে পারে। তারাে পরিচালনার জন্য বাইরের কোনাে শক্তির দরকার নেই। কিন্তু যন্ত্র -নিয়ন্ত্রিত বা স্ব-চালিত নয়। একে বাইরের শক্তি দিয়ে চালাতে হয়।
(৪) যন্ত্রের স্বীয় কোনাে উদ্দেশ্য নেই। অন্যের উদ্দেশ্যসাধনের জন্য এর সৃষ্টি। অন্যদিকে জীবদেহ বা জীবের নিজস্ব উদ্দেশ্য রয়েছে।
(৫) জীবদেহের আত্মােন্নয়ন, আত্মনিয়ন্ত্রণ, প্রজনন ক্ষমতা রয়েছে কিন্তু যন্ত্রের এ ধরনের কোনাে ক্ষমতা নেই।
(৬) জীবদেহের ক্ষয়পূরণ ও বৃদ্ধিসাধন আছে। কিন্তু যন্ত্রের এ ধরনের কোনাে ক্রিয়া নেই। তাকে যেমনরূপে সৃজন করা হবে তেমনই থেকে যায়।
(৭) যন্ত্র হলাে মানবসৃষ্ট একটি কৃত্রিম সংগঠন। এর সমগ্রকে অংশের ওপর নির্ভর করতে হয়। অপরপক্ষে জীবদেহ হলাে একটি সত্তা জীবদেহের ক্ষেত্রে এর অঙ্গকে সমগ্রের ওপর নির্ভর করতে হয়।
(৮) যন্ত্রের ক্ষেত্রে প্রয়ােজনে এর অংশগুলাে সংযােজন। বিয়ােজন এবং মেরামত করা যায় কিন্তু এ অর্থে জীবদেহের ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয় না।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায়, জীবদেহ ও যন্ত্রের মধ্যে কিছু সাদৃশ্য থাকলেও এদের মধ্যে বৈসাদশ্যের কোনাে শেষ নেই। এটা বলাই বাহুল্য যে, জীবদেহ ও যন্ত্র কখনাে সমানে সমান হতে পারে না। যন্ত্র মানবসৃষ্ট। এর যেমন নেই প্রাণের স্পন্দন তেমন নেই নিজস্ব স্বাধীনতা বা নিজস্ব কোনাে উদ্দেশ্য। অন্যদিকে জীবদেহ হলাে একটি স্ব-নিয়ন্ত্রিত সত্তা, এর রয়েছে নিজস্ব উদ্দেশ্য, রয়েছে স্বাধীনতা, জীবদেহ একা একা চলতে পারে কোনাে সাহায্য ছাড়াই, এ ছাড়াও এর রয়েছে বংশবৃদ্ধি ও প্রজনন ক্ষমতা।
0 মন্তব্যসমূহ