স্বাধীনতা কাকে বলে? আধুনিক রাষ্ট্রে স্বাধীনতার রক্ষাকবচগুলাে আলােচনা কর


প্রশ্নঃ স্বাধীনতার সংজ্ঞা দাও। আধুনিক রাষ্ট্রে স্বাধীনতার রক্ষাকবচগুলাে বর্ণনা কর।
অথবা, স্বাধীনতা কাকে বলে? স্বাধীনতার রক্ষাকবচগুলাে আলােচনা কর।

ভূমিকাঃ বিশেষ সংরক্ষণের ব্যবস্থা ব্যতিত স্বাধীনতাকে রক্ষা করা যায় না। অধ্যাপক লাস্কির মতে, সংরক্ষণের বিশেষ ব্যবস্থা ব্যতিত অধিকাংশ লােক স্বাধীনতা উপভােগ করতে পারে না। আইন ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব দ্বারা স্বাধীনতা রক্ষিত হয়। কিন্তু কার্যত সরকারই রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব পরিচালনা করে। রাষ্ট্রীয় কার্য পক্ষপাতমূলক হয়ে থাকে। এতে এক-শ্রেণির ব্যক্তির স্বাধীনতা বিনষ্ট হতে পারে। তাই স্বাধীনতা রক্ষার জন্য বিশেষব্যবস্থা থাকা প্রয়ােজন। এ ব্যবস্থাগুলােই স্বাধীনতার রক্ষাকবচ নামে পরিচিত।

স্বাধীনতার সংজ্ঞাঃ সাধারণত অপরের কাজে কোনােরূপ হস্তক্ষেপ না করে নিজের কাজ সম্পাদন করার অধিকারকে স্বাধীনতা বলে। অন্যভাবে বলা যায়, স্বাধীনতা হলাে অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ না করে নিজের অধিকার পরিপূর্ণভাবে ভােগ করা । সুতরাং বলা যায়, অপরের অধিকার বা কার্যাবলির ওপর হস্তক্ষেপ না করে স্ব-ইচ্ছানুসারে কার্য করার অধিকারকে স্বাধীনতা বলে।

প্রামাণ্য সংজ্ঞাঃ বিভিন্ন রাষ্ট্রচিন্তাবিদ বিভিন্নভাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে কতিপয় সংজ্ঞা প্রদান করা হলাে-

টি এইচ গ্রিন (T. H. Green) বলেন, কোন কিছু উপভােগ ও সম্পাদন করার ক্ষমতাকে স্বাধীনতা বলে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সিলি (Seely) -এর মতে, অতিশাসনের বিপরীত ব্যবস্থাই হলাে স্বাধীনতা। ("The opposite of over government")

প্রফেসার গেটেল (Prof. Gettel) বলেন, “স্বাধীনতা হচ্ছে সেসব কাজ করা এবং উপভােগ করা যেগুলাে করা ও উপভােগ করার যােগ্য।"

সি. ডি. বার্নস (C. D. Burms)-এর মতে, Liberty means liberty to grow to ones natural hight, to develop ones abilities. অর্থাৎ স্বাধীনতা হলাে ব্যক্তির স্বাভাবিক বিকাশ। ব্যক্তির সামর্থ্যের উন্নয়ন।

স্বাধীনতার রক্ষাকবচঃ আধুনিক রাষ্ট্রে স্বাধীনতার রক্ষাকবচগুলাে নিম্নে বর্ণনা করা হলো-

(১) আইনের অনুশাসনঃ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রাণকেন্দ্র হচ্ছে আইনের অনুশাসন। আইনের চোখে সবাই সমান ও কেউই আইনের উর্ধ্বে নয়। ধনী-দরিদ্র, উচু-নিচু সকলেই আইনের দৃষ্টিতে সমান। আর এই আইনের অনুশাসন, স্বাধীনতাকে সংরক্ষিত রাখতে পারে। তাই লাস্কি বলেন, বিশেষ সুযােগের ব্যবস্থা থাকলে অধিকারের অস্তিত্ব থাকে না।

(২) সংবিধানে মৌলিক অধিকারের ঘােষণাঃ শাসনতন্ত্র জনগণের আশা-ভরসার মূর্ত প্রতীক। এতে জনগণের মৌলিক অধিকারের তালিকা স্পষ্টরূপে লিপিবদ্ধ হয় ও এদের সংরক্ষণ বা প্রতিবিধানের ব্যবস্থা করা হয়। এগুলাের একটি বিশেষ মর্যাদাও থাকে। জনসাধারণ জানতে পারে তাদের অধিকার কি কি। নির্দিষ্ট অধিকার ভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিকার বিধানের প্রচেষ্টা অনির্দিষ্ট স্বাধীনতার ব্যাঘাতের অভিযােগে আন্দোলন অপেক্ষা অনেক বেশি কার্যকর।

(৩) ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণঃ অধিকার রক্ষা করার জন্য আইন, শাসন ও বিচার বিভাগকে পরস্পর পৃথক করা আবশ্যক। এতে এক বিভাগ অন্য বিভাগের কার্যকলাপে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। মার্কিন লেখক ব্লাকস্টোনের মতে, ক্ষমতা একত্রীকরণ স্বৈরাচারেরই নামান্তর। এতে অধিকার ক্ষুন্ন হয়।

(৪) দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থাঃ স্বাধীনতার অন্যতম রক্ষাকবচ হলাে দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা। এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় শাসন বিভাগ তার কার্যাবলির জন্য আইন সভার নিকট দায়ী থাকে। এছাড়া বিরােধী দলের অস্তিত্বের জন্য সরকার স্বৈরাচারী হতে পারে না এবং জনগণের স্বাধীনতা রক্ষিত হয়। Ivor Jennings বলেন, দায়িত্বশীল সরকার ব্যবস্থা, যেখানে বিরােধী দল সরকারকে সমালােচনা করতে পারে, সেখানে স্বাধীনতা অব্যাহত থাকে।

(৫) নাগরিকদের সতর্কতাঃ নাগরিকদের চেতনাবােধ ও সতর্কতা অধিকারের শ্রেষ্ঠতম রক্ষাকবচ। নিজেদের স্বাধীনতা ও অধিকারকে সুরক্ষিত করার জন্য নাগরিকদের সংগ্রাম করতে হবে। স্বাধীনতা রক্ষা করতে হলে জনগণের মধ্যে স্বাধীনতার জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষা থাকা প্রয়ােজন । লর্ড ব্রাইমের ভাষায়, সদা সতর্ক থাকাই হচ্ছে স্বাধীনতার মূল্য।

(৬) বিচার বিভাগের স্বাতন্ত্র্য ও নিরপেক্ষতাঃ এটা স্বাধীনতা সংরক্ষণের অন্যতম প্রধান রক্ষাকবচ। স্বাধীনতা রক্ষা করতে হলে বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগের নিয়ন্ত্রণ হতে মুক্ত রাখতে হবে।বিচার বিভাগ স্বতন্ত্র, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ থাকলে কোন নাগরিকের অধিকার ক্ষুন্ন হলে আদালত তার প্রতিকারের ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে।

(৭) ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণঃ স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনমূলক সংস্থাগুলােকে আঞ্চলিক বিষয়ে ক্ষমতা প্রদান করতে হবে ও এদেরকে কেন্দ্রের দৌরাত্ম্য হতে মুক্ত রেখে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে কেন্দ্রের ক্ষমতাকে বিকেন্দ্রীকরণ করে নাগরিকদের স্বাধীনতাকে সংরক্ষণ করতে হবে।

(৮) গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাঃ এ ব্যবস্থায় জনগণের স্বাধীনতা সংরক্ষিত হয়। গণ উদ্যোগ, গণভােট, পদচ্যুতি প্রভৃতি প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতির প্রয়ােগ করে শাসকচক্রের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারলে স্বাধীনতা রক্ষা পায়। যেহেতু সাম্য ও স্বাধীনতা গণতন্ত্রের ভিত্তি সেহেতু গণতন্ত্রকে স্বাধীনতার অন্যতম রক্ষাকবচ করা যায়।

(৯) আইনঃ আইন হচ্ছে স্বাধীনতার পূর্বশর্ত ও রক্ষক। আইন আছে বলেই স্বাধীনতা ভােগ করা সম্ভব হয়। আইনবিহীন সমাজে স্বাধীনতা স্বেচ্ছাচারিতায় রূপ নেয়। প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লকের মতে, “যেখানে আইন নেই, সেখানে স্বাধীনতা থাকতে পারে না।”

(১০) সুসংগঠিত দলীয় ব্যবস্থাঃ সুসংগঠিত দলীয় ব্যবস্থা স্বাধীনতার অন্যতম রক্ষাকবচ। আধুনিক গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় সুসংগঠিত রাজনৈতিক দলগুলাে সরকারের কার্যাবলীর প্রতি তীক্ষ দৃষ্টি রাখে ও জনস্বার্থ বিরােধী কাজের তীব্র সমালােচনা করে জনগণের স্বাধীনতা রক্ষা করে।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, সকল উপাদানই স্বাধীনতা সংরক্ষণে বিরাট ভূমিকা রাখে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হল স্বাধীনতা সংরক্ষণ করতে হলে নিজেদের স্বাধীনতা সম্পর্কে নিজেদের সতর্ক থাকতে হবে। লাস্কি, ঠিকই বলেছেন, সদা সতর্কতাই স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য এবং জনগণের সাহসিকতার মধ্যেই ইহার সাফল্য নিহিত। লাস্কি আরও বলেন, "In democratic state liberty is the most essential thing for human rights."

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক