জড় সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক মতবাদ আলােচনা কর


প্রশ্নঃ জড় সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক মতবাদ আলােচনা কর।
অথবা, জড়ের প্রকৃতি সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক ধারণা বর্ণনা কর।

ভূমিকাঃ যথার্থ দর্শনের প্রথম সমস্যা হলাে জড়ের প্রকৃতি নিরূপণ করা। জড়ের প্রকৃতি নিরূপণ করতে গেলেই জড়ের গুণকে জানতে হবে। জড়ের প্রকৃতি নিরূপণ করতে গিয়ে আমরা বিভিন্ন যুগের দর্শনে জড় সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত পাব। দর্শনের জন্মকাল থেকেই জড়ের প্রকৃতি নির্ণয়ের চেষ্টা চলে আসছে। আজ এ প্রচেষ্টা শেষ হয়েছে এটা বলা চলে না। বস্তুত জ্ঞান, বুদ্ধি ও জাগতিক উন্নতির সাথে সাথে এবং সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে জড়ের প্রকৃতি নির্ণয়ের সমস্যাটাও জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে।

জড়ের স্বরূপঃ জড় হলাে জাগতিক বস্তুর মূল উপাদান। জাগতিক বস্তুর পরিবর্তন হতে পারে। কিন্তু জড়ের কোন পরিবর্তন সাধিত হয় না। কেননা, জড় হচ্ছে জাগতিক বস্তুর মৌলিক মুখ্য গুণ ও গৌণ গুণ। জড়ের মুখ্য গুণ বিস্তৃতি বা দেশ অধিকার করে থাকে। অভেদ্যতা বা গতিরােধ করার ক্ষমতা, বাইরের শক্তির মাধ্যমে গতিশীল হওয়া এবং জাত্য বা একই অবস্থায় থাকার প্রবৃত্তি। জড়ের গৌণ গুণ হলাে রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ ইত্যাদি এবং এ গৌণ গুণগুলাে পরমাণুর রাসায়নিক সংযােগ বা ক্রিয়া থেকে উদ্ভূত হয়ে থাকে।

জড়ের নির্জড়ীকরণঃ বৈজ্ঞানিক জড়বাদের ভিত্তি মজবুত করেছেন বর্তমান অত্যাধুনিক যুগের বৈজ্ঞানিকগণ। প্ল্যাংক আইনস্টাইন প্রমুখ বিজ্ঞানী সচল জড়বাদের ভিত্তিকে সুদৃঢ় করে জড়ের নির্জড়ীকরণ করেছেন। আপেক্ষিকতাবাদ এবং কোয়ান্টামবাদ প্রাচীন মতবাদের ওপর আঘাত হেনে দীপ্ত কণ্ঠে ঘােষণা করে যে, ভর ও শক্তি দুটি স্বতন্ত্র সত্য নয় কিন্তু ভরকে শক্তির সাহায্যে ব্যাখ্যা করার কোনাে প্রয়ােজন নেই, বরং ভর শক্তির রূপান্তর ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই শক্তিই জগতের মূল উপাদান এবং জড় শক্তিরই এক বিশেষ রূপমাত্র। এই কারণে আধুনিক বিজ্ঞানীদের হাতে পড়ে জড় এবং শক্তির মধ্যের দ্বৈততা দূর হয়ে যায় এবং শক্তিই জগতের আদিম উপাদান বলে পরিগণিত হয়।

জড়ের প্রকৃতিঃ সাধারণ লােক দেশ ও কালস্থিত এবং যা প্রত্যক্ষিত হয় সবকিছুকে জড় বলে মনে করে। তাদের মতে, জড় হলাে বস্তুর নিয়ত পরিবর্তনের মাঝে অপরিবর্তনীয়তা। কিন্তু এ অপরিবর্তনীয়তার স্বরূপ কী এবং জাগতিক বস্তুর সাথে এর সম্পর্কের কোনাে সুষ্ঠু জবাব সাধারণ লােক দিতে পারে না। তাই আমরা দার্শনিক মতবাদগুলাে আলােচনা করব।

জড়ের প্রকৃতি নির্ধারণের প্রাচীন দর্শনঃ দর্শনের প্রাচীনযুগের দার্শনিক থেলিস প্রথম বললেন- পানিই আদিসত্তা। এরপর এনাক্সিম্যাডার বললেন, অসীমই সত্তা। এনাক্সিমিনিস বললেন, বায়ুই আদিসত্তা। হিরাক্লিটাস বললেন, আগুনই আদিসত্তা। এরপর এম্পিডক্লিস বললেন, আগুন, পানি, বায়ু, মাটি- এ চারটি বস্তু আদিসত্তা। ডেমােক্রিটাস ও লিউসিপাম বললেন পরমাণুর কথা।

জড়ের প্রতি নির্ধারণে আধুনিক দর্শনঃ আধুনিক দর্শনে বুদ্ধিবাদী ডেকার্ট জড়ের প্রকৃতি নিয়ে আলােচনা করেছেন। ডেকার্টের মতে, জগতে দুটি দ্রব্য আছে- জড় ও মন। জড় মনের ঠিক বিপরীত তত্ত্ব। জড় ও বিস্তৃতি সমার্থক, মনের বিস্তৃতি নেই। জড়ের কোনাে চেতনা নেই। জড়ের গতির কারণ হিসেবে তিনি ঈশ্বরকে টেনে আনেন। স্পিনােজা মন ও জড়কে গুণের পর্যায়ে নিয়ে আসেন। তিনি বলেন, এগুলাে একমাত্র নিরপেক্ষ দ্রব্য অসীমের গুণ মাত্র। লাইবনিজের মতে, মােনাডই দ্রব্য। এই মােনাডের চেতনা আছে।

জড়ের বৈজ্ঞানিক মতবাদঃ আধুনিক কালে দার্শনিকরা জড়বাদকে বিভিন্নভাবে আলােচনা করেছেন। এদের মতবাদ আলােচনা করে জড়বাদকে দু'ভাবে ভাগ করা যায়। যথাঃ পরমাণুবাদ বা নিশ্চল জড়বাদ এবং সচল জড়বাদ। নিচে আমরা এ বিষয় দুটি আলােচনা করব।

সচল জড়বাদঃ সচল জড়বাদ আধুনিক দর্শনের একটি উল্লেখযােগ্য দার্শনিক মতবাদ। বিজ্ঞানীরা ডাল্টনের নিষ্ক্রিয়তা ও গতিহীনতার নীতিকে অস্বীকার করে প্রমাণ করেন যে, পরমাণু নিষ্ক্রিয় ও নিশ্চল নয় বরং সক্রিয় এবং সচল। তাদের মতবাদ সচল জড়বাদ নামে পরিচিত।

আধুনিক কালের পদার্থবিদরা ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে পরমাণুর এ রহস্য উন্মােচন করেন। পাশ্চাত্যের অন্যতম বিজ্ঞানী ফ্যারাডে প্রমাণ করেন যে, পরমাণু নিষ্ক্রিয় নয়। বরং প্রত্যেকটি পরমাণু তড়িৎযুক্ত, যার ফলে তারা একে অপরকে আকর্ষণ-বিকর্ষণ করতে পারে। বিজ্ঞানী নিউটনও পরমাণুর আকর্ষণ ও বিকর্ষণ শক্তিতে বিশ্বাস করতেন। লর্ড কেলভিনের মতে, পরমাণু হলাে সর্বব্যাপী তরল পদার্থের মতাে। অস্টওয়াল্ড-এর মতে, প্রত্যেকটি পরমাণু হচ্ছে শক্তির আধার। এ শক্তি সাধারণত সাম্যাবস্থাতেই থাকে, কিন্তু কোনাে কারণে সাম্যাবস্থা ব্যাহত হলে শক্তির প্রকাশ ঘটে।

পরমাণুর ধারণাঃ রাদারফোর্ড, বাের, মিলিকান প্রমুখ আধুনিক পদার্থবিদ পূর্ববর্তী বিজ্ঞানীদের মতবাদকে ভুল প্রমাণিত করে পরমাণু সম্পর্কে এক নতুন তথ্য দেন। পূর্ববর্তী বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল যে, পরমাণু অভেদ্য, অবিভাজ্য এবং সরল। আধুনিক বিজ্ঞানীরা দেখালেন যে, প্রত্যেকটি পরমাণু বস্তুকণা ও বিদ্যুৎশক্তির একটি জটিল সংগঠন। উপাদানের সংখ্যা ও তাদের পারস্পরিক সংগঠনের ভিত্তিতেই এক পরমাণু অপর পরমাণু থেকে ভিন্ন।

প্রত্যেকটি পরমাণুর কেন্দ্রস্থলে ধনাত্মক বিদ্যুৎশক্তি বা একটি নিউক্লিয়াস থাকে। এ নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে এক বা একাধিক ইলেকট্রন বা ঋণাত্মক বিদ্যুৎ আবর্তন করে। পরমাণুভেদে ইলেকট্রনের সংখ্যা কম-বেশি বা ইলেকট্রনের সমাবেশও ভিন্ন হতে পারে। সৌরজগতে যেমন সূর্যকে ঘিরে বিভিন্ন গ্রহ-উপগ্রহ আবর্তিত হয়, ঠিক তেমনি পরমাণুও সৌরজগতের মত। নিউক্লিয়াসকে ঘিরে বিভিন্ন ইলেকট্রন-প্রােটন আবর্তিত হয়। হাইড্রোজেন পরমাণু হলাে সবচেয়ে হালকা। যার ইলেকট্রন তার একটি মাত্র প্রােটনের চারপাশে ঘুরছে। হাইড্রোজেন পরমাণুর তুলনায় ইউরেনিয়াম পরমাণু বেশ ভারী।

নিশ্চল জড়বাদঃ আধুনিককালে বিজ্ঞানীদের মতে, বিভিন্ন জাগতিক বস্তু, যেমন-পানি, বাতাস ইত্যাদি বিশ্লেষণ করা হলে কতগুলাে মৌলিক উপাদান পাওয়া যায়। এগুলাে হলাে অক্সিজেন, কার্বন, নাইট্রোজেন ইত্যাদি। এ মৌলিক উপাদান দিয়েই সব জড়বস্তু গঠিত। মৌলিক উপাদানগুলাে বিভিন্ন অনুপাতে মিশ্রিত হওয়ার ফলেই বিভিন্ন বস্তুর সৃষ্টি হয়।

উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ডেমােক্রিটাসের পরমাণুবাদের ওপর ভিত্তি করে তার নিশ্চল জড়বাদ উপস্থাপন করেন। তার মতে, কোনাে জড়বস্তুকে ক্রমাগতভাবে ভাগ করা হলে শেষ পর্যন্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা পাওয়া যায়। যেগুলােকে আর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে ভাগ করা যায় না। এ ক্ষুদ্রতম কণাগুলাে অবিভাজ্য এবং অবিনাশী, অভেদ্য এবং গতিহীন। কিন্তু বাইরের থেকে শক্তি প্রয়ােগে এগুলােকে গতিশীল করা যায়।

ডাল্টন বলেন, জড় ও শক্তি হলাে পরস্পর নিরপেক্ষ স্বত সত্তা এবং তাদের কোনাে বিনাশ নেই, যদিও রূপান্তর ঘটতে পারে। আর একেই বলে জড় ও শক্তির অবিনশ্বরতা নীতি।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, জড় হলাে জাগতিক বস্তুর মূল উপাদান। জাগতিক বস্তুর পরিবর্তন সাধিত হতে পারে কিন্তু জড়ের কোনাে পরিবর্তন সাধিত হয় না। কেননা, জড় হচ্ছে জাগতিক বস্তুর মৌলিক উপাদান। উদাহরণ হিসাবে আমরা বলতে পারি, কোন একটি ফুল বা ফল মাটিতে ঝরে পড়তে পারে। কিন্ত ফুলের এই পরিবর্তন সত্ত্বেও আমরা ধারণা করি না যে, ফুলের উপাদান বিনষ্ট হয়েছে। জড় যেমন জাগতিক বস্তুর একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য, তেমনি জড়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলাে এই যে, জড় স্থায়ী ও সর্বব্যাপক।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক