‘সার্বভৌমের ঘােষণাই হচ্ছে আইন’ এবং ‘আইনের ভিত্তি হচ্ছে নৈতিকতা'-এ দু'য়ের মধ্যে কোনটি গ্রহণযােগ্য?


প্রশ্নঃ ‘সার্বভৌমের ঘােষণাই হচ্ছে আইন’ এবং ‘আইনের ভিত্তি হচ্ছে নৈতিকতা'-এ দু'য়ের মধ্যে কোনটি গ্রহণযােগ্য? আলােচনা কর।

ভূমিকাঃ আইন মানব সমাজের দর্পণ স্বরূপ। বৃহত্তর সমাজ জীবন ও রাষ্ট্রীয় কাঠামাের দ্বারা আইনের প্রকৃতি নির্ধারিত হয়ে থাকে। আইনের যথার্থ স্বরূপ সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনধারা এবং ভাব ও নীতির ওপর নির্ভরশীল। আইনের সংজ্ঞা ও স্বরূপ সম্পর্কিত রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে যে বিভিন্ন মতবাদ লক্ষ্য করা যায় তারমধ্যে বিশ্লেষণপন্থিরা দিয়েছেন এক ধরনের মতবাদ আর ইতিহাসপন্থিরা দিয়েছেন অন্য ধরনের মতবাদ। বিশ্লেষণপন্থিরা মনে করেন, সার্বভৌমের ঘােষণাই হলাে আইন আর ইতিহাসপন্থিরা মনে করেন যে, আইনের ভিত্তি হচ্ছে নৈতিকতা।

আইনের সংজ্ঞাঃ প্রচলিত অর্থে আইন বলতে নিয়ম-কানুন বা বিধিকে বুঝায়। মানুষ যেসকল বিধি-বিধান সমাজে মেনে চলে, তাকে সামাজিক আইন বলা হয়। সমাজে মানুষের আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যে সকল বিধি-বিধান চালু করা হয়, সেগুলিকে রাষ্ট্রীয় আইন বলা যেতে পারে।

প্রামাণ্য সংজ্ঞাঃ বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে আইনের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন তা নিম্নে আলােচনা করা হলাে-

অধ্যাপক হলান্ডের (Holland) মতে- "A Law is a general rule of external human action enforced by the sovereign political authority". (সার্বভৌম রাষ্ট্রনৈতিক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রযুক্ত মানুষের বাহ্যিক আচরণ নিয়ন্ত্রণকারী সাধারণ নিয়মই হলাে আইন)

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক এরিস্টটলের (Aristotle) মতে- আইন হলাে পক্ষপাতহীন যুক্তি (Law is the passionless reason)

সার্বভৌমত্বের সংজ্ঞাঃ সার্বভৌমিকতার অর্থ ও প্রকৃতি সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতপার্থক্যের শেষ নেই। ল্যাটিন শব্দ Inperanus এবং Soverano থেকে ইংরেজি Sovereignty শব্দটি এসেছে। এ দু'টি ল্যাটিন শব্দের অর্থ Supreme অর্থাৎ প্রধান বা চূড়ান্ত। সুতরাং ব্যুৎপত্তিগত অর্থে সার্বভৌমত্ব হলাে রাষ্ট্রের চূড়ান্ত অবাধ ও নিরঙ্কুশ ক্ষমতা। এখন দেখা যাক বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে কী মত পােষণ করেন।

প্রামাণ্য সংজ্ঞাঃ বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ সার্বভৌমত্বের সম্পর্কে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে তা। আলােচনা করা হলাে-

Prof. D. D. Raphael বলেন, সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্রের চরম ক্ষমতা। এ ক্ষমতাবলে রাষ্ট্র তার সীমানার মধ্যে শেষ কথাটি বলে এবং চূড়ান্ত ইচ্ছা প্রকাশ করে।

ফরাসি দার্শনিক জ্যা বোঁদের Jean Bodin) মতে, 'আইনের দ্বারা অনিয়ন্ত্রিত নাগরিক ও প্রজাদের ওপর রাষ্ট্রের চরম ক্ষমতাই হচ্ছে সার্বভৌমত্ব।" (Sovereignty is supreme power over citizens & subjects, unrestrained by law.)"

অধ্যাপক আর্নেষ্ট বার্কার (Ernest Barker)-এর মতে, কোনাে রাষ্ট্র সার্বভৌম এ কথার অর্থ হলাে। নির্দিষ্ট সমাজে রাষ্ট্রের চরম বা চূড়ান্ত কর্তৃত্ব রয়েছে ও এর আইন সমাজের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের নিয়ম কানুনের ঊর্ধ্বে।

নৈতিকতার সংজ্ঞাঃ নীতি শব্দ থেকে নৈতিকতা শব্দটির উৎপত্তি। নৈতিকতা বলতে উত্তম গুণাবলিকে বুঝায়। অর্থাৎ নীতির অনুসরণ-অনুকরণ করাই নৈতিকতা। অন্যভাবে বলা যায়, নীতির অনুসরণ ও অনুকরণ করা এবং নীতির বহির্ভূত কোনাে কাজ না করাকে নৈতিকতা বলে। নৈতিক বিধান মানুষের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ উভয় প্রকার কার্যকলাপকে নিয়ন্ত্রণ করে। মানুষের মন, চিন্তা, অনুভূতি প্রভৃতি সব কিছুই নৈতিকতার এখতিয়ারভুক্ত।

দুই মতবাদের গ্রহণযােগ্যতাঃ বিশ্লেষণপন্থি ও ইতিহাসপন্থিদের সমর্থিত দুটি পরস্পর বিরােধী। মতবাদের মধ্যে কোনটি গ্রহণযােগ্য তা নিম্নের আলােচনা থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠবে।

বিশ্লেষণপন্থি তাত্ত্বিক ও তাদের যুক্তিঃ বিশ্লেষণপন্থি তাত্ত্বিকদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হচ্ছেন- জন অস্টিন, জেরেমি বেন্থাম, জ্যা বােদা, থমাস হবস, ম্যাকিয়াভেলি, হল্যান্ড প্রমুখ। এসব তাত্ত্বিকেরা মনে করেন আইন হলাে সার্বভৌমের আদেশ। তারা নিম্নলিখিত যুক্তিসমূহ পেশ করেন-

(১) রাষ্ট্রই আইনের উৎসঃ বিশ্লেষণপন্থি তাত্ত্বিকেরা মনে করেন, রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রীয় সার্বভৌম শক্তির মাধ্যমেই আইনের সৃষ্টি। রাষ্ট্র আইনের উর্ধ্বে। অর্থাৎ তারা মনে করেন রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের সার্বভৌম শক্তিই আইনের জন্ম দিয়েছে।

(২) আইন প্রণয়ন ও কার্যকরঃ তারা আরাে মনে করেন, রাষ্ট্র কর্তৃক আইন প্রণীত হয় এবং রাষ্ট্রের মাধ্যমেই আইন কার্যকর হয়। আর আইন অমান্য করলে রাষ্ট্র কর্তৃক দেয় শাস্তি ভােগ করতে হয়। সুতরাং তাদের যুক্তি হচ্ছে, রাষ্ট্রের ব্যাপারে আইনই সবকিছু। তাই বিশ্লেষণপন্থি দার্শনিকেরা মনে করেন যে, সার্বভৌমের আদেশই হচ্ছে আইন।

ইতিহাসপন্থি দার্শনিকদের মতামতঃ ইতিহাসপন্থি দার্শনিক ও তাত্ত্বিকেরা মনে করেন যে, আইনের ভিত্তি হচ্ছে নৈতিকতা।

(১) আইন রাষ্ট্রের উর্ধ্বেঃ ইতিহাসপন্থি দার্শনিকেরা মনে করে রাষ্ট্রের পূর্বে আইনের সৃষ্টি। রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে অনেক পরে। তারা আরােও মনে করেন, ঐতিহাসিক বিবর্তনের মাধ্যমে বিভিন্ন রীতিনীতি, প্রথা প্রভৃতির উৎপত্তি হয় এবং পরবর্তীতে আরােও বিবর্তনের মাধ্যমে তা আইনে পরিণত হয়। সার্বভৌমের আকস্মিক নির্দেশে হঠাৎ করে আইনের সৃষ্টি হয়নি বরং আইনের মাধ্যমে সার্বভৌমের সৃষ্টি হয়েছে।

(২) আইন নীতিভিত্তিকঃ তা কল্যাণকর ও আধুনিক রাষ্ট্র কল্যাণমূলক রাষ্ট্র। বল প্রয়ােগ বা শক্তি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠন করতে পারে না। সার্বভৌমের একক আদেশও কল্যাণ রাষ্ট্র গঠন করতে পারে না। রাষ্ট্রের লক্ষ্য হল জনগণের নৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সার্বিক কল্যাণসাধন করা।

(৩) আইন নীতি বিরােধী নয়ঃ ইতিহাসপন্থি তাত্ত্বিকেরা মনে করেন, আইন নীতি বিরােধী নয়। আইনের ওপর শাশ্বত প্রথা ও রীতিনীতির এক বিরাট প্রভাব বিদ্যমান। এ কারণে প্রচলিত প্রথা ও রীতিনীতির বিরােধী বা এর সাথে সামঞ্জস্যহীন কোনাে আইন জনগণ মান্য করতে চায় না। সুতরাং আইন কখনাে নীতি বিরােধী নয়। আর তাই নৈতিকতাই আইনের ভিত্তি।

(৪) আইন রাষ্ট্রশক্তি দ্বারা প্রণীত ও কার্যকরী নয়ঃ ইতিহাসপন্থি বিশ্লেষক ও দার্শনিকগণ মনে করেন যে, আইন হচ্ছে ন্যায়ের প্রতীক। শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়ে অভ্যাসগত কারণেই মানুষ আইন মেনে চলে। আর প্রাচীনকাল থেকে অভ্যাস, প্রথা, রীতিনীতির ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠেছে আইন। সুতরাং আইন রাষ্ট্রশক্তি কর্তৃক প্রণীত ও কাযর্করী নয়।

(৫) নীতিভিত্তিক আইন গ্রহণযােগ্যঃ আধুনিক রাষ্ট্র যেহেতু কল্যাণমূলক রাষ্ট্র, তাই জনকল্যাণের স্বার্থেই নীতিভিত্তিক আইন প্রয়ােজন। আইনকে নীতি ছাড়া কল্যাণ কল্পনা করা যায় না। আর তাই ইতিহাসবাদী দার্শনিকেরা মনে করেন নৈতিকতাই আইনের ভিত্তি।

পরিশেষঃ আইনের ভিত্তি সম্পর্কিত উভয় প্রকার মতবাদের তুলনামূলক আলােচনা করলে আমরা দেখি যে, আইনের ভিত্তি সম্পর্কিত ইতিহাসপন্থি দার্শনিকগণ প্রদত্ত মতবাদের যুক্তি অধিকতর শক্তিশালী। আলােচনায় আমরা দেখি যে, নৈতিকতা বা নীতি বিরােধী আইন মানুষের যেমন কল্যাণ করে না, তেমনি তা মানুষ মান্যও করে না। আর সার্বভৌমের নির্দেশ হলেই তা কখনাে আইন হতে পারে না। আইন মানুষের আচার-আচরণ, রীতিনীতি ও মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ না হলেও তা কার্যকর করা যায় না। সুতরাং বলা যায় সার্বভৌমের নির্দেশ নয়-নৈতিকতাই আইনের ভিত্তি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক