‘কাঁটাতারে প্রজাপতি’ গণমানুষের সংগ্রামী চেতনার শিল্পরূপ।- এ উক্তিটির সার্থকতা পরিমাপ কর


প্রশ্নঃ ‘কাঁটাতারে প্রজাপতি’ গণমানুষের সংগ্রামী চেতনার শিল্পরূপ।- এ উক্তিটির সার্থকতা পরিমাপ কর।

উত্তরঃ বাংলাদেশের প্রধান কথাসাহিত্যিকদের অন্যতম সেলিনা হােসেন (জন্ম ১৯৪৭)। তার সাহিত্যের বিষয় হিসেবে উঠে এসেছে বহমানকাল, রাষ্ট্র ও মানবজগৎ। তার উপন্যাসে রাজনৈতিক সময় বা আন্দোলন অধিকতর পরিপ্রেক্ষিত অর্জন করে। বাঙালির অহঙ্কার ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ তার লেখায় নতুন মাত্রা পেয়েছে। নারীর শাশ্বত দৃষ্টি, সনাতন আদর্শ বজায় থাকে তার লেখায়। স্বদেশ ভাবনার প্রত্যয়ে গৌরবোজ্জ্বল পর্বগুলাে উন্মোচিত হয় কাহিনী সূত্রে, জাতীয় চরিত্র প্রতীকায়িত হয় আদর্শের আশ্রয় থেকে। এভাবে তার রচনাসম্ভার হয়ে উঠে অনবদ্য এবং অভিনব।

সেলিনা হােসেনের ‘কাঁটাতারে প্রজাপতি' (১৯৮৯) নাচোলের তেভাগা আন্দোলন ও তার কিংবদন্তিতুল্য সংগঠক ও নেত্রী ইলামিত্রকে নিয়ে লেখা ইতিহাস-নির্ভর জীবনী উপন্যাস। উপন্যাসে বাস্তব রাজনৈতিক চরিত্রকে বস্তুনিষ্ঠভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করতে হয়েছে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে যেন তা মনগড়া কাহিনিতে পরিণত না হয়। ‘কাঁটাতারে প্রজাপতি', উপন্যাসটি লেখার মুখ্য উদ্দেশ্য কি ছিল তা সেলিনা হােসেন তার প্রবন্ধ ‘নির্ভয় কর হে' -তে বর্ণনা করেছেন-
“নাচোলের তেভাগা আন্দোলনের পটভূমিতে ইলা মিত্রকে নিয়ে আমি যে উপন্যাসটি লেখি তার নাম ‘কাঁটাতারে প্রজাপতি'। আমি চেয়েছিলাম আমাদের ছেলে-মেয়েরা গল্পের ভেতর দিয়ে জানুক নিকট অতীতকে। আবিষ্কার করুক সেই সব মানুষকে যারা জীবন দিয়ে ইতিহাসের সড়ক তৈরি করেন।"

ইতিহাসের সড়ক তৈরি করা এসব মানুষকে ‘গণমানুষ’ হিসেবে আখ্যায়িত করলেই মানানসই হবে বােধ করি। উপন্যাসের সকল চরিত্র একটি অভিন্ন উদ্দেশ্যমুখী সংগ্রামকে ধারণ করে সংগ্রামরত এবং তাদের আখ্যানই উপন্যাসরূপে পাঠকের সম্মুখে হাজির করেছেন সেলিনা হােসেন।

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পরে কেউ কেউ মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিল কিন্তু অল্পদিনের মধ্যে তারা বুঝে নেয় ক্ষমতার হাতবদল হয়েছে মাত্র; সাধারণ কৃষকের ভাগ্য এতে কোনােভাবে পরিবর্তন হবে না। উত্তরবঙ্গে তেভাগা আন্দোলন ক্রমাগত বিস্তৃত হচ্ছে, কৃষকরা সংঘবদ্ধ হচ্ছে। দিনাজপুরে নারায়ণ জোতদারদের সঙ্গে সংঘর্ষে শহিদ হয়। এরপর রামচন্দ্রপুর হাটে এক বড় জনসভায় মে দিবস পালিত হয়। জনসমাবেশ দেখে ঘাবড়ে যায় স্থানীয় জোতদার, ইজারাদার মহাজনরা; কোণঠাসা হয়ে পড়ে তারা।

আন্দোলনকারীরা টের পেল মুসলিমলীগ এ আন্দোলনকে সাম্প্রদায়িক মােড় দেয়ার চেষ্টা করছে। জোতদার, রাজনৈতিক নেতা এবং পুলিশ মিলে এ আন্দোলনে চির ধরানাের আপ্রাণ চেষ্টা করলেও রানীমা হয়ে ওঠা ইলামিত্র কোনাে ষড়যন্ত্রকে সফলতার মুখ দেখতে দেননি। ১৯৫০ এর জানুয়ারির ৫ তারিখে ঝলমলে সকালে চকচকে কাস্তে হাতে হাজার কৃষক নেমে পড়ে মাঠে। কৃষকদের চোর, লুণ্ঠনকারী সাজিয়ে প্রশাসনের সহায়তায় পলিশ বাহিনীকে দিয়ে আন্দোলনরতদের উপর গুলি চালায় সমাজের প্রতিভূ পুরুষরা। গুলি লেগে এক কৃষকের মৃত্যু হলেই জনতা পুলিশকে আক্রমণ করে এবং খুন করে কবর দেয় মাটিতে। ... ঘটনাটির পর সবকিছু দ্রুত ঘটতে থাকে। সে পুলিশের খুনের পর চাষিদের উপর পাকিস্তানি পুলিশ শুরু করে নারকীয় অত্যাচার। যুবতী মেয়েদের ধর্ষণ করা থেকে শুরু করে বাড়ি ঘরের মধ্যে অগ্নি সংযােগ, নাবালক শিশু থেকে দুধের শিশু এমনকি বৃদ্ধ বৃদ্ধারা জীবন্ত অবস্থায় পুড়ে যায়। লেখকের ভাষায়-
“দাউ দাউ পুড়ে যাচ্ছে গ্রাম। খাসুরু চণ্ডিপুর, জগদল, ধরল, শ্যামপুর, নাপিতপাড়া, সর্বত্র আগুনের লেলিহান খা-কালাে ধােয়া বিস্তৃত হচ্ছে। এক গ্রামের সীমানা পেরিয়ে অন্যগ্রামে- নদীতীর এবং তারও ওপার গুলির মুখে লুটিয়ে পড়ছে মানুষ।”
সকল গ্রামবাসীর জীবনে নেমে আসে অত্যাচারের খড়গ কৃপাণ; এদের সবার থেকে আলাদা বিচার ইলামিত্রের। পুলিশের হাতে ধরা পড়া ইলামিত্রকে নানাভাবে নির্যাতিত করতে থাকে পাকিস্তানি পুলিশ। পাকিস্তানি পুলিশের নারকীয় অত্যাচার শেষে ইলামিত্রকে পার্টি থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল কোনাে সংস্কারের বশবর্তী হয়ে তিনি যেন কিছু গােপন না করে। পার্টির নির্দেশে ইলামিত্র এক জবানবন্দি পেশ করেছিলেন। কারণ কোনাে পত্রিকা এটি প্রকাশ করতে চায়নি। অতএব কমিউনিস্ট পার্টি থেকে জবানবন্দি লিফলেট আকারে প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৫০ সালে ১৬ জানুয়ারি পুলিশ ইলামিত্রের ওপর নির্যাতন শুরু করে। সেলিনা হােসেনের ‘নির্ভয় কর হে’ গ্রন্থের ‘সেই জবানবন্দি এবং আমাদের ঋণ নিবন্ধে বিস্তৃতভাবে যে জবানবন্দি তুলে ধরেছেন আমরা সম্পূর্ণ বিবৃতি না দিয়ে শুধু অংশবিশেষ তুলে ধরব-
“ ২ কোটির ব্যাপারে আমরা কিছুই জানি না। বিগত ৭-১-৫০ তারিখে আমি রােহনপুরে গ্রেফতার হই এবং পর দিন আমাকে নাচোল নিয়ে যাওয়া হয় হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে জানতে। আমার যেহেতু বলার কিছুই ছিল না, কাজেই তারা আমার সমস্ত কাপড়-চোপড় খুলে নেয় এবং সম্পূর্ণ উলঙ্গভাবে সেলের মধ্যে আমাকে বন্দি করে রাখে।..."
“সেদিন সন্ধ্যা বেলাতে এস আই এর উপস্থিতিতে সেপাইরা বন্দুকের বাট দিয়ে আমার মাথায় আঘাত করতে শুরু করে। সে সময় আমার নাক দিয়ে প্রচুর রক্ত পড়তে থাকে।”

সেলিনা হােসেন তার উপন্যাসে জবানবন্দিটি ঠিক একইভাবে বিবৃত করেছেন। সংস্কারের শৃঙ্খল ভেঙ্গে জবানবন্দিটি একটি মাইলফলক, অন্যদিকে ধর্মভিত্তিক নতুন রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ভণ্ডামি এবং ব্যর্থতার সুস্পষ্ট চিত্র। রাষ্ট্র পরিচালনার শুরু থেকেই পাকিস্তান সরকার তথা তাঁবেদার মুসলমান পুলিশেরা যে অনৈতিক এবং ধর্মবিরুদ্ধ বর্বরতা প্রদর্শন করছে, তার মধ্যেই স্পষ্ট হয়েছে নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের নিয়তি।

‘কাঁটাতারে প্রজাপতি' উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র, বিপ্লবী আজমলের মৃত্যু দিয়ে উপন্যাসের কাহিনি শেষ হলেও শেষ পর্যন্ত ক্রিয়াশীল থাকে অপরাজেয় সমষ্টি চেতনাবােধ। শত অত্যাচারেও ইলামিত্র পরাজয় মানেন না। অনিমেষ লাহিরী, আজহার হােসেনও হার মানেননি। শাসকের সমস্ত বর্বরতাকে ছাপিয়ে মানুষের প্রতিরােধ চেতনা, সহ্যশক্তি ও সংগ্রামী দৃঢ়তা প্রবলভাবে প্রকাশমান। এভাবে শত নির্যাতন, দমন পীড়ন সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত মানুষের সংগ্রামী চেতনার জয় অনিবার্য। আর ব্যক্তিগত প্রত্যয় ছাপিয়ে গড়ে ওঠে সমষ্টিগত প্রত্যয়। এ প্রত্যয়ই শেষ পর্যন্ত প্রধান হয়ে উঠেছে উপন্যাসে।

এককথায় বলা যায়, এ উপন্যাস রচনার মাধ্যমে সেলিনা হােসেন নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন দেশের বিপ্লবী সংগ্রামের ইতিহাসের পাতা থেকে একজন সংগ্রামী নারীর জীবনকে কথাসাহিত্যে রূপায়িত করার মহৎ শৈল্পিক দায়িত্ব। ইতিহাসের পাতায় জীবনের শিল্পরূপ রচনা করায় সার্থক হয়েছেন তিনি। শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে বাঙালির অধিকার আদায়ের আন্দোলন ও আত্মদানের গৌরব গাথাকে সাহিত্যে রূপায়িত করে নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার মহৎ প্রয়াস সেলিনা হােসেনের কাঁটাতারে প্রজাপতি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক