অথবা, সমালােচনাসহ বার্কলির আত্মগত ভাববাদের একটি চিত্র তুলে ধর।
অথবা, বার্কলির আত্মগত ভাববাদের সমালােচনামূলক ব্যাখ্যা কর। বার্কলির মতবাদ কী আত্মকেন্দ্রিকবাদ?
ভূমিকাঃ দর্শনের ইতিহাসে ভাববাদ একটি প্রাচীন মতবাদ। এ মতবাদটি দর্শনে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে আলােচিত হয়ে আসছে। ভাববাদ অনুযায়ী ভাব বা আত্মই একমাত্র সত্য। বাহ্য বস্তুর মন নিরপেক্ষ কোনাে স্বতন্ত্র সত্তা নেই। দর্শনে ভাববাদের ওপর ভিত্তি করে উদ্ভূত মতবাদগুলাের মধ্যে শেলিং-এর অতীন্দ্রিয় ভাববাদ বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য।
বাকলির ভাববাদ বা বার্কলির আত্মগত ভাববাদের ব্যাখ্যাঃ বার্কলির আত্মগত ভাববাদ অনুযায়ী মনেরই সত্তা আছে। বাহ্য বস্তুর প্রকৃত সত্তা নেই। নিম্নে বার্কলি আত্মগত ভাববাদ সবিস্তারে ব্যাখ্যা করা হলাে-
(১) মন বা ধারণাই একমাত্র অস্তিত্বহীনঃ অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক জন লকের অভিজ্ঞতাবাদের অসারতা প্রদর্শন করে বিশপ বার্কলি যে মতবাদ প্রবর্তন করেন, তাই আত্মগত ভাববাদ নামে পরিচিত। জন লকের মতে, বস্তুতে সরাসরি, প্রত্যক্ষ করা যায় না বা জানা যায় না, ভাবা যায় কেবল একমাত্র মন বা তার ধারণাকে।
(২) অস্তিত্বপ্রত্যক্ষ নির্ভরঃ বিশপ বার্কলির সিদ্ধান্ত হলাে যে, কোনাে কিছুর প্রত্যক্ষণের ওপরই তার অস্তিত্ব নির্ভর করে। অর্থাৎ তার মতে, অস্তিত্ব প্রত্যক্ষণনির্ভর। তিনি বলেন, কোনাে বস্তুকে বিশ্লেষণ করলে কতকগুলাে গুণ এবং গুণের আশ্রয়স্বরূপ একটি আধার পাওয়া যায়। এ আধারকেই দ্রব্য বলেছেন। দ্রব্য ও গুণ মিলেই তার মতে বস্তু হয়।
(৩) মুখ্য গুণ অস্তিত্বশীল নয়ঃ বিশপ বার্কলির মতে, মুখ্য গুণের আধার হিসাবে দ্রব্যের অস্তিত্ত্ব স্বীকার করার প্রয়ােজন নেই। কেননা, যা প্রত্যক্ষ করা যায় না তার অস্তিত্ব নেই। তা ছাড়া লকের মতে, দ্রব্য অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয়। তাই দ্রব্য প্রত্যক্ষের বিষয় নয়। এবং যে কারণে এর আমিত্ব নেই। বার্কলির মতে, গুণের এবং গুণগুলাে ধারণারূপে মনেই থাকে। তাই শুধুমাত্র মন বা মনের ধারণা ছাড়া কোনাে বস্তুর অস্তিত্ব নেই।
(৪) গৌণ গুণের মতই মুখ্য গুণগুলাে মননির্ভরঃ জন লকের মতে, বস্তুর রূপ, রস, গন্ধ, প্রভৃতিকে গৌণ গুণ এবং বস্তুর আকৃতি আয়তন, ঘনত্ব প্রভৃতিকে মুখ্য গুণ বলা হয়। তার মতে, বস্তুর এই গৌণ গুণসমূহ বস্তুগত নয় বরংমননির্ভর। আবার মুখ্য গুণসমূহ সবার কাছে একরকম থাকে বিধায় এগুলােকে বস্তুগত গুণ বলা যায়। কিন্তু বিশপ বার্কলি বলেন যে, বস্তুর এই মুখ্য গুণগুলােও গৌণগুণের ন্যায় মননির্ভর এবং মনের ধারণামাত্র। তিনি তার বক্তব্য দানে এ যুক্তি দেখিয়েছেন।
যুক্তি-১ঃ মুখ্যগুণগুলাে যেমন- বিস্তৃতি, ঘনত্ব, সংখ্যা, গতি, স্থিরতা প্রভৃতি আমরা ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে প্রত্যক্ষ করি। যা কিছু প্রত্যক্ষ করা হয় তাই মনের ধারণা। সুতরাং এ গুণগুলােও গৌণ গুণগুলাের মতােই মনের ওপর নির্ভর, মন বা চেতনা বহির্ভুত কোনাে অস্তিত্ব এদের নেই।
যুক্তি-২ঃ গৌণ গুণগুলাে যেমন একএকজনের কাছে এক এক রকম, তেমনি মুখ্য গুণগুলােও এক একজনের কাছে এক এক রকম। একই খাদ্য যেমন কারাে কাছে, সুস্বাদু এবং কারো কাছে বিস্বাদ, তেমনি একই বস্তু কারাে কাছে ভারী, কারাে কাছে হালকা মনে হয়।
যুক্তি-৩ঃ মুখ্য ও গৌণ গুণগুলাে পৃথকভাবে প্রত্যক্ষ করা যায় না। কোনাে কিছুর বর্ণ আছে অথচ বিস্তৃতি নেই বা বিস্তৃতি আছে কিন্তু কোনাে বর্ণ নেই- এ হতে পারে না। সুতরাং বর্ণ যদি মনের ধারণা হয়, তাহলে বিস্তৃতি ও মনের ধারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। বার্কলির মতে, সব কিছুর অস্তিত্ব প্রত্যক্ষণের ওপর নির্ভরশীল। বস্তুর অস্তিত্বের ধারাবাহিকতা বা স্থায়িত্ব ব্যাখ্যা করার জন্য বার্কলি তার দর্শনে ঈশ্বরের ধারণা আনেন। বার্কলির মতে, বস্তুর অস্তিত্ব প্রকৃতপক্ষে, ঈশ্বরের প্রত্যক্ষণের ওপর নির্ভরশীল। ঈশ্বর সবসময় সবকিছু প্রত্যক্ষ করেন। তিনি বলেন, জগতটাই ঈশ্বরের ধারণারূপে বিদ্যমান। ঈশ্বরই নিয়মিত শৃঙখল অনুসারে সংবেদনের ধারণাগুলােকে আমাদের মনে সৃষ্টি করেন। ঈশ্বরই পরম চেতন সত্তা।
বাকলির ভাববাদ আত্মকেন্দ্রিকতাবাদ কি নাঃ বার্কলির মতবাদ আত্মগত চেতনা ব্যতীত অন্যান্য মন ও বিশ্বমনের কোনাে ধারণা দিতে পারে না বলে অনেক সংশয়বাদী বার্কলির আত্মগত ভাববাদকে আত্মকেন্দ্রিকতাবাদ বলে ভুল করেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, বার্কালি মতবাদকে আত্মকেন্দ্রিকতাবাদ এবং বার্কলিকে আত্মকেন্দ্রিকতাবাদী বলা যায় না। কারণ বার্কলি বিশ্বাস করেন যে, অভিজ্ঞতা শুধু আমার কারণেই নয়, বাহ্যিক ক্রিয়া-কলাপের ফলেও ঘটে। তিনি তার আত্মকেন্দ্রিকতা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য তাদের ওপর নির্ভর করেন। তিনি বলেন, আমাদের মনের কারণগুলাে ঈশ্বরের ওপর নির্ভরশীল। ঈশ্বর নির্দিষ্ট নিয়মে ধারণাগুলাে আমাদের মনের মধ্যে জাগিয়ে দেন। এ ছাড়া কতকগুলাে সংবেদন আমার মনের মধ্যে সৃষ্টি হয়। অন্য জীবাত্মার দরুন আমি সেগুলাের অস্তিত্বে বিশ্বাস করি। তাদের সাথে আমার যােগাযােগ হয়। এ যােগাযােগের ভিত্তি হলাে আমার ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস। এভাবে ঈশ্বরের ধারণা বার্কলির দার্শনিক মতবাদকে আত্মকেন্দ্রিকতাবাদে পরিণত হওয়া থেকে রক্ষা করে। বস্তুত বার্কলির আত্মগত ভাববাদ আত্মকেন্দ্রিকতাবাদ নয়। কারণ তিনি স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, “এই বিশ্বজগতে আমি আর আমার ধারণা ছাড়াও অন্য সসীম জীবাত্মার অস্তিত্ব আছে। আমি আমার ধারণার উৎস নই। আমার ধারণার জন্য আমি ঈশ্বরের ওপর নির্ভরশীল। যিনি একটি নির্দিষ্ট নিয়ম অনুযায়ী আমার মনে এগুলােকে জাগিয়ে তােলেন।”
সমালােচনাঃ বিশপ বার্কলির আত্মগত ভাববাদ সমালােচনার উর্ধ্বে নয়। এর ত্রুটিগুলাে নিম্নরূপ-
(১) বার্কলির আত্মগত ভাববাদের মূলসূত্র হচ্ছে, কোনাে কিছুর অস্তিত্ব তার প্রত্যক্ষণের ওপর নির্ভরশীল। দার্শনিক মুর বলেন, বস্তুর অস্তিত্ব প্রত্যক্ষণের ওপর নির্ভর করে না। প্রকৃতপক্ষে বস্তু আছে বলেই তা প্রত্যক্ষণের বিষয় হয়।
(২) দার্শনিক আলেকজান্ডার বলেন, কোনাে বস্তুকে জ্ঞানের বিষয় হতে হলে তাকে মনের ওপর অবশ্যই নির্ভর করতে হয়। কিন্তু তাই বলে বস্তুর অস্তিত্ব জ্ঞানের ওপর নির্ভর করে না।
(৩) জন লক বলেছেন, বস্তুর ধারণা বস্তুর অনুরূপ। তা থেকে বার্কলি এ সিদ্ধান্তে পৌছেন যে, বস্তু ও ধারণা অভিন্ন। অর্থাৎ বস্তু হচ্ছে ধারণা। বার্কলির এ সিদ্ধান্ত যুক্তিসঙ্গত নয়।
(৪) বার্কলি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুকে ব্যক্তিমনের ধারণা বা সংবেদন বলে মেনে নিয়েছেন। কিন্তু কখনাে তা প্রমাণ করে দেখাননি।
(৫) বস্তু এবং বস্তুর জ্ঞান এক জিনিস নয়। এ দু'য়ের পার্থক্য স্বীকার না করলে জ্ঞানের বিভিন্নতা থাকে না। সব জ্ঞানই একরকম হয়ে যায়।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, বিভিন্ন সমালােচনা থাকা সত্ত্বেও বিশপ বার্কলির আত্মগত ভাববাদের গুরুত্ব কম নয়। বাকলির আত্মগত ভাববাদ অনুযায়ী, শুধু মনেরই সত্তা আছে, বাহ্যবস্তর কোনাে সত্তা নেই। দার্শনিক হিউম অবশ্য এর গুরুত্ব অস্বীকার করে বলেছেন যে, কোনাে সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে এরূপ আত্মঘাতী দার্শনিক মতবাদ গ্রহণ করা সম্ভব নয়। কিন্তু তারপরও বার্কলির আত্মগত ভাববাদকে একেবারে গুরুত্বইনিভাবে দেখা যায় না।
0 মন্তব্যসমূহ