অথবা, সত্যতার স্বরূপ সম্পর্কীত মতবাদগুলাে আলােচনা কর।
অথবা, সত্যতা কী? সত্যতা সম্পৰ্কীয় প্রধান প্রধান মতবাদগুলাে সমালােচনাসহ আলােচনা কর।
ভূমিকাঃ জ্ঞানবিদ্যা দর্শনের একটি প্রধান শাখা। আর সত্যতা সম্পর্কীয় সমস্যা জ্ঞানবিদ্যার একটি অতি পরিচিত ও গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। তা ছাড়া দর্শন জগত ও জীবনের ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন করে। জীবন ও জগতের জ্ঞান দর্শনের লক্ষ্য, অবধারণের মাধ্যমে তা ব্যক্ত হয়। সকল অবধারনই সত্যতার দাবি রাখে, কিন্তু সকল অবধারন সত্য হবে এমন কোনাে নিশ্চয়তা নেই। যেমন সকল প্রাণি মৃত্যুর অধীন; লােহা আকাশে ওড়ে। এখানে প্রথম অবধারণটি সত্য কিন্তু দ্বিতীয় অবধারণটি মিথ্যা, অবধারনের সততার ওপর আমাদের চিন্তার বুনিয়াদে নির্ভর করে। তাই সবধরনের সত্যতা নিরূপণের মাধ্যমেই আমরা সত্যের স্বরূপ জানতে পারি।
সত্যতার সংজ্ঞাঃ সত্যতার স্বরূপ সম্পৰ্কীয় মতবাদগুলাে আলােচনার আগে সত্যতার সংজ্ঞা জানা দরকার।
(১) সাধারণ অর্থের দিক থেকেঃ সত্যতা বলতে সাধারণত অবধারণের সাথে অবধারণের স্বকীয় বিষয়ের অনুরূপতা মিল বুঝায়।
(২) খাঁটি বা প্রকৃত অর্থের দিক থেকেঃ দৈনন্দিন জীবনে নির্ভেজাল বা প্রকৃত শব্দকে বুঝাতে গিয়ে সত্য শব্দটি প্রয়ােগ করে থাকি। উদাহরণস্বরূপ, আমরা খাটি গয়নাকে সত্যিকারের গহনা বলে প্রকৃত হিসাব সত্যিকারের হিসাব বলে থাকি। এখানে সত্য শব্দটি খাঁটি বা প্রকৃত হিসাবে ব্যবহার করা হলাে।
(৩) গুরুত্বারােপের দিক থেকেঃ কোনাে ব্যক্তির ওপর গুরুত্বারােপের জন্য সত্যতা শব্দটি ব্যবহার করা হয় যেমনঃ কোনাে শিল্পীকে সত্যিকার শিল্পী বলা হলে ব্যক্তিটির মধ্যে যে শিল্পীসুলভ গুণ রয়েছে তা নির্দেশ করা হয়।
(৪) বচনের গুণের দিক থেকেঃ অনেকসময় কোনাে বচনের গুণ বা বৈশিষ্ট্যকে প্রকাশ করতে গিয়ে সত্যতা শব্দটি ব্যবহার করা হয়। তবে সত্যতা বলতে মূলত বচনের বৈশিষ্ট্যকেই নির্দেশ করে। তা ছাড়া আকারগত ও উপাদানগত সত্যকে বােঝাতে এই সত্যতা প্রত্যয়টি ব্যবহার করা হয়।
সত্যতা সম্পৰ্কীয় মতবাদঃ সত্যতা সম্পৰ্কীয় মােট চারটি প্রধান মতবাদের সন্ধান পাওয়া যায়। যা নিম্নে আলোচনা করা হলাে-
(১) স্বতঃপ্রতীতিবাদঃ এ মতবাদ অনুসারে অবধারনের সত্যতা স্বতঃপ্রতীতি হয়। যেসব অবধারণ সংশয়াতীত সেই অবধারণসমূহ সত্য। অবধারণ সত্য কিংবা মিথ্যা উভয়ই হতে পারে। সত্য ও অসত্যের মাপকাঠিতে অবধারণ সন্দেহাতীত অথবা সংশয়যুক্ত হতে পারে। সন্দেহাতীত অবধারণের সত্যতা স্বতঃপ্রতীত হয়, যেমনঃ ২+২ = ৪। ত্রিভুজের তিনটি কোণের সমষ্টি। দুই সমকোণের সমান ইত্যাদি। এ ধরনের অবধারণ থেকে আমরা যেসব যুক্তিবাক্য পাই তা নিশ্চিতভাবে গৃহীত হয়। বিখ্যাত দার্শনিক, আধুনিক দর্শনের রূপকার রেনে ডেকার্ট এ মতের প্রবর্তক।
সমালােচনাঃ সবকিছুর সমালােচনা দর্শনে বিদ্যমান। স্বতঃপ্রতীতিবাদ ও সমালােচনার উর্ধ্বে নয়। যেমন-
(i) গ্রহণযােগ্যতা, স্পষ্টতা ও পরিস্ফুটতা অবধারণের সত্যতা নিরূপণের একমাত্র পথ বলে গ্রহণ করা যায় না। কেননা, একটি অবধারণ সকলের কাছে সমান স্পষ্টতা, গ্রহণযােগ্যতা ও পরিস্ফুটতার দাবি রাখে না। তাই এগুলাে সত্যের মাপকাঠি হতে পারে না।
(ii) স্বতঃপ্রতীতিবাদ মতের সমর্থকেরাই অবধারণের নিশ্চয়তা সম্পর্কে একমত হতে পারে নি। যেমন ডেকার্টের মতে, আত্মজ্ঞান সম্পর্কীয় অবধারণ সর্বাপেক্ষা সংশয়াতীত। কিন্তু স্পিনােজা বলেন যে, খােদা সম্পর্কীয় অবধারণ সর্বাপেক্ষা সংশয়াতীত। তাই সত্যতা সম্পর্কিত মতবাদ হিসাবে স্বতঃপ্রতীতিবাদ যথার্থ মতবাদ নয়।
(২) অনুরূপবাদঃ এ মতবাদ অনুসারে বস্তর ধারণা যখন বস্তর অনুরূপ হবে তখন সাধারণ সত্য হবে। অর্থাৎ এক বস্তুর ধারনার ছাপ ঐ বস্তুর সাথে হুবহু মিলে গেলে ঐ বস্তর সম্পর্কে অবধারণের সত্যতা নিশ্চিত হওয়া যায়। আর ধারণার সাথে বস্তুর মিল না থাকলে অবধারণ মিথ্যা হয়। যেমনঃ “মধ হয় মিষ্টি" এটা সত্য কিন্তু দুগ্ধ হয় কালাে এই অবধারণটি মিথ্যা। কারণ বাস্তব জগতে আমরা এটা দেখি না। “অনুরূপতাবাদের সঠিক ব্যাখ্যা নিয়ে দার্শনিকদের মধ্যে মতবিরােধের কারণে বিভিন্ন দার্শনিক বিভিন্নভাবে অনুরূপতাবাদ ব্যাখ্যা করেছেন। যেমন-
(i) লৌকিক বা অবৈজ্ঞানিক বাস্তববাদীদের মতঃ এ মতবাদ অনুসারে আমরা বস্তুকে সরাসরি প্রত্যক্ষণ করি। অর্থাৎ বাস্তব জগতে ঐ বস্তুর ধারণা মিলে গেলে অবধারণটি সত্য হয়। অন্যথায় মিথ্যা হয়।
(ii) বৈজ্ঞানিক বাস্তববাদীদের মতঃ এ মতবাদ অনুসারে, বস্তুকে সরাসরি জানা যায় না। আমরা বস্তুর ধারণা বা অবভাসকে প্রত্যক্ষ করি মাত্র। এবং পরােক্ষভাবে বস্তুকে জানা যায়। তাই মনের ধারণার সাথে বা বস্তুর অনুরূপতা থাকলে অবধারণ সত্য এবং না থাকলে অবধারণ মিথ্যা।
সমালােচনাঃ অনুরূপতাবাদের সমালােচনা নিম্নরূপ-
(i) অনুরূপতাবাদের সমর্থকেরা এ মতবাদ সম্পর্কে পরস্পরবিরােধী অবস্থানে রয়েছে। তাই এ মতবাদের সাহায্যে অবধারণের সত্যতা প্রমাণ করা যায় না।
(ii) এ মতবাদ অনুসারে বাহ্য বস্তুর সাথে ধারণার মিল হলে অবধারণটি সত্য, কিন্তু বাহ্যবস্তু যেহেতু সরাসরি প্রত্যয়ন করা যায় না তাই অনুরূপবাদ যথার্থ মতবাদ নয়।
(৩) সংগতিবাদঃ ব্রাগলি, হেগেল প্রমূখ দার্শনিক এ মতবাদের একনিষ্ঠ সমর্থক। তাদের মতে, কোনাে অবধারণাই স্বতন্ত্রভাবে সত্য বা মিথ্যা হতে পারে না। কোনাে অবধারণ যখন অন্যান্য অবধারণের সাথে সংগতিপূর্ণ হয়ে সংবদ্ধমণ্ডলি গড়ে তােলে কেবল তখনই সেই অবধারণকেই সত্য বলা যায়। আর এই ঐক্যবদ্ধতা তৈরী করতে না পারলে কোনাে অবধারণই সত্য হবে না। যেমন আম মিষ্টি এটি স্বতন্ত্রভাবে সত্য বা মিথ্যা হতে পারে না।
সমালােচনাঃ সংগতিবাদের সংজ্ঞা নিম্নরূপ-
(i) বস্তুবাদীরা এ মতের সমালােচনা করে বলেন যে, কীভাবে একই অবধারণ আংশিকভাবে সত্য কিংবা আংশিকভাবে মিথ্যা হয় তা স্পষ্টত নয়।
(ii) সংগতিবাদ বচনের অভ্যন্তরীণ সম্বন্ধের ওপর নির্ভরশীল কিন্তু সমালােচকদের মতে, এটি বিভ্রান্তিকর। কারণ কোনাে বচন সত্য না মিথ্যা তা বচনটির সত্যতা যেসব পূর্বশর্তের ওপর নির্ভর করে তা জ্ঞানের ওপর নির্ভর করে না।
(৪) প্রয়ােগবাদঃ জনডিউই, উইলিয়াম জেমস, সিলার প্রমুখ দার্শনিক এ মতবাদের সমর্থক। তাদের মতে, কার্যকারিতা বা সাফল্যই সত্য নিরূপণের মাপকাঠি। কোনাে অবধারণ বা ধারণা সত্য কিনা তা নির্ভর করে এর কার্যকারিতার ওপর। এ সম্পর্কে উইলিয়াম জেমস বলেন, সত্য ধারণা হলাে এমন ধারণা যা আমরা গ্রহণ করতে পারি, পরীক্ষা করতে পারি, নিশ্চয়তা দান করতে পারি, প্রমাণ করতে পারি। কিন্তু মিথ্যা ধারণাসমূহ এসব শর্তের অধীন।
সমালােচনাঃ প্রয়ােগবাদের সমালােচনা নিম্নরূপ-
(i) প্রযােগবাদীদের এ মতবাদ যথার্থ নয়। কেননা কোনাে কোনাে সময় অনেক ভ্রান্ত অবধারণও বাস্তবজীবনে সাফল্যের সূচনা করতে পারে।
(ii) প্রযােগবাদীরা সত্যের যথার্থ স্বরূপ উদঘাটন করতে অক্ষম। কারণ এমতবাদ সত্যের স্বরূপ ও সত্যের পরীক্ষাকে অভিন্ন বলে মনে করে।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায়, এককভাবে সত্যতা নিরূপণের মাপকাঠি হিসাবে কোনাে মতবাদই যথার্থ বা সন্তোষজনক নয়। প্রত্যেকটি মতবাদের কিছু ভুল ত্রুটি থাকায় তা সমালােচিত হয়েছে। তাই বলে এমতবাদগুলাে একেবারে গুরুত্বহীন নয়। নিরপেক্ষ মন নিয়ে চিন্তা করলে দেখা যায় যে, মানবিক প্রয়ােজনবােধই সত্যতা নিরূপণের একমাত্র মাপকঠি। তাই অনুরূপবাদকে সত্যতা নিরূপণের মাপকাঠি হিসাবে একটি সন্তোষজনক মতবাদ বলা যায়। বস্তুত সত্যতা সম্পর্কিত সব মতবাদগুলােই দর্শনে গুরুত্বের স্বাক্ষর বহন করে।
0 মন্তব্যসমূহ